বর্তমানের অনেকে এখন ভবিষ্যৎ দেখছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায়; সেই পথটি আরও সহজ করার পথের নির্দেশকরা পেলেন এবার পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল।
কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ‘মেশিন লার্নিংকে’ বা যন্ত্রকে শেখাতে মৌলিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের জন্য এ বছরের পুরস্কার ঝুলিতে পুরলেন জন জে হপফিল্ড ও জেফ্রি ই হিন্টন।
এদের একজন আমেরিকান, আরেকজন ব্রিটিশ। হপফিল্ড যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক; হিন্টন আছেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোয়।
মঙ্গলবার রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্স এই বছর পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেলজয়ী হিসাবে এই দুই বিজ্ঞানীর নাম ঘোষণা করে। যৌথভাবে জয়ী হওয়ায় তারা পুরস্কারের ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনা সমানভাবে ভাগ করে নেবেন।
এই দুই বিজ্ঞানী পদার্থবিদ্যার সরঞ্জাম ব্যবহার করে এমন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন, যা মেশিন লার্নিংয়ের ভিত্তি স্থাপন করেছে। জন হপফিল্ড একটি ‘সংযুক্ত মেমোরি’ তৈরি করেছেন। এর মাধ্যমে তথ্য সংরক্ষণ ও ছবির পুনর্গঠন করা যায়।
আর জেফ্রি হিন্টনের উদ্ভাবিত পদ্ধতি তথ্যের মধ্য থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে পারে। পাশাপাশি ছবির নির্দিষ্ট উপাদানগুলোকে চিহ্নিত করতে সক্ষম।
কম্পিউটার কীভাবে বিভিন্ন ভাষা অনুবাদ, ছবির ব্যাখ্যা ও যুক্তিযুক্ত আলাপসহ বিভিন্ন কাজ করতে পারে, বিষয়টি জানার প্রতি আগ্রহ বহু মানুষের। বিপুল পরিমাণ তথ্যের শ্রেণীকরণ ও বিশ্লেষণসহ বিভিন্ন গবেষণা ক্ষেত্রে এমন প্রযুক্তির গুরুত্ব দীর্ঘকাল ধরেই স্বীকৃত।
কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক নামের কাঠামোর মাধ্যমে গত ১৫ থেকে ২০ বছরে মেশিন লার্নিংয়ের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। বর্তমানে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ বলতে সাধারণত এই ধরনের প্রযুক্তিকেই বোঝায়।
কম্পিউটার চিন্তা করতে না পারলেও মেমোরি ও লার্নিংয়ের মতো কার্যকলাপ অনুকরণের ক্ষমতা এখন আছে। এই বছরের পদার্থবিদ্যায় বিজয়ীদের গবেষণার ফলে এটি সম্ভব হয়েছে। নেটওয়ার্কের কাঠামোকে তথ্য প্রক্রিয়াকরণের কাজে লাগানোর জন্য তারা পদার্থবিদ্যার মৌলিক ধারণা ও পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন।
মেশিন লার্নিং ও প্রথাগত সফটঅয়্যারের কাজের পদ্ধতি ভিন্ন। প্রথাগত সফটঅয়্যার একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় কাজ করে। এটি ডেটা গ্রহণ করে, সেই অনুযায়ী তা প্রক্রিয়া করে ফলাফল দেয়। অনেকটা রেসিপি অনুসারে কেক তৈরির মতো ব্যাপার।
আর মেশিন লার্নিংয়ে কম্পিউটার উদাহরণের মাধ্যমে শেখে। ফলে এটি এমন সমস্যা সমাধান করতে পারে, যা ধাপে ধাপে নির্দেশনার মাধ্যমে পরিচালনা করা খুবই জটিল।
মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে, সেই জ্ঞান অর্জনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের উদ্ভাবন। এই নেটওয়ার্কে সম্পূর্ণ কাঠামো ব্যবহার করে তথ্য প্রক্রিয়ায়ণ হয়। চল্লিশের দশকে গবেষকরা মস্তিষ্কের নিউরন ও সিন্যাপসের নেটওয়ার্কের গাণিতিক ভিত্তি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। সিন্যাপস হলো একটি জৈবিক কাঠামো, যা দুটি নিউরনের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে এবং এদের মধ্যে তথ্য পাঠানোর অনুমতি দেয়।
হপফিল্ড ও হিন্টনের অবদান
আশির দশক থেকে শুরু করে জন হপফিল্ড ও জেফ্রি হিন্টনের অবদানের ফলে ২০১০ সাল থেকে মেশিন লার্নিং অনেক দূর এগিয়েছে। বিপুল পরিমাণ ডেটা ব্যবহার করে নেটওয়ার্কগুলোকে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও কম্পিউটিং ক্ষমতার অভূতপূর্ব অগ্রগতি এই উন্নয়নের পেছনের প্রধান কারণ।
