এক যুগ পর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সেনাকুঞ্জে যোগ দেওয়া বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে স্বাগত ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া এই মহাসম্মিলনীতে অংশ নেওয়ায় সবাই আনন্দিত ও গর্বিত।
কারামুক্ত হওয়ার পর এই প্রথম কোনও অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ঘরের বাইরে বের হন খালেদা জিয়া। বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টা ৪৩ মিনিটে তিনি সেনাকুঞ্জে পৌঁছান। এর আগে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে গুলশানের বাসভবন ফিরোজা থেকে তার গাড়িবহর সেনাকুঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়।
কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকে কেবল হাসপাতালে যাওয়া ও আসার জন্যেই খালেদা জিয়াকে তার বাসভবন ‘ফিরোজা’ থেকে বের হতে দেখা যেত। এসব সময় তিনি পরতেন বোরকার আদলে জামা। কিন্তু আজ তার পরনে ছিল একটি বেগুনি রঙের শাড়ি।
এদিন খালেদা জিয়ার গাড়িতে সঙ্গে ছিলেন তার কনিষ্ঠ পুত্র প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি ও গৃহকর্মী ফাতেমা।
বহরে অন্য গাড়িতে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ও একান্ত সচিব আব্দুস সাত্তার।
তিন বারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সেনাকুঞ্জে পৌঁছালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পাশের চেয়ারে বসানো হয় তাকে। তখন প্রধান উপদেষ্টা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এ সময় দুজনই ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানান।
আগেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পৌঁছান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। খালেদা জিয়াকে অনুষ্ঠানে দেখে তিনি কেঁদে ফেলেন।
সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তৃতার শুরুতেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অনুষ্ঠানে স্বাগত এবং অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানান প্রধান উপদেষ্টা।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “খালেদা জিয়া আজ এখানে আমাদের মধ্যে উপস্থিত আছেন। এক যুগ ধরে তিনি এই মহাসম্মিলনীতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান নাই। আজকে সুযোগ পেয়েছেন। আমরা সবাই আনন্দিত এবং গর্বিত যে এই সুযোগ দিতে পেরেছি আপনাকে।
“শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও এই বিশেষ দিবসে সবার সাথে শরিক হওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এই অনুষ্ঠানে আপনাকে বিশেষভাবে স্বাগত জানাচ্ছি।” খালেদা জিয়ার আশু রোগমুক্তি কামনা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
বক্তৃতার শুরুতে ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের স্মরণ করেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময় ছাত্র ও জনসাধারণের পক্ষে দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনী আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে বলে মন্তব্য করেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আন্দোলনের পরবর্তী সময়েও সেনাবাহিনী মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে বাহিনী সদস্যদের ভূমিকার প্রশংসাও করেন তিনি।
সেনাকুঞ্জের এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ছয় বছর পর খালেদা জিয়া কোনেও প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে সশরীরে অংশ নিলেন। আর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে অংশ নিলেন দীর্ঘ ১২ বছর পর।
মঙ্গলবার রাতে সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লে. জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লে. জেনারেল এ এস এম কামরুল আহসান ওই আমন্ত্রণপত্র বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে পৌঁছে দেন।
আর মঙ্গলবার দুপুরে বিএনপির চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং সিনিয়র নেতৃবৃন্দ মিলে ২৬ জন নেতার নামে আমন্ত্রণপত্র গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে তার একান্ত সচিব আবদুস সাত্তারের কাছে সেনা কর্মকর্তারা দিয়ে যান।
খালেদা জিয়া সবশেষ ২০১২ সালে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। তখন তিনি বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। এরপর আর কখনও তাকে সেনাকুঞ্জের এ আয়োজনে দেখা যায়নি। ২০১৮ সালে দুর্নীতি মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর তাকে আর আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
খালেদা জিয়ার পাশাপাশি ২০০৯ সালের পর এবারই প্রথম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও সেনানিবাসের এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
জনগণ যাতে সব ক্ষমতার মালিক হতে পারেন, তেমন দেশ গড়তে চাই : প্রধান উপদেষ্টা
মুক্তিযোদ্ধারা বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের যে স্বপ্ন নিয়ে রাষ্ট্রকে স্বাধীন করেছিলেন, তাদের সেই স্বপ্ন পূরণে ড. ইউনূস অঙ্গীকারাবদ্ধ বলে জানান। তিনি বলেন, “আমরা এখন থেকে বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই যেখানে সত্যিকার অর্থে জনগণই হবে সকল ক্ষমতার মালিক।
