প্রতিদিন রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরেন চেন। এরপর ল্যাপটপ চালু করে শুরু করেন তার গোপন এক জীবনের পথচলা—একজন ছদ্মবেশী মানবাধিকার কর্মীর জীবন।
চীনের পূর্বাঞ্চলের এক শহরে নিজ শোবার ঘরে বসে চেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেন এমন সব ভিডিও দেখে যা কোনও ভয়াবহ চলচ্চিত্রকেও হার মানায়। এর বাইরে তিনি চেষ্টা করেন এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়তে, যাদেরকে বাস্তব জীবনে তিনি তার চরম শত্রু হিসেবে গণ্য করতেন।
নিরাপত্তার স্বার্থে চেনের সত্যিকারের পরিচয় গোপন রেখেছে সিএনএন। কারণ চেন মূলত অনলাইন অনুসন্ধানকারী দলের একজন সদস্য। তাদের কাজ হচ্ছে একটি গোপন আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ককে ধ্বংস করা, যারা অর্থের বিনিময়ে বিড়ালকে নির্যাতন ও হত্যা করে।
সিএনএনের এক বিশেষ অনুসন্ধান বলছে, গত এক বছরে এই ধরনের গোষ্ঠীগুলো বৈশ্বিকভাবে আরও বিস্তৃত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা এখন টেলিগ্রাম, এক্স (সাবেক টুইটার) ও ইউটিউবের মতো মূলধারার প্ল্যাটফর্মেও সক্রিয়।
এই ভিডিওগুলোর দর্শকদের অনেকেই পশু নির্যাতনকে ঘিরে যৌন বিকৃতিতে ভোগে—এটি ‘জুস্যাডিজম’ নামে পরিচিত। বিশেষজ্ঞরা সিএনএনকে জানিয়েছেন, এসব ব্যক্তি নিরীহ প্রাণীর কষ্ট দেখেই আনন্দ পান।
সিয়াটলভিত্তিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও পশু যৌন নির্যাতনের গবেষক জেনি এডওয়ার্ডস বলেন, “এটা এখন এক আন্তর্জাতিক প্রবণতায় রূপ নিয়েছে। এটা যতটা ভাবা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি ঘটছে।”
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, অনেক নির্যাতনকারীই থাকে চীনে। সেখানে পশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনও আইন নেই। এই দৃষ্টান্তহীনতার সুযোগে তারা বিশ্বজুড়ে ভোক্তাদের জন্য ভিডিও তৈরি করছে—যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক ও জাপানের দর্শকরাও।
এই বিষয়ে চীনা সরকারের কাছে সিএনএন প্রশ্ন পাঠিয়েছে। তবে এখনও কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।
বিড়াল নির্যাতনকারীদের গোপন জগত
মাসব্যাপী তদন্তের অংশ হিসেবে, সিএনএন চীনের কিছু এনক্রিপ্টেড চ্যাট গ্রুপে প্রবেশ করে। এই গ্রুপগুলোতে বিড়াল নির্যাতনের ভিডিও প্রচার ও বিনিময় করা হচ্ছে।
এই চ্যাট গ্রুপগুলো এমন এক কালো জগতের ছবি তুলে ধরে, যেখানে নির্যাতনকে তুচ্ছ ও উপহাস করে উপস্থাপন করা হয়। বিষয়টা সেখানে এমন যেন এটা কোনও ভিডিও গেমের অংশ।
এই গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে নির্যাতনের নতুন নতুন কৌশল নিয়ে প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে উঠেছে। তারা যেসব ব্যক্তি এসব বর্বরতা চালায়, তাদেরকে নায়ক হিসেবে তুলে ধরে।
সিএনএন দেখতে পায়, সদস্যরা তাদের কৃতকর্মের গল্প শেয়ার করছে এবং আরও নিষ্ঠুর পদ্ধতির প্রস্তাব দিচ্ছে।
চেনও এমন গ্রুপে যুক্ত ছিলেন। বছরের পর বছর ধরে তিনি বিভীষিকাময় ভিডিও দেখে যাচ্ছেন এবং নির্যাতনকারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করে তথ্য সংগ্রহ করছেন যাতে তাদের সনাক্ত করা যায়।
