আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে জেঁকে বসা দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা দূর করতে এরই মধ্যে ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যে সংস্কারের রূপরেখা পাওয়া যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। কিন্তু কেমন ক্রীড়াঙ্গন দেখতে চান সবাই, সাঁতার ফেডারেশনে কতটা সংস্কার প্রয়োজন, সে সব নিয়েই কথা বলেছেন এসএ গেমসে পদকজয়ী জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত সাঁতারু লায়লা নূর।
সকাল সন্ধ্যা : বিগত সময়ের অনিয়ম দূর করে ক্রীড়াঙ্গনের সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সার্চ কমিটির সদস্যরা ধারাবাহিকভাবে মত বিনিময় সভা করছেন ফেডারেশনের কর্মকর্তা, খেলোয়াড়, কোচ ও রেফারিদের সঙ্গে। একজন সাবেক ক্রীড়াবিদ হিসেবে আগামীর ক্রীড়াঙ্গনকে কেমন দেখতে চান?
লায়লা নূর: ক্রীড়াঙ্গনে এতদিন অনেক অনিয়ম চলেছে। তথাকথিত সংগঠকরা নিজেদের সুবিধামতো ফেডারেশন চালিয়েছে। খেলোয়াড়দের কার্যনির্বাহী কমিটিতে সেভাবে সুযোগ দিত না। একটা কমিটি হলে সেখানে খেলোয়াড়ের চেয়ে অন্যরা বেশি সুযোগ পেত। এবং যারা ভালো মানের খেলোয়াড় তারা এটা নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় ক্রীড়াঙ্গন ছেড়ে চলে যান। অথচ তারা অনেক কিছু দিতে পারত ক্রীড়াঙ্গনকে। সেই চর্চা থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ এসেছে। সার্চ কমিটি উদ্যোগ নিয়েছে। এরা যদি ভালোভাবে কাজ করে তাহলে খেলোয়াড়রাও যে ভালো সংগঠক হতে পারে, সেটা দেখানোর সুযোগ পাবে।
সকাল সন্ধ্যা : অতীতে ফেডারেশনগুলোর নির্বাচনে পেশি শক্তির জয় হয়েছে, বিনা ভোটে পাস করেছেন কর্মকর্তারা। নির্বাচনের নামে এতদিন যা হয়েছে, তা নিয়ে কী বলবেন?
লায়লা : নির্বাচন এলে হতাশ হয়ে পড়তাম। কারণ যারা নির্বাচন করতো তারা পেশি শক্তি, রাজনৈতিক শক্তি, টাকার শক্তি দিয়ে এমনভাবে ক্রীড়াঙ্গনের বলয় তৈরি করে রাখত যে আমরা তাদের বিরুদ্ধে যেতে পারতাম না। আমি যদিও অনেকবার চেষ্টা করেছি। একজন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ও এসএ গেমস পদকজয়ী হয়েও তাদের পেছনে দৌড়াতে খারাপ লাগত। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। শেষ পর্যন্ত লড়েছি। কারণ এটা আমাদের জায়গা। শেষ পর্যন্ত যখন আমাকে থামাতে পারত না, তখন আমার স্বামীকে হুমকি দেওয়া হতো। এটা খুব লজ্জাজনক ব্যাপার যে তারা আমার স্বামীকে হুমকি দিয়ে বলত- আপনার স্ত্রীকে থামান, না হলে আপনার বাচ্চাকে উঠিয়ে নিয়ে যাব। এখন যেন এমনটা না হয়, সেই প্রত্যাশা থাকবে।
সকাল সন্ধ্যা : হ্যান্ডবল, বাস্কেটবল, কুস্তি, তায়কোয়ান্দো, ভলিবল, সাঁতার- অনেক ফেডারেশনে দীর্ঘ মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক আছেন। অভিযোগ রয়েছে, যাদের কাজই হলো চেয়ার আঁকড়ে ধরে রাখা। বিষয়টা কীভাবে দেখেন?
লায়লা : যারা বছরের পর বছর চেয়ার আঁকড়ে ধরে রাখে, তারা কিছু করতে পারেনি, পারবেও না। কারণ তাদের কোনও পরিকল্পনা নেই, ছিল না। বিশ্বের অন্য কোনও দেশে এমন উদাহরণ দেখিনি আমি। ভারত, শ্রীলঙ্কায়ও এমন নেই। ১৫-১৬ বছর দায়িত্বে থাকলে তো সোনা ফলা করার কথা!
সকাল সন্ধ্যা : সাঁতারের প্রসঙ্গেই আসি। ২০১৬ সালের পর থেকে এসএ গেমসে সাঁতারে কোনও সোনা জেতেনি বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের সাঁতারের অবস্থা কেমন?
লায়লা : বাংলাদেশের সাঁতার তলানিতে চলে গেছে। কারণ মোশাররফ হোসেন খান বা অন্যরা যখন সোনা জিততেন, তখন ভারতের কাছাকাছি টাইমিং থাকত বাংলাদেশের। কিন্তু এত বছরে বাংলাদেশ আরও পিছিয়েছে টাইমিংয়ে। আর ভারত এখন চীনের সঙ্গে লড়াই করে। এশিয়ান গেমসে সোনা জেতে।
সকাল সন্ধ্যা : কেন এমনটা হচ্ছে?
লায়লা : এই যে সাঁতারের কমিটি, এরা নিজেরা নিজেদের মতো করে তৈরি করে। উন্নতি তো হয়নি, বরং সাঁতার ধ্বংস করে একেবারে শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কর্মকর্তাদের দরকার দেশের বাইরে ট্যুর করা, পাসপোর্ট ভারী করা। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক (মোল্লা বদরুল সাইফ) কবে পাসপোর্ট বানিয়েছে, সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে আমার। কিন্তু সাঁতারে আসার পর থেকে এত বেশি দেশ সফর করেছে, মনে হয় একাধিক পাসপোর্ট হয়ে গেছে উনার। তাদের দরকার সাঁতারুদের বাইরে নিয়ে যাওয়া, তাদের রেজাল্ট দরকার হয় না।
সকাল সন্ধ্যা : ফেডারেশন ২০১৮ সালে ‘সেরা সাঁতারুর খোঁজে’ কর্মসূচীর আয়োজন করেছিল। সেখান থেকেও তো প্রতিভাবান সাঁতারু সেভাবে উঠে আসেনি যারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলো কেড়েছেন।
লায়লা : ওই সময়ের নৌবাহিনী প্রধানের (সাঁতার ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি) সঙ্গে নিজে অনেক সভা-আলোচনার করে এই কর্মসূচীটা আমরা করেছিলাম। কিন্তু ষড়যন্ত্র করে আমাকে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়। সবচেয়ে বেশি বাজেটের কর্মসূচি ছিল ওটা। অথচ সেখানে তারা সাঁতারুদের যত্ন নেয়নি, ভালো কোচ নেয়নি। নিজেদের পছন্দের কোচ নিয়ে ট্রেনিং করিয়েছে। যার ফলে প্রত্যাশামতো রেজাল্ট পায়নি। এতে যে পরিমাণ খরচ হয়েছে, তত ভালো রেজাল্ট আনতে পারেনি। এই ব্যর্থতার দায় কে নেবে?
সকাল সন্ধ্যা : সাঁতাদের দীর্ঘদিন বিদেশি কোচ নেই? আপনি কি মনে করেন কোনও সিন্ডিকেট কাজ করে এর পেছনে?
লায়লা : ফেডারেশনে কোচ নামধারী সহ-সভাপতি আছেন (আবদুল হামিদ)। উনি কোনও কোচ আনতে দেয় না। সর্বশেষ যে একজন কোচ এসেছিল (জাপানি কোচ তাকিও ইনাকি), তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। দেশ ছাড়ার সময় সে এতটাই রেগে গিয়েছিল যে ফিনাতে অভিযোগ করার কথা বলেছিল। এখানে একজন কোচ একাই পান ৪০-৫০ হাজার টাকা। কিন্তু অন্যরা ১০ হাজারও পায় না পারিশ্রমিক। সাধারণ সম্পাদক নিজের চেয়ার ধরে রাখার জন্য অনিয়মগুলো দেখেও না দেখার ভান করতো। উনি রেজাল্ট ম্যানুপুলেট করতো। কেউ প্রথম হলে তাকে দ্বিতীয় বানিয়ে দেওয়া হতো। ওয়াটারপোলোতেও এমন হয়েছে। তাদের পছন্দের একজনের ক্লাবকে ওঠাতে এই অনিয়ম করতো। এগুলো দুঃখজনক। দুই বেলা কঠোর অনুশীলন করা একজন সাঁতারু রেজাল্টের সময় এমনটা দেখলে এর চেয়ে কষ্টের আর কিছু হতে পারে না।
সকাল সন্ধ্যা : সার্চ কমিটির কাছে নতুন কমিটির জন্য বেশ কিছু তালিকা জমা পড়েছে। আপনিও সেখানে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। আপনি দায়িত্ব পেলে সাঁতারের উন্নতিতে কী কী উদ্যোগ নেবেন?
লায়লা : দেখুন এমন সুযোগ পেলে অবশ্যই কাজে লাগাব। প্রথমে কোচেস প্যানেল তৈরি করব। ‘এ’ গ্রেড, ‘বি’ গ্রেড, ‘সি’ গ্রেড সাঁতারুদের নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা থাকবে। জেলা ও বিভাগে প্রতি জায়গায় ট্রেনিং প্রোগ্রাম করব। শুধু প্রতিভা অন্বেষণ না করে অঞ্চল ভেদে যদি ট্রেনিং ক্যাম্প করি ও সেখান থেকে কোচ নিয়োগ দিলে অনেক উন্নতি হবে। আমাদের সাঁতারুরা সারা বছর ট্রেনিং করার সুযোগ পায় না। তাদের বসিয়ে রাখলে পারফরম্যান্স জিরো হয়ে যায়। প্র্যাকটিসের বিকল্প নেই। তাই সারা বছর অনুশীলনে রাখতে চাইব সাঁতারুদের।
সকাল সন্ধ্যা : মিরপুর সুইমিং পুলে ৫ কোটি টাকা দিয়ে কেনা ইলেকট্রনিকস স্কোরবোর্ড অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এতে ফেডারেশনের সাংগঠনিক ব্যর্থতা কতটুক?
লায়লা : দায় এনএসসি ও ফেডারেশনের দুই পক্ষেরই। কিন্তু দিনশেষে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাঁতারুরা। ফিনাতে বর্তমানে ক্যামেরার মাধ্যমে টাইমিং ধরা হয়। কিন্তু এখনও আমরা ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড নিয়ে যুদ্ধ করছি। হ্যান্ড টাইমিংয়ে সাঁতারের আয়োজন করছি।