Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪

ফ্যাসিবাদের গল্প

চিররঞ্জন সরকার। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ফ্যাসিস্ট’ বা ফ্যাসিবাদ বহুল উচ্চারিত শব্দ। আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো শেখ হাসিনার সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট সরকার’ হিসেবে বর্ণনা করছে। যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক কিংবা আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলেছে তাদের ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর’ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণাও ছড়ানো হচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশর রাজনীতিতে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটি কেন ব্যবহার হচ্ছে? প্রকৃতপক্ষে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটি কোথা থেকে এসেছে? শেখ হাসিনার শাসনামলকেই বা কেন ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে?

‘ফ্যাসিজম’ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং গণআন্দোলন, কর্তৃত্বময় শাসন ক্ষমতাই হচ্ছে ‘ফ্যাসিবাদ’-এর মূলমন্ত্র। ‘ফ্যাসিবাদ’-এর ধারণা অনুযায়ী রাষ্ট্রই সর্বময় ক্ষমতা, এখানে ব্যক্তির স্বাধীনতার তেমন কোনও স্থান নেই। এই মতাদর্শে বিরোধীদেরও কোনও স্থান নেই।

১৯১৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা চালু ছিল। ‘ফ্যাসিজম’ ধারণাটির উৎপত্তি হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ইতালিতে, মুসোলিনির হাত ধরে। এরপর এই মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে জার্মানিসহ ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে। জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে ‘নাৎসিজম’ ছিল ‘ফ্যাসিজম’-এর একটি ভয়ঙ্কর রূপ।

ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রশক্তি দেশপ্রেমের সুবিধাবাদী অলীক মিথ জনমানসে ছড়িয়ে বিরোধী মতবাদকে সুকৌশলে দেশবিরোধী বা দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে কারাগারে পচিয়ে মেরে ফেলে এবং সেই সঙ্গে বাকি সমাজকে নানাভাবে তটস্থ করে রাখে। এটাই হলো অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি করার ফ্যাসিবাদী কৌশল। হয় তুমি আমার গুণগান করো, নইলে তুমি দেশ বিরোধী। এই দুইয়ের মাঝখানে কোনও অবস্থানকে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রশক্তি কখনও স্বীকার করে না।

ফ্যাসিবাদী মনস্তত্ত্বের লক্ষণগুলো হলো— নিজের জাতিকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করা, নিজেদের অতীত ইতিহাসের যুগে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা, ভিন্ন গোত্রের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করা, নিজেকে ছাড়া সবাইকে সন্দেহ করা।

ফ্যাসিস্ট শাসকরা যে জন্ম থেকেই ফ্যাসিস্ট তা কিন্তু নয়। অনেক সময় ঘটনাচক্রে জনপ্রিয় শাসকও ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেন। এ প্রসঙ্গে অ্যাডলফ হিটলারের কথা বলা যেতে পারে। জার্মানির সাধারণ মানুষের মনে হয়েছিল হিটলার হবেন এমন শাসক যিনি জার্মানদের সম্মান পুনরুদ্ধার করতে পারবেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত ও অপমানিত জার্মানির পক্ষ থেকে যথোপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারবেন। হিটলারের বক্তৃতা মাতিয়ে দিয়েছিল পুরো জার্মান জাতিকে।

ফ্যাসিবাদী মনস্তত্ত্বের লক্ষণগুলো হলো— নিজের জাতিকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করা, নিজেদের অতীত ইতিহাসের যুগে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা, ভিন্ন গোত্রের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করা, নিজেকে ছাড়া সবাইকে সন্দেহ করা।

অ্যাডলফ হিটলারের বিশ্বখ্যাত আত্মজীবনী ‘মাইন ক্যাম্ফ’-এর ইংরেজি অনুবাদের হার্স্ট অ্যান্ড ব্ল্যাকেট সংস্করণটি ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয়। ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’-এর স্রষ্টা জর্জ অরওয়েল ১৯৪০ সালের ২১ মার্চ ‘নিউ ইংলিশ উইকলি’-তে হিটলারের এই আত্মজীবনীর পর্যালোচনা করেন। সেখানে অরওয়েল লিখেছেন, ‘‘প্রথমে হিটলার ছিলেন মানুষের কাছে এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। হিটলার জার্মান শ্রমিক আন্দোলনকে একদম নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ায় ধনিক শ্রেণি খুব খুশি ছিল।’’