তিনি “ফেলাইন গার্ডিয়ানস” নামে একটি মানবাধিকার কর্মী জোটের সদস্য। এই সংগঠনের লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাপী এই বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করা—বিশেষ করে চীনে।
চেন বলেন, “চীনে এখন বিড়াল নির্যাতনের এক ঢেউ শুরু হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বয়স্করাও এতে অংশ নিচ্ছে।”
তার মতে, চীনভিত্তিক এই নেটওয়ার্কে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা “দিন দিন বেড়েই চলেছে,” এবং এর মধ্যে বিদেশিরাও রয়েছে।
ফেলাইন গার্ডিয়ানসের সংগৃহীত তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের জুন থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে চীনের টেলিগ্রাম গ্রুপগুলোতে নতুন নির্যাতনমূলক ভিডিওর সংখ্যা ৫০০ শতাংশ বেড়েছে। গড়ে প্রতি আড়াই ঘণ্টায় একটি নতুন ভিডিও আপলোড হয়েছে। শুধু ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসেই ৫০০টিরও বেশি নতুন ভিডিও আপলোড হয়েছে। আর এর অধিকাংশই এসেছে অজানা নির্যাতনকারীদের কাছ থেকে।
এই ধরনের কিছু কনটেন্ট মূলধারার ওয়েবসাইটেও পাওয়া গেছে। সিএনএন একটি ইউটিউব অ্যাকাউন্ট খুঁজে পায়, যেখানে ৮০০টির বেশি বিড়াল হত্যার ভিডিওর “প্লেলিস্ট” ছিল। সিএনএন মন্তব্য চাওয়ার পর ইউটিউব ওই চ্যানেলটি এবং সংশ্লিষ্ট আরেকটি চ্যানেল মুছে দেয়। ইউটিউবের এক মুখপাত্র জানান, “পশুদের ওপর সহিংসতা বা নির্যাতন দেখানো ভিডিওর কোনও জায়গা ইউটিউবে নেই।”
‘সেলিব্রিটির মতো দেখতে’
চেন থেকে প্রায় ৫ হাজার মাইল দূরে লন্ডনে ফেলাইন গার্ডিয়ানসের আরেক কর্মী লারা বিশ্বব্যাপী এই ভিডিওর বিস্তার পর্যবেক্ষণ করে আসছেন।
লারা বলেন, “এর সূত্রপাত হয় চীনে। এরপর অন্য দেশেও অনেকে এই ভিডিওগুলোর অনুকরণ করে। এমনকি শিশুরাও এসব কনটেন্টের শিকার হচ্ছে। তাদেরকে সেলিব্রিটির মতো দেখা হয়। তারা শুধু ভয়াবহভাবে বিড়াল নির্যাতনের আনন্দই পায় না, বরং সেই ভিডিও থেকে পাওয়া প্রতিক্রিয়া ও খ্যাতিও উপভোগ করে।”
লারা, চেন এবং তাদের অন্যান্য সহযোদ্ধারা দিনভর পেশাগত কাজে নিয়োজিত থাকার পরেও পরস্পরের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখেন। তারা বিভিন্ন টাইম জোনে রাত জেগে নির্যাতনকারীদের শনাক্তের চেষ্টা চালিয়ে যান।
তাদের গোয়েন্দাগিরির কাজের মধ্যে থাকে প্রতিটি ভিডিও ফ্রেম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করা। তারা ভিডিওর পটভূমি দেখে লোকেশন বা পরিচয় সম্পর্কে কোনও সূত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। যদি ভিডিও বিক্রি করা হয়, তবে আর্থিক লেনদেন সম্পর্কিত তথ্য থেকেও তারা উপাত্ত সংগ্রহ করেন।
চেন বলেন, “একটি ভিডিও বারবার দেখে আমরা অনেক সময় তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে কিছু ধারণা পাই। তারপর আমরা স্থানীয়ভাবে তদন্ত শুরু করি।”
যখন তারা মনে করেন, তারা যথেষ্ট কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন, তখন তারা স্থানীয় লোকজন ও প্রতিবেশীদের সাক্ষাৎকার নেন। এমনটা করার কারণ হলো, যদি কেউ কিছু দেখে থাকেন বা এমন কিছু শুনে থাকেন যা প্রমাণ হিসেবে কাজে লাগতে পারে।
