ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সেজন্য ইতোমধ্যে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়েছে। বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে কিছু সংশোধনী আনার খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে।
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্য সরাসরি সম্প্রচার নয়, রেকর্ড করে প্রচার করা যাবে। তবে বিচারের পক্ষগুলো যারা আছে তাদের ডিগনিটি, প্রাইভেসি ও যেসব অধিকার রয়েছে সেগুলো নজর রেখে সেটা করা হবে।
বাসস জানিয়েছে, বুধবার সন্ধ্যায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রেফিং এ কথা জানান তিনি। এর আগে সকালে সচিবালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের ত্রয়োদশ বৈঠকে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, আজ ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নতুন আইনে ট্রাইব্যুনাল ইচ্ছে করলে (বাধ্যতামূলক না) বিচারকার্য অডিও ভিজ্যুয়াল রেকর্ড করে প্রচার করতে পারবে। ওনারা যদি মনে করেন, এটা প্রচার করা দরকার তাহলে সেই অংশ প্রচার করতে পারবেন।
তিনি বলেন, এ বিচারটি যেন আন্তর্জাতিক মানের হয় সেজন্য দেশি-বিদেশি আইনজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের মতামত নিয়েই সংশোধন করা হয়েছে। এ্ই আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সবার সমান সুযোগ থাকবে। ১৯৭৩ সালের আইনের সাথে মিলিয়ে দেখবেন, নতুন আইনের অভিযুক্তদের বেশি সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যেকোনও পক্ষ চাইলে তারা সাক্ষ্য আনতে পারবেন। সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন।
আসিফ নজরুল বলেন, আইনে ভিকটিমের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। যারা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেবেন বা যেকোনও উপায়ে সাক্ষ্য দিতে আসবেন সবার নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই আইনে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের কম্পেনসেশনের বিধান করা হয়েছে।
এই আইনের তিন বাহিনীকে বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আসামি পক্ষ বা ডিফেন্স ফোর্স যেকেউ চাইলে আন্তর্জাতিক আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবেন। এই আইনের নতুন একটি চমৎকার বিধান হয়েছে যে, পর্যবেক্ষক নিয়োগের বিধানের স্পষ্ট করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বা দেশি যেকোনও মানবাধিকার সংগঠন যেকেউ চায় এই বিচারকার্য পযবেক্ষণ করতে পারবে। বিচার কাজ শুদ্ধ হচ্ছে কিনা, সঠিকভাবে হচ্ছে নাকি- উপস্থিত থেকে মনেটরিং করতে পারবে।
আসিফ নজরুল জানান, খসড়াটি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ, দপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়, মানবাধিকার কর্মী, মানবাধিকার সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, আন্তর্জাতিক আইনে বিশেষজ্ঞ এবং অংশীজনের সঙ্গে বিভিন্ন সভা হয় এবং তাদের মতামত ও পরামর্শ পর্যালোচনা করে আইন ও বিচার বিভাগ প্রণীত খসড়ায় সংযোজন ও পরিমার্জন করা হয়েছে।
যেহেতু সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় রয়েছে এবং গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের আওতাধীন অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের লক্ষ্যে বিদ্যমান আইন যুগোপযোগীকরণের বিষয়ে আশু ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে, সেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ শীর্ষক অধ্যাদেশের খসড়া উপদেষ্টা পরিষদের নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়।
পরে বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয় সরকার এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। এরপর বিভিন্ন সময় দলটির অনেক নেতা দেশের বাইরে চলে গেছেন, অনেকে ধরা পড়েছেন।
আওয়ামী লীগের টানা তিন বারের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কোথায় আছেন সে বিষয়ে এতোদিন সঠিক কোনও তথ্য ছিল না। তিনি এক সপ্তাহ আগে ভারত গেছেন বলে বুধবার দাবি করেছেন দলটির এক কেন্দ্রীয় নেতা।
জুলাই আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দুই মামলায় গত ১৭ অক্টোবর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা এবং দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
সেই আদেশে নির্ধারিত তারিখ গত ১৮ নভেম্বর সোমবার সকালে ১৩ আসামিকে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে দুটি প্রিজন ভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। শুনানি শেষে তাদেরকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারাগারে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এই আসামিরা হলেন- সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মন্ত্রী ফারুক খান, দীপু মনি, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, শাজাহান খান, গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার ও জুনাইদ আহমেদ পলক, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সাবেক প্রধানন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী ও সালমান এফ রহমান এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর আলম।
গত ১৮ নভেম্বর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল তাদের কারাগারে রাখার ওই আদেশ দেয়।
সেদিন শেখ হাসিনাসহ সব আসামির বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির’ অভিযোগও আনা হয়। সেই অভিযোগের তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার থাকা আরেক আসামি সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক টাঙ্গাইলে একটি মামলায় পুলিশ হেফাজতে থাকায় তাকে উপস্থিত করা হয়নি।
প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাতে প্রসিকিউশন থেকে ইন্টারপোলে আবেদন জানানোর পাশাপাশি এ বিষয়ে ভারতের কাছে বহিঃসমর্পণ চুক্তির আওতায় সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে আদালতকে জানিয়েছেন প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে। তবে তাতে নয়া দিল্লি কোনও সাড়া দিচ্ছে না। এনিয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও টানাপড়েন চলছে।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেখানে বিচারে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামীর সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচ্য ছিল ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’।
বিচারে গোলাম আযমের ৯০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। সেই সাজা খাটার সময় কারাগারেই তার মৃত্যু ঘটে। জামায়াতের সাবেক আরেক আমির নিজামীর মৃত্যুদণ্ড হয়।
গোলাম আযমের মামলার রায়ে বলা হয়েছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের কোনও ঘটনাস্থলে আসামি উপস্থিত ছিলেন, এমন প্রমাণ নেই। এখানে তার দায় সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির। কারণ এটা স্বীকৃত যে গোলাম আযম ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির ছিলেন। তিনি শান্তি কমিটির প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তাই জামায়াতের সদস্যরা প্যারামিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দিয়ে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, নির্যাতন, ধর্ষণসহ যেসব অপকর্ম করেছিলেন, এসব অপরাধের দায়-দায়িত্ব তার।
মতিউর রহমান নিজামীকেও বুদ্ধিজীবী হত্যায় একাত্তরে আল বদর বাহিনীর প্রধান হিসাবে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি হিসাবে দোষি সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পাওয়া তাজুল তখন জামায়াত নেতাদের আইনজীবী ছিলেন।