১৯৩৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে খবর আসে যে, রাইখস্ট্যাগ অর্থাৎ জার্মানির সংসদ ভবনে আগুন লেগেছে। সেই আগুনে ২০টা পোড়া মৃতদেহ বের হলো। জার্মানির সংসদ ভবনে সেদিন আগুন কে লাগিয়েছিল, তার নিশ্চিত উত্তর আজও মেলেনি। তবে অভিযোগ আছে, হিটলরের বাহিনীই সেদিন সংসদ ভবনে আগুন দিয়েছিল। কিন্তু সেই রাতেই হিটলার ঘোষণা দিলেন, ‘‘আর কোনও দয়া দেখানো হবে না… প্রতিটি কমিউনিস্ট নেতাকে যেখানে দেখা যাবে গুলি করে মারা হবে। কমিউনিস্ট ডেপুটিদের আজ রাতেই ফাঁসিকাঠে ঝোলানো চাই।’’

পরদিন হিটলারের ক্যাবিনেট বিশেষ বৈঠকে বসে এবং ‘জনসাধারণ এবং রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য’ ডিক্রি জারি হয়। তার মোদ্দা কথা, রাষ্ট্রের হাতে আপৎকালীন ক্ষমতা চাই। অতএব সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিক অধিকারগুলিকে খর্ব করা হবে। সরকার যাকে রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক মনে করবে তাকে বিনা বিচারে বন্দি করা যাবে। পুলিশ কোনও পরওয়ানা ছাড়াই যেকোনও জায়গায় তল্লাশি চালাতে পারবে। বাক্‌স্বাধীনতা ছাঁটাই হবে। বাতিল হবে সভা-সমাবেশ করার অধিকার। রাষ্ট্রকে সুরক্ষিত রাখতে এই সবই দরকার, খুব দরকার। আর রাষ্ট্র সুরক্ষিত না থাকলে দেশের সুরক্ষা বজায় থাকবে কী করে?

এভাবে জার্মানির মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো, হিটলারের হাতে গিয়ে জমা হলো সব ক্ষমতা। ৫ মার্চের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতল নাৎসিরা। প্রথমে কমিউনিস্টদের ধরপাকড় শুরু হলো, তারপর ইহুদিদের। যেকোনও সামান্য বিরোধিতায় দরজায় কড়া নাড়া। এল গেস্টাপো, এসএস, নাৎসি বাহিনী। এবং জার্মানিতে গণতন্ত্রের পরিসমাপ্তি। একনায়ক হয়ে উঠলেন হিটলার!

এখানে একটু মুসোলিনির গল্পও বলা দরকার। বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ে ইতালির এক সাংবাদিক, নিজেকে যিনি সমাজতন্ত্রী বলে পরিচয় দিতেন, ‘ফ্যাসিও দি কম্বাত্তিমেস্তো’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। ‘ফ্যাসিও’ মানে প্রাচীন রোমের কনসালদের সামনে দিয়ে যে দণ্ডটি বহন করে নিয়ে যাওয়া হতো, সেই রীতি। দণ্ডটিকে ‘ফ্যাসেস’ বলা হতো। সেই থেকে ফ্যাসিস্ট, ফ্যাসিবাদের শুরু, মুসোলিনি যার হাল ধরেন পরে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্টদের কার্যক্রম বৃদ্ধি ও বিভিন্ন দেশে বামশক্তির উত্থানে আতঙ্কিত ইতালির ধনিক শ্রেণি তখন ভীত হয়ে ওঠে এবং এর থেকে বাঁচতে মুসোলিনির ওপর ভরসা করতে শুরু করে। এক সময়ের সাংবাদিক ও সোশ্যালিস্ট বলে পরিচয় দেওয়া মুসোলিনি তখন মাত্র ১৩ শতাংশ সমর্থন পেয়েছিলেন নির্বাচনে। তিনি এ অবস্থায় বেছে বেছে সমাজের ভবঘুরে, অপরাধপ্রবণ ছেলে-ছোকরাদের তার দলে যুক্ত করতে শুরু করেন। ইতালিতে অধিকাংশ মানুষ সে সময় বেকারত্ব ও হতাশায় নিমজ্জিত। মুসোলিনি তার চটকদারি প্রচারে খুব দ্রুত জনপ্রিয় হতে থাকলেন। ক্ষমতায় আসার জন্য তিনি যে কোনও ধরনের পথ নিতে পিছপা হননি।

‘ফ্যাসিও’ মানে প্রাচীন রোমের কনসালদের সামনে দিয়ে যে দণ্ডটি বহন করে নিয়ে যাওয়া হতো, সেই রীতি। দণ্ডটিকে ‘ফ্যাসেস’ বলা হতো। সেই থেকে ফ্যাসিস্ট, ফ্যাসিবাদের শুরু, মুসোলিনি যার হাল ধরেন পরে।

‘মিনিটস অব ফ্যাসিস্ট পার্টি’র রেকর্ড থেকে তার নিজের কথায় জানা যায়, ‘‘আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ইতালির নানা প্রান্তে ধর্মীয় দাঙ্গা সৃষ্টি করব, সমগ্র ইতালিজুড়ে প্রাচীন গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য অভিযান চালাব, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের ও দেশের বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন আদায় করব।’’