চেন অনেক সময় নিজেকে একজন “জুস্যাডিস্ট” অর্থাৎ পশু নির্যাতনপ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেন নির্যাতনকারীদের আস্থা অর্জন করতে। তবে কিছু গ্রুপে প্রবেশের জন্য শুধুমাত্র অভিনয় যথেষ্ট নয়; সেখানকার প্রবেশ শর্তই হলো অপরাধে অংশ নেওয়া।
চেন বলেন, “এই ধরনের মূল গ্রুপগুলোতে যোগ দিতে অনেক সময় এমন একটি ভিডিও বানাতে হয়, যা স্বেচ্ছাসেবীরা করতে পারে না—সেটি হলো একটি প্রাণবন্ত বিড়ালকে ধরে তার মৃত্যু পর্যন্ত নির্যাতন চালানো।”
তবুও গত কয়েক বছরে চেন এতটাই গভীরে পৌঁছেছেন যে তিনি চীনের নির্যাতন নেটওয়ার্ক থেকে অন্তত এক ডজন অপরাধীর পরিচয় ফাঁস করতে পেরেছেন।
অর্ডার অনুযায়ী নির্যাতন
এই জঘন্য নেটওয়ার্কে প্রবেশ করলে দেখা যায় একটি আলাদা উপসংস্কৃতি। আর এর নিজস্ব পরিভাষা ও শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে।
সিএনএন যেসব মূলধারার ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেছে, সেখানকার ফোরামগুলোতে সদস্যরা নিজেদেরকে “ক্যাট লাভার” নামে পরিচয় দিত। একদিকে এটি আসল বিড়ালপ্রেমীদের উপহাস করে, অন্যদিকে তাদের কার্যকলাপ আড়াল করতেও সাহায্য করে।
নির্দিষ্ট চ্যাটরুমগুলোতে প্রবেশ করলে দেখা যায়, ভিডিও নির্মাতাদের বলা হয় “ক্যাট ডিলিটার” বা “মাস্টার”। আর যারা অর্থ দিয়ে ভিডিও কিনে দেখেন, তাদের ডাকা হয় “স্পনসর” নামে।
এই গোষ্ঠীটি নিজেদেরকে এক ধরনের “বিচারক” হিসেবে ভাবেন, যারা পৃথিবী থেকে সব “দুষ্ট বিড়াল” দূর করার লক্ষ্যে কাজ করছে। এটি তাদের অপরাধকে যৌক্তিক করতে তৈরি এক ধোঁকাবাজি।
নির্মাতারা “অর্ডার অনুযায়ী নির্যাতন” এরও বিজ্ঞাপন দেয়। এর মাধ্যমে ক্রেতারা নির্দিষ্ট বিড়াল, নির্যাতনের উপকরণ এবং পদ্ধতি বেছে নিতে পারেন। আর এর জন্য একটি নির্ধারিত মূল্য দিতে হয়।
প্রচারমূলক পোস্টারে বিড়ালের ছবি, নাম, বয়স ও “শেলফ লাইফ” দেওয়া থাকে—অর্থাৎ কখন বিড়ালটিকে হত্যা করা হবে। স্পনসরদের পরামর্শ দেওয়া হয় “কাস্টমার সার্ভিস” এর সঙ্গে যোগাযোগ করে দাম জেনে নিতে।
লারা বলেন, “এই নির্যাতনকারীদের মানসিকতা এতটাই বিকৃত যে তারা নির্যাতনের সময়টাকে যতদূর সম্ভব দীর্ঘায়িত করতে চায়। ভিডিওতে দেখা যায় বিড়ালকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, কখনও ব্লেন্ডারে গলে ফেলা হচ্ছে। আবার এমনও ঘটনা আছে, যেখানে বিড়ালের দেহ টুকরো টুকরো করে তাদের নাড়িভুঁড়ি টেনে বের করা হচ্ছে।”
এমনকি পশুদের ওপর এই নির্যাতনকে “সার্চেবল টার্ম” বা খোঁজার শব্দ হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, যেসব বিড়ালের সামনের পা কেটে ফেলা হয়েছে এবং তারা শুধু পিছনের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের বলা হয় “টি-রেক্স”।
“যৌন উত্তেজনা”
চীনের এক ভোক্তা নিয়মিতভাবে এসব সহিংস ভিডিওর জন্য অর্থ দেন। তিনি স্বীকার করেছেন—এই ভিডিও তার মধ্যে যৌন উত্তেজনা তৈরি করে।
সিএনএনকে দেওয়া টেলিফোন সাক্ষাৎকারে ঝাং (ছদ্মনাম) বলেন, “এই ভিডিও দেখে আমি যৌনতাকেও ছাপিয়ে যাওয়া আনন্দ পাই।”