“জুলাই-আগস্ট ছাত্র জনতার বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে আমরা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করেছি। এ নতুন দেশে আমাদের দায়িত্ব সকল মানুষকে এক বৃহত্তর পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করা। কেউ কারও ওপরে না, আবার কেউ কারও নিচেও না; এই ধারণা আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।”
বিশ্ব দরবারে মানবিক ও কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসাবে সমাদৃত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখব। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে পারস্পরিক সম্মান, আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতা। জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলা এবং বৈশ্বিক শান্তি ও অর্থনীতি সুসংহতকরণে আমাদের একত্রে কাজ করতে হবে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।”
মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের ফলে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও পরিচিতি লাভ করেছে। দেশ স্বাধীন করার মহান ব্রত নিয়ে ‘৭১ এর ২৫ মার্চ কাল রাত থেকে বাঙ্গালী সেনারা সেনানিবাস ত্যাগ করে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
“একই সাথে এই দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র জনতা সাধারণ মানুষ সকলেই যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। পরবর্তীতে যা একটি জনযুদ্ধে রূপ নেয়। আমাদের মা বোনেরা মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ বিভিন্নভাবে যুদ্ধে সহযোগিতা করেছেন।”
সরকার প্রধান বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সকল বাহিনীকে ‘বাংলাদেশ ফোর্সেস’ নামে সাংগঠনিক রুপ দেওয়া হয়। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। মাত্র ২টি গান বোট ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী জলপথে যুদ্ধ শুরু করে। এছাড়াও পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কর্মরত বাংলাদেশি সাবমেরিনার এবং নাবিকদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা অকুতোভয় নৌ কমান্ডোদল ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন নদী বন্দরে খাদ্য ও রসদ বোঝাই শত্রু জাহাজ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বিমান বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত ‘কিলো ফ্লাইট’ চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের জ্বালানি ডিপোসহ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সফল অভিযান পরিচালনা করে। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর এই অবদানকে সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগের সঙ্গে একীভূত করার উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ২১ নভেম্বর পালিত হয় সশস্ত্র বাহিনী দিবস।
“১৯৭১ সালের এই দিনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অকুতোভয় সদস্য এবং বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ সূচনা করে। সেই আক্রমণের ফলে আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয় এবং ফলশ্রুতিতে আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করি।”
স্বাধীনতা যুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী বীর শহিদদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমি আজ গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি স্বাধীনতা যুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী সকল বীর শহিদদের এবং মহান আল্লাহর দরবারে আমি তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
“আমি সকল শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য এবং সম্মানিত যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের এই আয়োজনে আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে যে সকল খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীগণ উপস্থিত আছেন তাদের জন্যেও রইল আমার বিনীত শ্রদ্ধা।“
“মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা চলমান রয়েছে। সময়ের আবর্তে অধিকাংশ বীর মুক্তিযোদ্ধা আজ বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত। সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদ্যাপনকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানানোর ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী যে উদ্যোগ প্রতিবছর নিচ্ছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এ জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত ও অনুপ্রাণিত। নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ ছাত্র-জনতার সাহস ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে সম্প্রতি আমরা অর্জন করেছি, সেটাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যত গড়তে হবে।
“বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ, আহত এবং জীবিত ছাত্র জনতার কাছে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে চাই। যে সুযোগ তারা আমাদের দিয়েছে তার মাধ্যমে আমাদের দেশকে পৃথিবীর সামনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী দেশে পরিণত করতে আমরা শপথ নিয়েছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের উত্তরাধিকারীদের কল্যাণার্থে যা কিছু প্রয়োজন, তা করার জন্য আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ী এবং এ ধারা অব্যাহত থাকবে।”