ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে হামলা করতে যাচ্ছেন, তা আগেই জানতেন মার্কিন সাময়িকী দ্য আটলান্টিকের প্রধান সম্পাদক জেফ্রি গোল্ডবার্গ।
বার্তা আদান-প্রদান অ্যাপ সিগন্যালের একটি গ্রুপ থেকে হামলার বিষয়টি তিনি জানতে পারেন, যা গোল্ডবার্গ নিজেই তার সাময়িকীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সোমবার জানিয়েছেন।
সিগন্যালের ওই গ্রুপে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালজ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, জাতীয় গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ডসহ ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
গত ১৫ মার্চ ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুতিদের ওপর বড় ধরনের সামরিক হামলা চালান ট্রাম্প। এতে কমপক্ষে ৩১ জন নিহত হয়, আহত হয় অনেকে।
গত জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় বসার পর সেদিন প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক অভিযান চালিয়ে হুতিদের হুঁশিয়ার করে ট্রাম্প বলেছিলেন, “তোমাদের সময় শেষ।”
হামলার ৯ দিন পর খবর এল, ট্রাম্প যে ইয়েমেনে হামলা করতে যাচ্ছেন, সেই তথ্য একজন প্রভাবশালী সাংবাদিকের কেবল জানাই ছিল না, হামলার পরিকল্পনা খোদ প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাকে বলেন।
মধ্যপ্রাচ্যে হামলা সংক্রান্ত তথ্য সোমবার ফাঁস হওয়ার পরপরই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গন।
এমন স্পর্শকাতর তথ্য হোয়াইট হাউসের বাইরে গেল কীভাবে, তথ্য যদি অন্য কারও হাতে পড়ত, তাহলে জাতীয় নিরাপত্তা কতটা হুমকির সম্মুখীন হতো, এসব আলোচনায় তোলপাড় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম।
ডেমোক্র্যাট শিবিরও এনিয়ে সমালোচনায় মুখর। তারা এই ঘটনার তদন্ত দাবি করেছে। ডেমোক্র্যাট নেতা চাক শুমার বলেছেন, “সামরিক গোয়েন্দা তথ্য ফাঁসের যত বিস্ময়কর ঘটনা আমি পড়েছি, তার মধ্যে এটি অন্যতম।”
বিবিসি, রয়টার্সসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, গত ১৫ মার্চ ইয়েমেনে হামলার ঘণ্টাখানেক আগে দ্য আটলান্টিকের প্রধান সম্পাদককে ‘অসাবধানতাবশত’ ওই গ্রুপে যুক্ত করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
এরপর ইয়েমেনে হামলা নিয়ে গ্রুপটিতে তারা যেসব চ্যাট করেন, তা পড়ে ফেলেন গোল্ডবার্গ।
গ্রুপে কারা ছিলেন
সিগন্যালের ওই গ্রুপের নাম দেওয়া হয় ‘হুতি পিসি স্মল গ্রুপ’। সেখানে মোট ১৮ জন ছিলেন।
ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ওয়ালজ ছাড়াও গ্রুপটিতে ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, জাতীয় গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড, অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) পরিচালক জন র্যাটক্লিফ, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ, হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ সুসি উইলস এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্টিফেন মিলার।
গ্রুপ চ্যাটে কী লেখা হয়
সোমবার দ্য আটলান্টিকের প্রধান সম্পাদক গোল্ডবার্গ প্রতিবেদনটিতে বলেন, গত ১৩ মার্চ অর্থাৎ ইয়েমেনে হামলার দুদিন আগে তাকে সিগন্যালের ‘হুতি পিসি স্মল গ্রুপ’-এ অপ্রত্যাশিতভাবে যুক্ত করা হয়।
সেখানে উত্তর কোরিয়াবিষয়ক উপসহকারী সচিব অ্যালেক্স এন ওংকে হুতিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ সমন্বয়ের দায়িত্ব দেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালজ।
দ্য আটলান্টিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিগন্যালের গ্রুপটির ফাঁস হওয়া বার্তাগুলোতে ইয়েমেনে হামলার সময় নিয়ে আলোচনা ও উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায় সংশ্লিষ্টদের।
মিশিগানে এক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার মধ্যেই ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স হামলার বিষয়ে গ্রুপে দ্বিধা প্রকাশ করেন।
তিনি লেখেন, “আমি মিশিগানে একটি অর্থনীতিবিষয়ক অনুষ্ঠানে এসেছি। আমার মনে হচ্ছে, আমরা ভুল করতে যাচ্ছি।
“আমি নিশ্চিত নই, প্রেসিডেন্ট এখন ইউরোপ সম্পর্কে যে বার্তা দিচ্ছেন, তার সঙ্গে এটি কতটা অসঙ্গতিপূর্ণ, তা তিনি বুঝতে পারছেন কি না।
“এই হামলা হলে তেলের দাম মাঝারি থেকে আরও অনেক বাড়ার ঝুঁকি আছে।”
গ্রুপে ভাইস প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্য জাতীয় সন্ত্রাসদমন কেন্দ্রের ট্রাম্প মনোনীত রাজনীতিক জো কেন্ট সমর্থন করেন বলে দ্য আটলান্টিকের প্রতিবেদনে বলা হয়।
কেন্ট বলেন, “সময় নিয়ে কোনও তাড়া নেই। এক মাস পরও আমাদের সামনে ঠিক একই বিকল্প থাকবে।”
দ্য আটলান্টিকের প্রতিবেদনে এর প্রধান সম্পাদক ৬৫ বছর বয়সী গোল্ডবার্গ বলেন, “হামলার দিন রাত পৌনে ১২টার দিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ যুদ্ধের পরিকল্পনা আমাকে টেক্সট করেছিলেন। তাই ইয়েমেনে প্রথম বোমা কখন ফেলা হবে, তা আমি জানতাম।
“এছাড়া হামলায় কী পরিমাণ অস্ত্র ব্যবহার করা হবে, কোথায় কোথায় আঘাত হানা হবে, হামলার সময়সংক্রান্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ সব তথ্য আমার জানা ছিল।”
হামলার পর এর প্রশংসা করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ওয়ালজ গ্রুপে লেখেন, “চমৎকার কাজ।” অন্যদিকে সিআইএ পরিচালক জন র্যাটক্লিফ লেখেন, “শুভ সূচনা।”
এছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথের উদ্দেশে লেখেন, “পিট, তুমি আর তোমার দল ভালো কাজ করেছ।”
জেফ্রি গোল্ডবার্গ কে
সাংবাদিকতায় গোল্ডবার্গের ক্যারিয়ার শুরু দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে পুলিশ প্রতিবেদক হিসেবে।
এরপর ২০০৭ সালে দ্য আটলান্টিকে জাতীয় প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন গোল্ডবার্গ। ২০১৬ সালে সাময়িকীটির পঞ্চদশ প্রধান সম্পাদক হন তিনি। তার নেতৃত্বে পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করে দ্য আটলান্টিক।
দ্য আটলান্টিকে যোগ দেওয়ার আগে দ্য নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিনিধি ও পরে ওয়াশিংটন প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেন গোল্ডবার্গ।
এছাড়া ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে (আইডিএফ) কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে গোল্ডবার্গের।