২৫ বছর বয়সী ঝাং বিবাহিত। তিনি জানান, কিশোর বয়সে টেলিভিশনে এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেখার পর থেকেই তার এই অভ্যাস শুরু।
তিনি বলেন, “এটা এমন এক ধরনের ফেটিশ যা আমি ছাড়তে পারি না। এটা সিগারেট ছাড়ার চেয়েও কঠিন।”
ঝাং এ পর্যন্ত বিড়াল নির্যাতনের ভিডিও কেনার পেছনে কয়েক হাজার ডলার ব্যয় করেছেন। একটি ভিডিওর দাম কয়েক ডলার থেকে শুরু করে ৫০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, তার স্ত্রী এই বিষয়ে কিছুই জানে না। জানলে সম্ভবত তাকে ছেড়ে দিত।
ঝাং জানান, “কাস্টম ভিডিও” কেনার মতো সামর্থ্য তার নেই। এই ধরনের ভিডিওর মূল্য প্রায় ১৩০০ ডলারের বেশি হয়। তবে তিনি বলেন, তার বেশিরভাগ সহসদস্যই “ধনী ব্যক্তি”। তাদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা, প্রোগ্রামার ও ম্যানেজারও রয়েছেন। অনেকে তাদের উইচ্যাট আইডিতে নিজেদের নাম, কোম্পানি বা সরকারি বিভাগের পরিচয় ব্যবহার করে থাকেন।
ঝাং দাবি করেন, বাইরের জগতে তিনি একজন “সাধারণ মানুষ” এবং ব্যক্তিগতভাবে কোনও পশুকে আঘাত করেন না। বরং তিনি বিড়াল ও কুকুর উদ্ধার করে নিজের বাসায় পালন করেন।
তবুও তিনি স্বীকার করেন, তিনি বিশেষ করে নারীদের হাতে বিড়াল নির্যাতন দেখতে বেশি পছন্দ করেন—যেমন, হাই হিল জুতা দিয়ে পিষে মারা।
অপরাধবিদ জেনি এডওয়ার্ডস বলেন, এই ফেটিশের প্রধান চালিকা শক্তি হলো “সেডিজম”। এটি এক ধরনের যৌন বিকৃতি, যেখানে অন্য কারও কষ্ট বা অপমান দেখে যৌন আনন্দ পাওয়া যায়। এটি এক ধরনের সমাজবিরোধী এবং মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা।
জেনি জানান, এই ধরনের ব্যক্তি সাধারণত তাদের প্রবণতা পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে গোপন রাখেন। তারা দ্বৈত জীবন যাপন করে। তাদের আরেকটি গোপন জীবন রয়েছে, যেটি তারা বাকি সব কিছু থেকে আলাদা রাখে।
এই গোপন জীবন প্রকাশ করতে চাইলে অনেক সময় এসব নির্যাতনপ্রিয় ব্যক্তি কর্মীদের শারীরিক সহিংসতার হুমকি দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একজন স্বাধীন পশু অধিকার কর্মী ফেডরা। তিনি শুধুমাত্র নিজের প্রথম নাম ব্যবহার করতে অনুরোধ করেছেন। তিনি জানান—তিনি অনলাইনে নির্যাতন ভিডিও চিহ্নিত করে এক্সে প্রতিবেদন করলে, তাকে টার্গেট করা হয়। তার আসল পরিচয় ফাঁস করে দেওয়া হয় এবং অজ্ঞাত পরিচয়ের অ্যাকাউন্টগুলো তাকে হুমকি দিতে থাকে।
ফেডরা জানান, তিনি চীনের ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাতে চেষ্টা করেছিলেন। এই পদক্ষেপের প্রতিশোধ হিসেবে কিছু নির্যাতনকারী তার এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে সংগ্রহ করা ছবির মাধ্যমে ডিপফেইক পর্নোগ্রাফি তৈরি করে। এমনকি একজন তার ছোটবেলার একটি ছবি মৃত বিড়ালের পাশে বসিয়ে, পাশে “আমি তোমার জন্য আসছি ফেডরা” লেখা একটি চিহ্ন বসিয়ে প্রকাশ করে।
ফেডরা বলেন, “তারা হুমকি দিয়েছে আমার কুকুরের চামড়া তুলে নেবে। আমার পোষা প্রাণী ও পরিবারের সদস্যদের হত্যা করবে।” ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি ধর্ষণ ও হত্যার হুমকিও পান।
এক সময় তিনি এতটাই ভীত হয়ে পড়েছিলেন যে মনে হয়েছিল, তারা হয়তো তার বাসার ঠিকানা জেনে গেছে এবং জানালা দিয়ে ঢুকে পড়বে। তবে এখন তিনি জানান, “আমি আর তাদের ভয় পাই না।”
গোপন সমাজ ও বিকৃত মানসিকতা
ছদ্মবেশি স্বেচ্ছাসেবক চেন বলেন, তিনি যে ব্যক্তিদের এসব গ্রুপে পান, তাদের অধিকাংশই সমাজে একাকী ও উপেক্ষিত পুরুষ। ফলে তারা এই গোপন গোষ্ঠীর মাধ্যমে একধরনের সামাজিক সংযোগ খুঁজে পায়, যা তাদের বিকৃত রুচির উপর প্রতিষ্ঠিত।
তিনি বলেন, এসব পুরুষ ‘ইনসেল’ – যারা নারীদের হাতে প্রত্যাখ্যাত বলে মনে করে এবং এজন্যই নারীদের প্রিয় প্রাণী বিড়ালকে নির্যাতন করে যৌন তৃপ্তি পায়।
অ্যাক্টিভিস্টদের মতে, কিছু ভোক্তা বিড়ালের চিৎকারকে নারীদের বা শিশুদের আর্তনাদের মতো মনে করে। ফলে এ ধরনের নির্যাতনের প্রতি আসক্তি ধীরে ধীরে মানুষের প্রতি সহিংসতার দিকেও গড়াতে পারে।
ফেলাইন গার্ডিয়ানসের একজন সদস্য লারা বলেন, “তারা যা করছে, তা দিনে দিনে আরও ভয়ঙ্কর ও পরিকল্পিত হয়ে উঠছে। এটা আরও খারাপ হতে চলেছে।”
অ্যাপ হ্যাক করে নির্যাতন
চেন জানান, ২০২৪ সালে একটি নতুন ভয়ঙ্কর প্রবণতা দেখা যায়। “স্ট্রিট ক্যাট” নামের একটি অ্যাপ, যা রাস্তার বা আশ্রয়কেন্দ্রের বিড়ালদের লাইভস্ট্রিম করে, সেটিকে টার্গেট করা হয়।
এই নির্যাতনকারী নেটওয়ার্ক অ্যাপটির সার্ভারে হ্যাক করে বিড়ালগুলোর অবস্থান বের করে ফেলে। এরপর তারা ঘোষণা দেয়, যারা বিড়াল ধরে কেটে টুকরো করে লাইভস্ট্রিম ক্যামেরার সামনে ফেলবে, তাদের জন্য পুরস্কার থাকবে। এবিষয়ে “স্ট্রিট ক্যাট” কোনও মন্তব্য দিতে রাজি হয়নি।
চরমপন্থীদের সঙ্গে যোগসূত্র
ফেলাইন গার্ডিয়ানসের অনুসন্ধানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে বিড়াল নির্যাতনের বিষয়টি কিছু নব্য নাৎসি গোষ্ঠীর সঙ্গেও যুক্ত। একটি ব্যক্তিগত টেলিগ্রাম গ্রুপ, “দ্য ইটার্নাল রেইখ” এ ৬০০ জনেরও বেশি সদস্য রয়েছে। এই গ্রুপে বিড়াল নির্যাতনের ভিডিওর পাশাপাশি নারীদের উপর নির্যাতনের দৃশ্য ও চরম দক্ষিণপন্থী আদর্শ ছড়ানো হয়।
একজন সদস্য আমেরিকার পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে দুইটি মৃত বিড়াল হাতে একটি ছবি পোস্ট করেন।
সোশাল মিডিয়ার ভূমিকা ও সীমাবদ্ধতা
সোশাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর উপরও চাপ বাড়ছে। কারণ তারা এই ধরণের নিষ্ঠুর ও বেশিরভাগ দেশে অবৈধ কনটেন্ট ছড়ানো ঠেকাতে ব্যর্থ।
লারা বলেন, “এদের ব্যবহৃত প্ল্যাটফর্ম মূলত টেলিগ্রাম এবং অন্যান্য সোশাল মিডিয়া যেমন এক্স, ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুক।”
অনেক সময় ইউটিউব বা ফেসবুকে গ্রাফিক ভিডিওতে কেউ মন্তব্য করলে তাকে তারা সরাসরি মেসেজ পাঠিয়ে টেলিগ্রাম গ্রুপে আমন্ত্রণ জানায়। প্রথমে বড় গ্রুপে যুক্ত করা হয়। পরে যদি কেউ আরও ভয়ঙ্কর কনটেন্ট চায় বা নিজেই কিছু অর্ডার দিতে চায়, তবে তাকে আরও গোপন ও চরম গ্রুপে নিয়ে যাওয়া হয়।
অপরাধবিদ জেনি এডওয়ার্ডস বলেন, “এই কনটেন্ট অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত। সোশাল মিডিয়া কোম্পানিগুলো এটি করতে পারে ও করাও উচিত। আমরা এখনও মিলিতভাবে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও কার্যকর পদ্ধতি তৈরি করতে পারিনি।”
আইনের দুর্বলতা ও বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া
এডওয়ার্ডস বলেন, অধিকাংশ দেশের আইন এত দুর্বল যে এই অপরাধগুলোর জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। তিনি মনে করেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উচিত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করা।
টেলিগ্রাম জানায়, “যে কোনও সহিংস কনটেন্ট প্রচারকারীদের নিষিদ্ধ করা হয়।” মুখপাত্র আরও জানান, শত শত মডারেটর এবং এআই টুল প্রতিদিন লক্ষাধিক ক্ষতিকর কনটেন্ট সরিয়ে ফেলে।
এই বছরের জানুয়ারিতে মেটার সিইও মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুকের মডারেশন নীতিতে বড় পরিবর্তন আনেন। এতে ফ্যাক্ট-চেকিং কমিয়ে দেওয়া হয় এবং স্বীকার করা হয় যে এর ফলে ক্ষতিকর কনটেন্ট বাড়তে পারে। সিএনএনকে মেটা সরাসরি কোনও মন্তব্য না দিয়ে শুধু তাদের নীতিমালার দিকে ইঙ্গিত করে। সেখানে বলা আছে, “বিশেষভাবে সহিংস বা গ্রাফিক কনটেন্ট” সরিয়ে ফেলা হবে।
চীনে আইনহীনতা ও বৈষম্যমূলক সেন্সরশিপ
চেন বলেন, চীনে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ বিশ্বের অন্যতম কঠোর হলেও বিড়াল নির্যাতনের কনটেন্ট সাধারণত সেন্সর করা হয় না।
তিনি বলেন, “চীনে রাজনৈতিক বিষয় ও পর্নোগ্রাফি সেন্সর করা হয় খুব কড়া ভাবে। কিন্তু প্রাণীর নির্যাতনের ক্ষেত্রে প্রায় কোনও বাধা নেই।”
গত কয়েক বছরে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে একাধিক বিড়াল নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হলেও, অধিকাংশ অপরাধীর বিরুদ্ধে কোনও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তবে অন্যান্য দেশে প্রাণী নির্যাতন আইন অনুযায়ী অনেক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও তুরস্ক রয়েছে।
২০২৪ সালের মে মাসে যুক্তরাজ্যে দুই কিশোরকে পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। একটি স্কুল এলাকায় দুইটি মৃত ও বিকৃত বিড়ালছানা পাওয়া যায়। স্থানীয় পুলিশ আশপাশের স্কুলগুলোতে চিঠি পাঠিয়ে সতর্ক করে, কারণ কিশোরদের মধ্যে প্রাণী নির্যাতনের প্রবণতা বাড়ছে।
তুরস্ক ও বিশ্বব্যাপী দৃষ্টান্ত
বিড়ালের জন্য বিখ্যাত তুরস্কেও ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয় বিড়াল নির্যাতন ও সংগঠিত প্রচারণার দায়ে। গত বছর ফেব্রুয়ারি ও সেপ্টেম্বরে আরও গ্রেপ্তার হয়। এর মধ্যে একজন একটি বিড়ালছানাকে নির্যাতনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন।
লারা বলেন, “তুরস্কে এই গোষ্ঠীগুলোর সদস্য সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই গোষ্ঠীগুলো চীনের গোষ্ঠীগুলোর মতোই কাঠামো অনুসরণ করছে।”
আইনের দাবি ও সামাজিক বিপদ
অ্যাক্টিভিস্টদের মতে, আইনের সঠিক প্রয়োগ ও আইন প্রণয়ন ছাড়া এই গোষ্ঠীগুলো ধ্বংস করা সম্ভব নয়।
সাম্প্রতিক হাই-প্রোফাইল মামলাগুলোর মধ্যে একটি হলো, ইন্দোনেশিয়ায় ২০২৩ সালে একটি বানর নির্যাতন চক্র ধরা পড়ে। ২০২৪ সালের আগস্টে অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ নাগরিক অ্যাডাম ব্রিটনকে কুকুর নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের দায়ে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি এসব ভিডিও টেলিগ্রামে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
চায়না পলিসি বিশেষজ্ঞ এবং ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টন-ডাউনটাউনের সহযোগী অধ্যাপক পিটার লি বলেন, চীনই একমাত্র শিল্পোন্নত দেশ যেখানে এখনও পূর্ণাঙ্গ প্রাণী নির্যাতন বিরোধী আইন নেই।
তিনি বলেন, “এখনই সময় চীনে একটি প্রাণী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করার,” তবে তিনি স্বীকার করেন, এটি রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়।
তিনি জানান, গত দুই দশকে জাতীয় গণকংগ্রেসে একাধিক প্রস্তাব দেওয়া হলেও, কৃষি খাতে প্রভাব পড়বে এই আশঙ্কায় এবং প্রবীণদের মধ্যে পশু কল্যাণ নিয়ে আগ্রহের অভাবে সেগুলো গৃহীত হয়নি।
তবে চীনে পোষা প্রাণীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শহর এলাকায় এই সংখ্যা ১২ কোটি ছাড়িয়েছে। ফলে নতুন প্রজন্মের চাপেই হয়তো ভবিষ্যতে এই ধরনের আইন আনতে হবে।
অধ্যাপক পিটার লি বলেন, শুধু প্রাণীর কষ্ট নয়, এই প্রবণতা চলতে থাকলে সমাজেও গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটি অনুকরণ প্রবণতাকে উৎসাহিত করবে। দর্শকদের বড় অংশই তরুণ। তারা এসব দেখে ধীরে ধীরে সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলছে।
২০২৪ সালে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম চারটি ভিন্ন ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিড়াল নির্যাতনের অভিযোগ তুলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
চায়না ডেইলি ২০২৫ সালের মে মাসে এক প্রতিবেদনে জানায়, “প্রাণী নির্যাতনের কারণে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেওয়ার ঘটনা বাড়ছে।”
প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা শাস্তি পেয়েছে। তবে তাদের কী ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়েছে তা স্পষ্টভাবে জানানো হয়নি—শুধুমাত্র দুইজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
চীনের নিংশিয়া ইউনিভার্সিটির জিনহুয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পরিচালক ওয়াং ওয়েন্ডা বলেন, “শুধু শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করলেই এই সমস্যার সমাধান হবে না। যদি তাদের যথাযথ দিকনির্দেশনা ও সহায়তা না দেওয়া হয়, তাহলে তারা শুধু প্রাণীকেই নয়, মানুষকেও আঘাত করতে পারে।”
বিশ্বব্যাপী পরিচালিত বহু গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা ও মানুষের প্রতি সহিংসতার মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। এই তথ্য ভবিষ্যতে চীনসহ অন্যান্য দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলিকে বিষয়টি আরও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
তথ্যসূত্র : সিএনএন