এ সবই হলো ফ্যাসিবাদের ব্যাকরণ। আজকের ‘পোস্ট ট্রুথ’ যুগে ফ্যাসিবাদীরা আসছে গণতন্ত্রের হাত ধরে। নিজের মহিমা কীর্তন করে হিটলার ‘ট্রায়াম্ফ অব দ্য উইল’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করান। সরকারি প্রোপাগান্ডা কিভাবে করতে হয় তা শেখার জন্য এই ছবিটি দেখা প্রয়োজন। আর এখন তো চার দিকে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি গোয়েবল্স জন্ম নিয়েছে। একে বলা হচ্ছে ‘দ্য রাইজ অব দ্য মিস-ইনফর্মেশন ইন্ডাস্ট্রি’।

গোটা পৃথিবী জুড়েই এখন ‘পোস্ট ট্রুথ’-এর জয়জয়কার। চার্লি চ্যাপলিনের ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ দেখে হিটলার তার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিছু দিন আগে প্রকাশিত পিটার অ্যাক্রয়েড চার্লির জীবনীতে মিলেছে একটি নতুন তথ্য: নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও নিজের ঘরের মধ্যে একা একা চার্লি চ্যাপলিনের এই ছবিটি হিটলার দু’বার দেখেছিলেন!

আজ পৃথিবীর দেশে দেশে ‘জনপ্রিয়তম’ নেতারা ক্ষমতায় আসীন। তারা বীর-বিক্রমে দাপট দেখিয়ে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার নেশায় মত্ত আছেন। প্রতিনিয়ত দেশবাসীকে নসিহত করছেন। পাশাপাশি রয়েছে কর্মহীন, দুঃখী প্রজন্ম। প্রতিবাদ করলেই তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে। এই স্ববিরোধী দৃশ্যপটের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়, হিটলার-মুসোলিনিরা কেউ অতীত নয়। তারা কোনও ব্যক্তি নন। এক সামাজিক-রাজনৈতিক প্রবণতার মুখপাত্র তারা। মানবজমিনে তারা নব নব রূপে আসেন। আবার তাদের করুণ বিদায়ও হয়। কখনও গণআন্দোলনে, কখনও ষড়যন্ত্রে।

ফ্যাসিবাদী লক্ষণ আর ফ্যাসিবাদ কিন্তু এক নয়। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র মহাশক্তিধর হয়ে থাকে, ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণও তার হাতে থাকে। ভারতে মোদীরও সে ক্ষমতা নেই। এমনকি আমেরিকায় ট্রাম্পেরও নেই।

বর্তমান পৃথিবীর অনেক দেশেই চরমপন্থার বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেক দেশের নিজস্ব ইতিহাস যেমন তার জন্য দায়ী, তেমনই, অর্থনীতির অসাম্য একটা বড় কারণ। যত বেশি করে সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে অল্প কয়েক জনের হাতে, জনসংখ্যার বিরাট বঞ্চিত অংশের মধ্যে জমছে রাগ আর হতাশা। ক্ষমতাসীনরা নিজের মতো করে সেটা কাজে লাগাচ্ছেন। শরণার্থী, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের শত্রু বলে দাগিয়ে দিচ্ছেন।

তবে এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার, যে কথাটা ২০২০ সালে প্রবীণ মার্কিন ভাষাবিদ ও তাত্ত্বিক নোম চমস্কি মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘ফ্যাসিবাদী লক্ষণ আর ফ্যাসিবাদ কিন্তু এক নয়। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র মহাশক্তিধর হয়ে থাকে, ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণও তার হাতে থাকে। ভারতে মোদীরও সে ক্ষমতা নেই। এমনকি আমেরিকায় ট্রাম্পেরও নেই।’’ বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে শেখ হাসিনারও তা ছিল না।

শেষ কথা হলো, রাজনৈতিক দল নয়, ফ্যাসিবাদের স্বরূপ উন্মোচন করে, তার বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে কেবল সদা জাগ্রত নাগরিক সমাজ। যেকোনও শাসকের অন্যায্য সিদ্ধান্ত, অগণতান্ত্রিক আচরণ ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি দুর্বল করে দেওয়াই ফ্যাসিবাদের পথ প্রশস্ত করে— এই সারসত্য বুঝে নাগরিক উদ্যোগকে প্রতিবাদের পথে স্থির থাকতে হবে।

এ প্রতিবাদ হতে হবে যেকোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে। বাছাই করা প্রতিবাদ অংশগ্রহণকারীদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী প্রচারকেও বিপথগামী করবে।

লেখক: লেখক ও কলামিস্ট।
ইমেইল: [email protected]

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত