Beta
বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫
Beta
বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫

চীনের গোপন ক্ষমতার কেন্দ্র ঝাংনানহাই বাগান

ঝাংনানহাইয়ের প্রবেশ দুয়ার জিনহুয়ামেন।
ঝাংনানহাইয়ের প্রবেশ দুয়ার জিনহুয়ামেন।
[publishpress_authors_box]

চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের এক প্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে জিংশান পাহাড়। স্থানীয়রা একে ‘প্রসপেক্ট হিল’ নামেও চেনে। এই পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত প্যাগোডা থেকে বেইজিং শহরের অনেকটা অংশ দেখা যায়।

পাহাড়ের দক্ষিণ থেকে নিষিদ্ধ শহর ও ঐতিহাসিক তিয়ানআনমেন স্কয়ারের বিশাল চত্বর দেখা যায়। এর পূর্বে শহরের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র, উত্তরে ‘ড্রাগনস ডেন’ নামে পরিচিত সুউচ্চ টাওয়ারগুলোর অবস্থান। আর পশ্চিমের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে অতীতের সম্রাটদের নির্মিত পুরনো অট্টালিকা ও গাছঘেরা হ্রদ দেখা যায়।

দেশটির বর্তমান নেতারা চান না পাহাড়টির উপরের দৃশ্য কেউ দেখুক। খুব কৌশলে তারা জায়গাটিকে অন্য সব জায়গা থেকে আলাদা করে রেখেছেন। কারণ দেড় হাজার একরের ওই জায়গায় যেমন আছে প্রাচীন সব মন্দির, তেমনি আছে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) ধা চকচকে সদরদপ্তর।

পাহাড়ের উপরের এই মনোরম বাগানটিকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ঝাংনানহাই। একে প্রায়ই চীনের হোয়াইট হাউস বা ক্রেমলিনের সমতুল্য ভাবা হয়। কারণ এটি চীনের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু।

ঝাংনানহাইয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সদরদপ্তর থাকলেও সেখানে পার্টির শীর্ষ নেতারা ছাড়া কেউ যেতে পারেন না। দেশের সবচেয়ে গোপনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হয় এটি। পুরো ঝাংনানহাই শতাব্দী প্রাচীন লাল মাটির দেওয়ালে ঢাকা। আর সেই দেওয়ালের উপরে আছে অসংখ্য সিসিটিভি ক্যামেরা। দেওয়ালের নির্দিষ্ট দূরত্বে নিরাপত্তা বাহিনীর উর্দিধারী ও উর্দিহীন সদস্যরা অস্ত্র হাতে সবসময় পাহারা দিচ্ছে।

মিং ও চিং রাজবংশের সম্রাটরা তাদের বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করতেন নিষিদ্ধ নগরী থেকে। তারা ঝাংনানহাইয়ে একাধিক মন্দির, সভাকক্ষ ও বাসভবন নির্মাণ করেন। রাজপ্রাসাদের চেয়ে কম আনুষ্ঠানিকভাবে নির্মিত হলেও ওই স্থাপত্যগুলো বাগান ও হ্রদের দিকে মুখ করে বেশ পরিকল্পিতভাবেই তৈরি করা হয়। সম্রাটরা এই বাগানে তাদের অবকাশ যাপন করতেন।

হংকংয়ের প্রধান কার্যনির্বাহী লীয়ুঙ চুন-ইংয়ের সঙ্গে ঝাংনানহাইয়ে ২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর বৈঠক করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

বিখ্যাত লেখক জেরেমি বারমে তার ‘দ্য ফরবিডেন সিটি’ বইয়ে ১৮ শতকের চিং সম্রাট চিয়েনলংয়ের ঝাংনানহাইয়ের দৈনন্দিন রুটিন সম্পর্কে একটি গল্প লিখেছেন।

তিনি লিখেছেন, “প্রতিদিন সকালে ঠান্ডা স্যুপ খাওয়ার পর তিনি উষ্ণ পালকিতে করে বাগানের একটি মন্দিরে যেতেন। সেখান থেকে তিনি লেকের দৃশ্য উপভোগ করতেন। ওই মন্দিরে বসেই তিনি ১৮ পদের খাবার দিয়ে আরেকবার নাস্তা করতেন।”

