Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

মুক্ত নাবিকরা কাঁদলেন, কাঁদালেন

লাইটার জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটির দিকে এগিয়ে আসছেন নাবিকরা। চোখে-মুখে তাদের বিশ্বজয়ের হাসি। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
লাইটার জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটির দিকে এগিয়ে আসছেন নাবিকরা। চোখে-মুখে তাদের বিশ্বজয়ের হাসি। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন এক মাস আগেই। কিন্তু তখন চারপাশে ছিল ফেনিল সমুদ্র, ছিল রাশি রাশি পানি। তাই চাইলেও পরিবারের সদস্যদের কাছে ছুটে যাওয়া সম্ভব ছিল না। সম্ভব ছিল না বাবার কোলে সন্তানের ঝাঁপিয়ে পড়ার কিংবা মায়ের বুকে ছুটে যাবার।

মঙ্গলবার যখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা হলো ২৩ নাবিকের, তখন কেউই নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি। আবেগ আপ্লুত অনেকেই কাঁদতে শুরু করেন।

সোমবার সন্ধ্যায় কুতুবদিয়ায় নোঙর করেছিল বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। সেখান থেকে নাবিকদের নিয়ে লাইটার জাহাজ জাহান মনি-৩ এ মঙ্গলবার বিকাল ৪টার কিছু আগে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি-১) জেটিতে পৌঁছায়।

এই কান্না আনন্দের, এই কান্না প্রিয়জনকে ছুঁতে পারার। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
এই কান্না আনন্দের, এই কান্না প্রিয়জনকে ছুঁতে পারার। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

আগে থেকেই জেটিতে উপস্থিত ছিলেন নাবিকদের পরিবারের সদস্য-স্বজনরা। জাহাজ থেকে নাবিকরা জেটিতে পা রাখতেই সেখানে তৈরি হয় আবেগঘন পরিবেশ।

এমভি আবদুল্লাহর চিফ অফিসার ক্যাপ্টেন মো. আতিক উল্লাহ খানকে জাহাজ থেকে নামতে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরতে দৌড় দেয় তার দুই সন্তান ইয়াশরা ও উনাইজা।

দীর্ঘ দুই মাস পর বাবাকে কাছে পেয়ে আনন্দে উদ্বেল ছিল তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া ইয়াশরা। সে বলল, “বাবার জন্য পুরো ঘর খালি ছিল। ঈদটাও ভালোভাবে কাটাতে পারিনি, কতদিন ঘুমাতে পারিনি। কখন বাবা আসবে, বাবাকে দেখতে পাব; মায়ের কাছে সবসময় এসবই জিজ্ঞেস করতাম।”

পরীক্ষা শেষে বাবাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে বলেও পরিকল্পনার কথা জানাল সে।

বাবাকে ফিরে পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে দুই শিশু কন্যা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
বাবাকে ফিরে পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে দুই শিশু কন্যা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

ক্যাপ্টেন আতিক উল্লাহ খান বললেন, “বীভৎস সেই দিন থেকে আমরা এখন আলোর দিনে ফিরেছি। দুঃসহ সেই স্মৃতির কথা আর মনে করতে চাই না। ট্রমা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। আপনারা দোয়া করবেন। দুই সন্তানকে কাছে পেলাম। বাসায় আরেক সন্তান কাঁদছে। তার কাছে ফিরতে হবে দ্রুত।”

জেটি চত্বরে কথা হয় এমভি আবদুল্লাহর চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমেদের মা জ্যোৎস্না বেগমের সঙ্গে।

তিনি বললেন, “আজকে ঈদের খুশির চেয়ে বেশি আনন্দ হচ্ছে। ছেলে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকার ৩৩ দিন যে কীভাবে কেটেছে, তা ব্যাখ্যা করতে পারব না। এখন ছেলেকে কাছে পাব, এর চেয়ে আর বড় সুখ কী হতে পারে!”

নাবিকদের পেয়ে স্বজনরা যেমন কেঁদেছেন, সন্তান বা মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন জিম্মিদশা থেকে নতুন জীবন ফিরে পাওয়া নাবিকরাও।

ঘরে ফেরার আনন্দে উদ্বেল নাবিকরা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
ঘরে ফেরার আনন্দে উদ্বেল নাবিকরা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

দেশের মাটিতে নাবিকদের লাল গালিচা সংবর্ধনা দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, সচিব ওমর ফারুক, কেএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক সরওয়ার জাহান রোকন, শাহরিয়ার জাহান রাহাত ও  এস আর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম।

নাবিকদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন তারা।

কেএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, “নাবিক ভাইয়েরা আমাদের কাছে ফিরে এসেছেন, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। নিরাপদে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে আনাটা অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। আজ আমরা অনেক খুশি। জিম্মি হওয়ার পর থেকে মুক্তি পাওয়া এবং দেশে ফিরে আসা—পর্যন্ত সব কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আমরা সবার কাছে কৃতজ্ঞ।”

ভিডিও কনফারেন্সে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আন্তর্জাতিক সব সংস্থার পরামর্শ ছিল বলপ্রয়োগ করে এমভি আবদুল্লাহ ও নাবিকদের মুক্ত করার। তাদের পরামর্শমতে যদি জলদস্যুদের ওপর বলপ্রয়োগ করা হতো তাহলে সব নাবিককে অক্ষত পাওয়া যেত কিনা সেটি ছিল বড় প্রশ্ন।”

কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “কেএসআরএম কর্তৃপক্ষও বলপ্রয়োগের বিপক্ষে ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন শান্তিপূর্ণভাবে এ সমস্যার সমাধান করার জন্য।”

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দেশের মাটিতে পা রাখছেন এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দেশের মাটিতে পা রাখছেন এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

এসময় কেএসআরএম কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান মন্ত্রী। বলেন, কোম্পানিটি তাদের নাবিকদের সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেই জোর দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত কোনও ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই নাবিকদের ফেরানো সম্ভব হয়েছে। এটি সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলেই সম্ভব হয়েছে।

গত ১২ মার্চ মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়া বন্দরে যাওয়ার পথে সোমালিয়া দস্যুদের হাতে জিম্মি হয় এমভি আবদুল্লাহ। দেন-দরবার শেষে ৩২ দিন পর মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত হন নাবিকরা।

এরপর জাহাজটি দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরে গিয়ে পণ্য খালাস করে। সেখানে খালাস শেষে মিনার সাকার বন্দরে গিয়ে নতুন পণ্য বোঝাই করে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় এমভি আবদুল্লাহ।

সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের জলসীমায় পৌঁছার পর জাহাজেই রাত কাটান নাবিকরা।

রপর চট্টগ্রাম উপকূল থেকে এমভি জাহান মণি-৩ নামের একটি লাইটার বা ছোট জাহাজ নতুন নাবিকদের নিয়ে এমভি আবদুল্লায় যায়। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিকাল ৪টায় চট্টগ্রামে ফেরেন নাবিকরা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত