বাংলাদেশে ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারের চাহিদা রয়েছে বছরে ১৬ লাখ টন, যার মধ্যে ১ লাখ টন সরবরাহ দিয়ে থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (ডিএপিসিএল)।
তবে কাঁচামাল সংকটে দুই মাস ধরে বন্ধ কারখানাটির দুটি ইউনিটের কার্যক্রম; একই কারণে ধুঁকছে বাকি একটি ইউনিটও। এ পরিস্থিতিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এই প্রতিষ্ঠানের ডিএপি সার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে।
ডিএপিসিএলের সার উৎপাদন সক্ষমতা দিনে ১৬০০ টন। তবে এক মাস ধরে ৮০০ টনের দ্বিতীয় ইউনিটটি উৎপাদন করছিল দিনে ৩০০ টন। এখন গুদামে কাঁচামাল মজুদ কমে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে; যা দিয়ে সর্বোচ্চ আর দুদিন উৎপাদন সচল রাখা যাবে।
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে আনোয়ারা এলাকায় অবস্থিত দেশের একমাত্র এই কারখানা থেকে বছরে এক লাখ টন ডিএপি সার উৎপাদন হয়। তবে সরকারি ইউরিয়া সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিইউএফএলের বয়লার ব্যবহার করেই তাদের উৎপাদন সচল রাখতে হয়। ফলে সিইউএফএল সচল থাকলে ডিএপি সার কারখানা বন্ধ রাখতে হয়। এসব কারণে কারখানাটি লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি উৎপাদন করতে পারছে না।
এখন কাঁচামালের জোগান নিশ্চিত না হলে দুদিন পরই সরকারি এই কারখানার উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে সার সরবরাহে সংকট তৈরি হবে; যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের কৃষি পণ্য উৎপাদনে।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন এই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের ভিত্তিতেই কাঁচামাল পায় ডিএপি সার কারখানা। কাঁচামাল সংকটের বিষয়টি তাদের জানানো হলেও এখন পর্যন্ত অনুমোদন মেলেনি। ফলে বন্ধ থাকবে এই কারখানা।
ডিএপি সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিসিআইসি আজকে কাঁচামাল আমদানির অনুমোদন দিলেও আমদানি করে সেই পণ্য কারখানায় পৌঁছতে অন্তত আড়াই মাস সময় লাগবে। ফলে ততদিন পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধ রাখতে হবে।
“এর চেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে- পাশে থাকা সিইউএফএল কারখানা সচল থাকলে আমাদের ডিএপি সার কারখানার উৎপাদন বাধ্য হয়েই বন্ধ রাখতে হয়। অন্তত তিন বছর ধরেই এই অবস্থা চলে আসছে। ফলে কাঁচামালের জোগান নিশ্চিত হলে আমাদের সিইউএফএলের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়।”
“এই সমস্যা সমাধানে গত সপ্তাহে ডিএপি সার কারখানা স্বনির্ভর করতে একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে বিসিআইসি। সেই অনুমোদন পেয়ে দরপত্র ডেকে কাজ শুরু করে নিজস্ব বয়লার দিয়ে কারখানা নতুনভাবে চালু করতে আরও আড়াই বছর লাগবে। ততদিন পর্যন্ত এভাবেই আমাদের চলতে হবে ” যোগ করেন মোস্তাফিজুর।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা শাখার হিসাবে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৬ লাখ মেট্রিক টন ডিএপি সারের চাহিদা রয়েছে। চট্টগ্রামে অবস্থিত দেশের একমাত্র ডিএপি সার কারখানায় উৎপাদন হয় প্রায় ১ লাখ টন সার। বাকি ১৫ লাখ টন সার বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
চাহিদা বাড়ায় চলতি বছর ১ লাখ ৩২ হাজার টন ডিএপি সার উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাঁচামাল সংকট এবং সিইউএফএলের পর নির্ভরশীলতার কারণে এই কারখানা ডিএপি উৎপাদন করেছে মাত্র ২৮ হাজার ৭৬৬ টন।
এখন বাড়তি চাহিদার ডিএপি সারের জোগান দিতে সরকারকে বেশি দামেই আমদানি করতে হবে। আর বাড়তি দামে আনা ডিএপি সারের দাম বাড়ানো যাবে না। ফলে সরকারকে বাড়তি টাকা ভর্তুকি দিয়েই চাহিদা মেটাতে হবে। অথচ দেশে উৎপাদন হলে অনেক কমদামেই ডিএপি সার উৎপাদন করে কৃষককে সরবরাহ দেওয়া সম্ভব হতো।
দেশের বোরো মৌসুম, অর্থাৎ অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সময়ে ফসল উৎপাদনে ডিএপি সারের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয়। সেই সময়ে সর্বোচ্চ চাহিদা মেটানোর জন্য ডিএপি সারের মজুদ রাখতে হয়; যাতে কৃষকরা নিরবচ্ছিন্ন সার পান। এখন সেই পিক সিজন চলছে। সেই সময়েই ডিএপি সার উৎপাদন বন্ধ হতে যাচ্ছে।
ডিএপি সারের বাড়তি চাহিদা মোকাবিলায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি সরকারের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে দেশটিতেই একটি সার কারখানা স্থাপনে একটি সমঝোতা চুক্তি করেছিল। প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য সৌদি আরবের কোম্পানি হানওয়া সৌদি কনস্ট্রাকশনের (এইচএসসিসি) সঙ্গে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) চুক্তি করেছিল।
২০২৪ সালে প্রতিবেদন পেলে সেই অনুযায়ী প্রকল্প আগানোর কথা ছিল। কারখানা স্থাপনের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছিল, ডিএপি সারের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল রক ফসফেট ও ফসফরিক অ্যাসিড দেশে নেই। আমদানি করেই এই কাঁচামাল আনতে হয়। আর সৌদি আরবে সেই কাঁচামাল সহজলভ্য ও দাম কম। ফলে সেখানে কারখানা স্থাপন করে দেশে সার আনা গেলে উৎপাদন খরচ কমবে।
কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর সেই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের হালনাগাদ তথ্য জানা যায়নি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে ব্যবহৃত সারের মধ্যে প্রধান হচ্ছে ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি), ডিএপি ও মিউরেট অব পটাশ (এমওপি)। চলতি অর্থবছরে এ চারটি সারের মোট চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৯ লাখ টন। এছাড়া বোরনসহ অন্যান্য সার মিলিয়ে মোট চাহিদা থাকে প্রায় ৬৯ লাখ টন।