ইতিহাসবিদ ‘দ্য শর্টেস্ট হিস্ট্রি অব চায়না’ বইয়ের লেখক লিন্ডা জাইডিন সিএনএনকে ইমেইলে বলেন, “সম্রাট যেন মহাসাগর টেরেসের দৃশ্য উপভোগ করতে, খাবার খেতে ও চলে যেতে পারেন, এজন্য তাকে বহনকারী, তার রন্ধনশিল্পী ও কর্মচারীদের একটি দল অবিশ্বাস্য সমন্বয়ের সঙ্গে কাজ করত। এটি অপ্রয়োজনীয় ও অপচয় মনে হলেও এতে এক ধরনের কাব্যিকতাও ছিল।”

১৮৬১ সাল থেকে চীনের নিয়ন্ত্রণ ছিল সম্রাজ্ঞী দোয়াগার সিক্সির হাতে। তিনিই প্রথম শাসক যিনি ঝাংনানহাইকে শুধু বিশ্রামাগার হিসেবে নয়, শাসনকার্য পরিচালনার কেন্দ্র হিসেবেও দেখতেন। দীর্ঘ বছর তিনি বাগানের ‘হল অব সেরিমনিয়াল ফিনিক্সেসে’ বাস করতেন। সেটি তখন চীনের রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। সেখানেই ১৯০৮ সালে তার মৃত্যু হয়।

সম্রাজ্ঞী সিক্সির অধীনে ঝাংনানহাইয়ের শান্ত পরিবেশ ‘শাস্তি ও বন্দী করে রাখার’ জায়গায় পরিণত হয়েছিল। ১৮৯৮ সালে বাগানটির সংস্কারের এক পর্যায়ে নিজের ভাগ্নে গুয়াংক্সু সম্রাটকে ইংতাই দ্বীপের কারাগারে আটকে রেখেছিলেন সিক্সি। দ্বীপটি ঝাংনানহাইয়ের লেকের দক্ষিণে অবস্থিত।

চীনা কিংবদন্তির অমরদের আবাসস্থল পৌরাণিক পেংলাই দ্বীপের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল ইংতাই দ্বীপ। এই ছোট দ্বীপটিতে গুয়াংক্সু সম্রাটের জীবনের অধিকাংশ সময় কাটে। সিক্সির মৃত্যুর একদিন আগে আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয় সম্রাটের।

‘দ্য সার্চ ফর অ্যা ভ্যানিশিং বেইজিং : এ গাইড টু চায়নাস ক্যাপিটাল থ্রু দ্য এজেস’ বইয়ের লেখক এম. এ. অ্যালড্রিচ।

তিনি বলেন, “গুয়াংক্সু সম্রাটের কারাদণ্ড ও মৃত্যু একটি করুণ ঘটনা। ঝাংনানহাই শুধু বিলাসবহুল জায়গাই নয়, এটি রাজনৈতিক নেতাদের জন্য সতর্কতা হিসেবেও কাজ করে। যে সীমা অতিক্রম করবে তার পরিণতি কী হতে পারে, তা এই জায়গার ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে।”

১৯৪৯ সালে মাও সেতুং জনগণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বেইজিং শহরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এর হাত থেকে বাদ যায়নি ঝাংনানহাই। নতুন চীনের রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে ঝাংনানহাইকে বহুবার গুড়িয়ে দেওয়া, পুননির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে। এতে করে ওই বাগান তার অতীতের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে।

বরফে ঢাকা ঝাংনানহাই।

স্থাপত্য পরিবর্তন

১৯১২ সালে চীনের সম্রাটের শাসন শেষ হওয়ার পর থেকে ঝাংনানহাইয়ের ভবনগুলোতে অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। চীনের শেষ সম্রাট পদত্যাগের পর তাকে নিষিদ্ধ নগরীর উত্তর অংশে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তখন দেশটির নতুন রাষ্ট্রপতি ইউয়ান শিকাই ঝাংনানহাইকে তার সরকারের সদরদপ্তর হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন।

ইউয়ান শিকাই সম্রাটের বাগানে কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন। অনেক পশ্চিমা দর্শনার্থী এই পরিবর্তন পছন্দ করেননি।

১৯৩৫ সালে ‘ইন সার্চ অফ ওল্ড পিকিং’ বইটি লেখেন এল. সি. আরলিংটন ও উইলিয়াম লুইসোহন।