আধুনিক কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কগুলো সাধারণত বহু স্তরবিশিষ্ট ও বিশাল আকারের। এসব নেটওয়ার্ককে ডিপ নিউরাল নেটওয়ার্ক বলা হয়। আর এগুলোকে প্রশিক্ষণের পদ্ধতিকে বলা হয় ডিপ লার্নিং।
১৯৮২ সালে হপফিল্ডের ‘সংযুক্ত মেমোরি’ সম্পর্কিত নিবন্ধে মেশিন লার্নিংয়ের উন্নয়নের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পাওয়া যায়। সেখানে তিনি ৩০টি নড (নেটওয়ার্কের মৌলিক একক) বিশিষ্ট একটি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেছিলেন। প্রতিটি নড শুধু দুটি মান ধারণ করতে পারত – শূন্য বা এক। এই নডগুলোকে একটি সাদাকালো ছবির পিক্সেলের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
সবগুলো নড একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকলে মোট ৪৩৫টি সংযোগ স্থাপিত হয়। সংযোগগুলোর শক্তি ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় মোট ৫০০ এর কম প্যারামিটারের হিসাব রাখার প্রয়োজন হয়।
হপফিল্ড এক্ষেত্রে ১০০টি নডবিশিষ্ট একটি নেটওয়ার্ক ব্যবহারের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন কম্পিউটারের সীমিত ক্ষমতার কারণে তিনি সফল হননি। বর্তমানে যেসব বৃহৎ ভাষা মডেল তৈরি হচ্ছে, সেগুলোতে এক ট্রিলিয়নেরও বেশি প্যারামিটার ব্যবহার করা হয়।
হপফিল্ড নেটওয়ার্কের কার্যপ্রণালীকে একটি বলের গতির সঙ্গে তুলনা করেছেন। যেমন, একটি বল যদি একটি পাহাড়ের উপরে রাখা হয়, তাহলে সেটি নিচের দিকে গড়িয়ে যাবে। যদি নেটওয়ার্ককে একটি প্যাটার্ন দেওয়া হয় যা সংরক্ষিত প্যাটার্নগুলোর একটির কাছাকাছি থাকে, তাহলে এটিও একইভাবে এগিয়ে চলবে যতক্ষণ না এটি তলদেশে পৌঁছায়। ফলে এটি তার মেমোরিতে নিকটতম প্যাটার্ন খুঁজে পাবে।
মেশিন লার্নিংয়ের ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমানে ব্যাপক গবেষণা চলছে। কোন প্রয়োগ সবচেয়ে কার্যকর হবে তা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। পাশাপাশি এই প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহারের ফলে যে নৈতিক দিকগুলো উঠে আসে, সেগুলো নিয়েও বিস্তৃত আলোচনা চলছে।
পদার্থবিদ্যা মেশিন লার্নিং উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আকর্ষণীয় বিষয় হল, পদার্থবিদ্যা নিজেই এখন কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক থেকে উপকৃত হচ্ছে। মেশিন লার্নিং সেসব ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত হয়ে আসছে, যেখানে অতীতে পদার্থবিদ্যায় নোবেল দেওয়া হয়েছে।
হিগস কণা আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণে মেশিন লার্নিংয়ের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কৃষ্ণগহ্বর থেকে আগত মহাকর্ষীয় তরঙ্গের পরিমাপে শব্দ কমানো এবং এক্সোপ্ল্যানেট অনুসন্ধানের মতো ক্ষেত্রেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
অণু ও পদার্থের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় ও পূর্বাভাসের জন্য মেশিন লার্নিং ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। উদাহরণ হিসেবে, প্রোটিন অণুর গঠন নির্ণয় করা এবং একটি পদার্থের নতুন সংস্করণগুলোর মধ্যে কোনটি সৌর কোষের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হতে পারে, তা নির্ণয়েও মেশিন লার্নিং ব্যবহৃত হচ্ছে।
হপফিল্ড যখন ‘সংযুক্ত মোমোরি’ সম্পর্কিত গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন, তখন হিন্টন যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গের কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত ছিলেন। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে পরীক্ষামূলক মনোবিজ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে পড়ার পর তিনি ভাবতে শুরু করেন, মানুষের মতো করে যন্ত্র তথ্যের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্যাটার্ন চিনতে এবং তাদের নিজস্ব শ্রেণিবিন্যাস করতে শিখতে পারে কি না?
হিন্টন তখন সহকর্মী টেরেন্স সিজেনোস্কির সহযোগিতায় হপফিল্ড নেটওয়ার্ককে ভিত্তি করে নতুন এক ধরনের নেটওয়ার্ক তৈরি করেন এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার ধারণাগুলোকে এতে প্রয়োগ করেন।
তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা অনেকগুলো একই রকম উপাদান নিয়ে গঠিত ব্যবস্থা। যেমন গ্যাসের অসংখ্য অণুকে পৃথকভাবে পর্যবেক্ষণ করা কার্যত অসম্ভব। তবে সামষ্টিকভাবে বিবেচনা করে গ্যাসের চাপ, তাপমাত্রা ইত্যাদি মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্ণয় করা সম্ভব। একই সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জনে গ্যাসের অণুগুলো বিভিন্ন বেগে তার আয়তনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমন অসংখ্য সম্ভাব্য উপায় রয়েছে।
বিভিন্ন উপাদানের যৌথ অবস্থাকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্যে বিশ্লেষণ করা যায়। পাশাপাশি তাদের ঘটনার সম্ভাবনা গণনা করা যায়। কোনও ব্যবস্থার বিভিন্ন অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা সমান হয় না। কোনও অবস্থা সৃষ্টির সম্ভাবনা তার উপলব্ধ শক্তির পরিমাণের উপর নির্ভর করে।
উনিশ শতকের বিজ্ঞানী লুডভিগ বল্টজমান এই সম্পর্ককে একটি সমীকরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। হিন্টন যে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন, সেটি বল্টজমানের সমীকরণের উপর ভিত্তি করে কাজ করত। এই নেটওয়ার্ককে ১৯৮৫ সালে ‘বল্টজমান মেশিন’ নামে নামকরণ করা হয়।
তবে ১৯৯০ এর দশকে অনেক গবেষক কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু হিন্টন এক্ষেত্রে কাজ চালিয়ে গেছেন। তিনি ও তার সহকর্মীরা ২০০৬ সালে একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এর মাধ্যমে একটি নেটওয়ার্ককে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে একাধিক বল্টজমান মেশিনকে ব্যবহার করা হয়। এই প্রশিক্ষণের ফলে নেটওয়ার্কের সংযোগগুলো একটি স্থিতিশীল অবস্থা পায়। এটি ছবির উপাদানগুলো চিনতে নেটওয়ার্কের প্রশিক্ষণকে আরও দক্ষ করে তোলে।
বল্টজমান মেশিনকে একাধিক বল্টজমান মেশিন নিয়ে গঠিত একটি বৃহত্তর নেটওয়ার্কের উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এমন বৃহত্তর নেটওয়ার্ক বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। যেমন দর্শকদের পছন্দের ভিত্তিতে চলচ্চিত্র বা টেলিভিশন সিরিজ সুপারিশ করা।
তথ্যসূত্র : নোবেলপ্রাইজ ডট ওআরজি