তারা বলেন, “ইউয়ান শিকাইয়ের রাজনৈতিক জীবনে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল কি না- তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও স্থপতি ও নির্মাণশিল্পী হিসেবে তার রুচি নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। তার নির্মিত বা সংস্কার করা সব ভবনই অত্যন্ত নিকৃষ্ট রুচির পরিচায়ক।”

ক্ষমতার কেন্দ্র

১৯৪৯ সালে চীনের গৃহযুদ্ধে কমিউনিস্টদের জয় হয়। এরপর মাও সেতুং বেইজিংয়ের পশ্চিমের রাজকীয় বাগান শুয়াংকিং ভিলায় বসবাস শুরু করেন। তিনি বেইজিংয়ের রাজকীয় কেন্দ্রস্থলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন।

বলা হয়, তিনি কখনও নিষিদ্ধ নগরীতে প্রবেশ করতে রাজি হননি। কারণ পুরনো সামন্তবাদী চীনের ক্ষমতার কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ভয় ছিল তার। তিনি ওই কাঠামো উৎখাতের জন্যই লড়াই করেছিলেন।

তবে শেষমেষ মাও ঝাংনানহাইতে চলে যান। ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে তিনি সেখানে বাস করতে শুরু করেন। তিনি যে বাগানটিতে থাকতেন সেটি ছিল চিয়াংলং ও কানক্সি সম্রাটের পছন্দের। সেখানেই তিনি ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে দরবার করতেন।

নতুন চীনে ঝাংনানহাইকে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার পর মাও সেতুং তার নিজস্ব পছন্দ অনুসারে প্রাঙ্গণটি পুনর্নির্মাণ শুরু করেন।

১৯১২ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে ঝাংনানহাইয়ের প্রবেশ দুয়ার জিনহুয়ামেনের দৃশ্য। ছবি : উইলিয়াম কুপার।

লেখক অলড্রিচের মতে, “১৯৪৯ সাল থেকে ঝাংনানহাইতে নতুন নতুন স্থাপত্যশৈলীর আগ্রাসন শুরু হয়। টেনিস কোর্ট, জিমনেসিয়াম, সুইমিং পুল ও চীনা ছাদের ছাউনিতে ঢাকা পশ্চিমা ভবনগুলো যুক্ত করা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা এই অসঙ্গতিপূর্ণ পরিবর্তন পছন্দ করতেন না।”

১৯৬৬ সালে মাও ‘গার্ডেন অব অ্যাবানডান্ট বেনেফিসেন্স’ বাগান থেকে তার প্রিয় ইনডোর সুইমিং পুলের পাশে বিশেষভাবে নির্মিত একটি বাড়িতে চলে যান। সেখানে প্রায়ই পানিতে ভেসে থাকার সময়ে কর্মকর্তাদের তার সঙ্গে আলোচনার জন্য ডাকতেন। সেখানেই তিনি ১৯৫৮ সালে রুশ নেতা নিকিতা খ্রুশ্চেভের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।

লিন্ডা জাইভিন বলেন, “রুশ ও চীনা অনুবাদকদের পুলের ধারে হেঁটে যেতে হয়েছিল। রুশ নেতা সাঁতার কাটতে পারতেন না। কিন্তু মাও সাঁতার কাটতে ভালোবাসতেন। ফলে খ্রুশ্চেভকে এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে পুলের পানিতে পা ঝুলিয়ে বসতে হয়েছিল।”

মাও সেতুংয়ের পাশের বাসভবনে ছিল একটি বিশাল লাইব্রেরি। সেখানে চীনা শাস্ত্রীয় সাহিত্যের বই ছিল। ১৯৭২ সালে মাও এই লাইব্রেরিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

মাও সেতুংয়ের পরবর্তী নেতারা ঝাংনানহাই প্রাঙ্গণের বাইরে বাস করতে পছন্দ করতেন। ১৯৭৭ সাল থেকে ডেং জিয়াওপিং বেইজিংয়ের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হ্রদশ্রেণীর ‘নর্দার্ন সীর’ পাশের একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম্য ঘরে বাস করতেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা না হলেও ধারণা করা হয়, চীনের বর্তমান নেতা শি জিনপিং ও তার পূর্বসূরীরা জেড স্প্রিং হিলে বাস করেন। হিলটি বেইজিংয়ের পশ্চিমে অবস্থিত একটি বিশেষ বাগান। একে চীনা রাজনীতির ‘পেছনের বাগান’ বলা হয়।

অ্যালড্রিচ উল্লেখ করেন, যারা ঝাংনানহাইকে তাদের প্রাথমিক বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন এমন নেতা ও দলের ক্যাডাররা প্রায়ই তাদের কার্যকলাপের জন্য অপ্রত্যাশিত নজরদারির শিকার হতেন। বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়।

নজরদারির বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছিলেন মাওয়ের চিকিৎসক লি ঝিসুই। তিনি বলেছিলেন, ঝাংনানহাইয়ের বাসিন্দারা সবসময় নজরদারির অধীনে ছিলেন। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় ঝাংনানহাইতে আগুন জ্বালানো নিষিদ্ধ ছিল। কারণ, ধারণা করা হতো, আগুনে গোপনীয় বা বিপ্লববিরোধী নথি পোড়ানো হচ্ছে।

ঝাংনানহাইয়ে বাম পাশ থেকে মাও সেতুং, চৌ এনলাই, চেন চি ও ঝ্যাং ওয়েনতিয়ান।

একসময় ঝাংনানহাইয়ের হ্রদগুলোর মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা যেত বাগান থেকে। কিন্তু এখন সেই বাগানগুলোর বুকে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো দপ্তর ও অধিবেশন হল। এসবের অধিকাংশই ১৯৭০-এর দশকে নির্মিত। তখন ঝাংনানহাইয়ের ব্যাপক ধ্বংস ও সংস্কার হয়। পুনর্নির্মাণ এতটাই ব্যাপক ছিল যে, ১৯৭৯ সালে একজন দর্শনার্থী এই স্থানটিকে একটি নির্মাণ স্থানের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।

সমসাময়িক কম্পাউন্ডটি মোটামুটিভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। উত্তরের ভবনগুলো চীনের শীর্ষ নির্বাহী সংস্থা, স্টেট কাউন্সিলের সদরদপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানেই বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। দক্ষিণের হ্রদের আশেপাশে কিনঝেং হলের মধ্যে সিসিপির সদরদপ্তর।

ঝাংনানহাইয়ের পশ্চিমের হ্রদের তীরে ‘হুয়াইরেন হলে’ চীনের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছে। চিং সাম্রাজ্যের শেষ সময়ে হলটি নির্মাণ করা হয়। ১৯৫০ সালে সিসিপি হলটির সংস্কার করে।

হুয়াইরেন হল ঝংনানহাইয়ের একটি বিশাল ও মনোমুগ্ধকর ভবন। এর ছাদের উপরে উজ্জ্বল সবুজ মোটা টাইলস সুন্দর বাঁকানো লাইনে সাজানো, যা ভবনের চার কোণায় উঠে এসেছে। লাল কাঠের খুঁটি, জানালা ও দরজা দিয়ে সজ্জিত ভবনের অগ্রভাগ ধূসর ইটের তৈরি। ভবনের ভেতরে একটি বড় মিলনায়তন এবং বৈঠকের জন্য একাধিক ঘর রয়েছে।

কয়েক দশক ধরে হুয়াইরেন হল চীনের পলিটব্যুরোর বৈঠকের জন্য প্রধান জায়গা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পলিটব্যুরো হলো চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা। এর সদস্য সংখ্যা দুই ডজনের বেশি। চীনের রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণীর মূল সংস্থা পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটিও এই হলে বৈঠক করে।

সাধারণত তারা সেক্রেটারি জেনারেলের দপ্তরের কাছে অবস্থিত কিংঝেং হলে বৈঠক করে। শি জিনপিংয়ের আমলে উভয় সংস্থার ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উত্তাল সময়ে হুয়াইরেন হলে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও বিতর্ক হতো। বিপ্লব শেষ হওয়ার পর ‘চারজনের দল’ নামে পরিচিত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর তিন সদস্যকে এই হলেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই গোষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন মাও সেতুংয়ের স্ত্রীও। তাদের ‘মাওয়ের নির্বাচিত রচনা’ পঞ্চম খণ্ড প্রকাশনার বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি বৈঠকে অংশগ্রহণ করতে ডাকা হয়েছিল। ওই আমন্ত্রণ ছিল মূলত তাদের গ্রেপ্তারের জন্য পাতা ফাঁদ।

১৯৮৯ সালের এপ্রিলে পলিটব্যুরোর এক বৈঠকের সময় হুয়াইরেন হলে প্রাক্তন পার্টি প্রধান হু ইয়াওবাং হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তার মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর তিয়ানআনমেন স্কয়ারে বিক্ষোভ শুরু হয়। ওই বছরের জুনেই তৎকালীন সরকার জোর করে বিক্ষোভ দমন করে।

১৯৮৩ সালে ঝাংনানহাইয়ে যেতে পারতেন সাধারণ দর্শনার্থীরা।

চীনা রাজতন্ত্রের পতনের পর থেকে সবসময় ঝাংনানহাই সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ ছিল না। বিভিন্ন সময়ে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল। ১৯২০-এর দশকের শেষ দিকে ঝাংনানহাই একটি পার্কে পরিণত করা হয়। পর্যটকরা হ্রদে নৌকা চালিয়ে বেড়াতে ও সাঁতার কাটতে পারতেন।

১৯৮০ এর দশকে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু সুন্দর ও ঐতিহাসিক স্থান খুলে দেওয়া হয়। এমনকি মানুষ মাও সেতুংয়ের সাবেক বাসভবন দেখতে যেতে পারতেন। ১৯৮৯ সালের গোড়ার দিকে নিউ ইয়র্ক টাইমসের একজন সাংবাদিক সহজেই ঝাংনানহাইয়ে গিয়েছিলেন।

২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক উষ্ণ থাকাকালে চীনের সাবেক রাষ্ট্রপতি হু জিনতাও ঝংনানহাইতে আমেরিকান হাই স্কুলের শিক্ষার্থীদের একটি দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ

ঝাংনানহাইয়ের নিরাপত্তা আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি কঠোর। বেইজিংয়ের দ্রুত বিকাশের কারণে এই প্রাঙ্গণের গোপনীয়তা বজায় রাখা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। ১৯৭৩ সালে ঝাংনানহাইয়ের কাছে বেইজিং হোটেলের একটি অংশ নির্মাণ করা হয়েছিল।

ওই অংশ থেকে ঝাংনানহাইয়ের ভেতরে সহজেই দেখা যেত। এমনকি স্নাইপার রাইফেল দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করাও সম্ভব ছিল। ঝাংনানহাইয়ের গোপনীয়তা রক্ষায় নিষিদ্ধ নগরীর পশ্চিম প্রান্তে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়।

২০১৮ সালে বেইজিংয়ের নতুন সর্বোচ্চ ভবন ৫২৮ মিটার উঁচু সিটিসি টাওয়ার নির্মাণ হয়। দেশের জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগ ওই ভবনের শীর্ষ তলাগুলোর দখল নেয়। কারণ তাদের আশঙ্কা ছিল, ভবনের দর্শক বা বাসিন্দারা ঝংনানহাইয়ের ভেতরে গুপ্তচরবৃত্তি চালাতে পারেন।

চীনা নেতা হু জিনতাও ২০১১ সালের ১৫ জুলাই ঝাংনানহাইয়ে আমেরিকান শিক্ষার্থীদের একটি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

গত কয়েক দশকে ঝাংনানহাইয়ের প্রবেশদ্বার জিনহুয়ামেন বারবার বিক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তিয়ানআনমেন বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীরা জিনহুয়ামেনে জড়ো হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে সরকারের হাতে নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ১০ হাজারেরও বেশি নিষিদ্ধ ঘোষিত ফালুন গংয়ের সদস্য ঝাংনানহাইয়ের কাছে রাস্তায় জড়ো হয়েছিল।

অনেকে ঝাংনানহাইকে হোয়াইট হাউসের সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু অ্যালড্রিচ বলেন, “আজকের দিনে ঝাংনানহাইয়ে যেভাবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা এটিকে অতীতের রাজকীয় প্রাসাদের কথা মনে করিয়ে দেয়।

“সাধারণ মানুষ ঝাংনানহাইতে প্রবেশ করতে পারে না। তাই এটিকে চীনের শাসক শ্রেণীর জন্য ‘নতুন নিষিদ্ধ শহর’ বলা হয়। অথচ ক্রেমলিন পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত