মিনিটখানেক ধরে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়ে কাশ্মীরের পহেলগামের বৈসরণ উপত্যকায় কেড়ে নেওয়া হয় ২৬ জনের প্রাণ। ছুটিতে তারা ঘুরতে গিয়েছিলেন ভারতের সবচেয়ে নয়নাভিরাম এই উপত্যকায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মঙ্গলবারের এই ঘটনায় ভারতের প্রতিক্রিয়ায় যেমন আগের অভিজ্ঞতার প্রভাব থাকবে, তেমনি বর্তমান চাপও বড় ভূমিকা রাখবে।
পহেলগামের ঘটনায় প্রতিক্রিয়ার শুরুতেই দ্রুত কয়েকটি প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে দিল্লি।
তারা সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করেছে; দু’দেশের একমাত্র বাণিজ্য পথ আটারি-ওয়াগা সীমান্ত বন্ধ করেছে; দিল্লিতে পাকিস্তানের হাই কমিশনে নিযুক্ত কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে; ইসলামাবাদে ভারতের হাই কমিশনে নিযুক্ত ভারতীয় কর্মকর্তাদের ফেরত এনেছে।
এছাড়া দু’দেশের হাই কমিশনগুলোতে কর্মরতদের সংখ্যা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০ করা এবং পাকিস্তানিদের সার্ক ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এসবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের পাকিস্তানকে কঠোর জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার।
তিনি শুধু হামলাকারীদেরই নয়, বরং ভারতের মাটিতে এই নিন্দনীয় কাজের নেপথ্য পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশ্ন এখন আর এটা নয় যে, ভারতের দিক থেকে সামরিক প্রতিক্রিয়া আসবে কি না?
বরং প্রশ্ন হলো, সেটা কখন আসবে, কতটা পরিকল্পিতভাবে আসবে আর কত মূল্য চুকাতে হবে?
সামরিক ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন বিবিসিকে বলেন, “আমরা সম্ভবত দিল্লির দিক থেকে দৃঢ় প্রতিক্রিয়া দেখতে যাচ্ছি, যার মধ্য দিয়ে ভারতের জনগণ এবং পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট মহল উভয়কেই স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হবে।
“২০১৬ সালে, বিশেষ করে ২০১৯ সালে হামলার জবাবে সীমান্তের বাইরে বা আকাশপথে হামলা চালিয়ে প্রতিশোধের মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়। এই মানদণ্ডের নিচে নামা এখন ভারত সরকারের পক্ষে কঠিন। পাকিস্তান আগে যেমন হামলার জবাব দিয়েছে, এবারও সেভাবে দিতে পারে।”
“দুই পক্ষের দিক থেকে ভুল সিদ্ধান্তের ঝুঁকি বরাবরের মতো এবারও আছে,” বলেন তিনি।
ইতিহাসবিদ রাঘবনের এই বক্তব্যে ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিক্রিয়ামূলক হামলার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরি শহরে সন্ত্রাসী হামলায় ১৯ জন ভারতীয় সেনা হত্যার জবাবে সীমান্তের বাইরে গিয়ে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায় ভারত।
তারা সেসময় বলেছিল, নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে জঙ্গি ঘাঁটি তাদের অভিযানের লক্ষ্য।
এরপর ২০১৯ সালে ভারতশাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামা শহরে সন্ত্রাসী হামলায় কমপক্ষে ৪০ জন আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য হত্যার বদলা নিতে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বালাকোট শহরে বিমান হামলা করে বসে ভারত।
১৯৭১ সালের পর সেই প্রথম পাকিস্তানের ভূ-খণ্ডের এত ভেতরে আক্রমণ করেছিল দিল্লি।
দুই বছর পর ২০২১ সালে নিয়ন্ত্রণ রেখায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় দু’পক্ষ, যা মোটের ওপর বজায় রয়েছে। যদিও ভারতশাসিত কাশ্মীরে জঙ্গি হামলা মাঝেমাঝেই হচ্ছে।
পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, মঙ্গলবার পহেলগামে পর্যটকদের লক্ষ্য করে হামলার ঘটনা যে ইঙ্গিত দিচ্ছে তা হলো, দিল্লি যদি হামলায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার প্রমাণ পায় বা এমন ধারণাও করে, তাহলে ভারতের তরফ থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিক্রিয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “ভারত সরকারের জন্য এমন প্রতিক্রিয়ার মূল সুবিধা হবে রাজনৈতিক, কারণ দেশজুড়ে শক্ত প্রতিক্রিয়ার জন্য তার ওপর জনমতের চাপ থাকবে প্রবল।
“ভারতের আরেকটি সম্ভাব্য সুবিধা হলো, যদি প্রতিশোধমূলক হামলা সাফল্যের সঙ্গে জঙ্গি লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে পারে, তাহলে তা ভারতবিরোধী হুমকি কমিয়ে আনার পাশাপাশি আবারও প্রতিরোধক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করবে।
“তবে এর অসুবিধাও রয়েছে। এ ধরনের প্রতিক্রিয়া থেকে গুরুতর সংকট এমনকি সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।”
ভারতের বিকল্পগুলো কী কী
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালবানি ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি বলেন, অভিযান গোপন হলে তা অস্বীকার করার সুবিধা রয়েছে। তবে তা প্রতিরোধক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে রাজনৈতিক চাহিদা, তা পূরণ নাও করতে পারে।
এমন প্রেক্ষাপটে ভারতের সামনে দুটি সম্ভাব্য পথ খোলা রয়েছে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।
প্রথমত, ভারত ও পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের মধ্যকার নিয়ন্ত্রণ রেখায় ২০২১ সালে হওয়া যুদ্ধবিরতি না মেনে নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে পারেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
ভারতের সামনে দ্বিতীয় রাস্তা হতে পারে, ২০১৯ সালে পুলওয়ামা ঘটনার মতো বিমান হামলা বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। এই দুটির যেকোনো একটি হলে পাল্টা হামলা হতে পারে।
অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি বলেন, “কোনও পথই ঝুঁকিমুক্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্রও বর্তমানে অন্য ইস্যুতে ব্যস্ত। তারা হয়তো এই সংকট মোকাবেলায় সাহায্য করতে চাইবে না বা পারবে না।”
বিবিসির সাংবাদিক সৌতিক বিশ্বাসের মতে, ভারত-পাকিস্তানের যেকোনো সংকটে সবচেয়ে গুরুতর ঝুঁকিগুলোর একটি হলো, উভয় দেশই পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত।
এই বাস্তবতা তাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তের ওপর গভীর ছাপ ফেলে, যা কেবল সামরিক কৌশল নয়, রাজনৈতিক হিসাবনিকাশকেও প্রভাবিত করে।
ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন বলেন, “পারমাণবিক অস্ত্র একদিকে যেমন বিপজ্জনক, তেমনি অন্যদিকে বাধার কাজও করে। ফলে তা উভয় পক্ষের সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে।
“প্রতিক্রিয়া যাই হোক না কেন, তা সঠিক এবং লক্ষ্যভিত্তিক হবে। পাকিস্তান পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে, তারপর উত্তরণের পথ খুঁজবে তারা।”
“আমরা বিশ্বের অন্যান্য সংঘর্ষেও এমন প্যাটার্ন দেখেছি। যেমন ইসরায়েল-ইরানের সুনির্দিষ্ট হামলা; তারপর তাদের উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা। তবে ঝুঁকি থাকে যে, সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোতে নাও পারে,” যোগ করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানির ধারণা, এবার সংঘাতের মাত্রা বাড়তে পারে। ভারত সম্ভবত ২০১৬ সালের মতো সীমিত ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালানোর কথা ভাবতে পারে।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের হামলার সুবিধা হলো, এগুলো সীমিত পরিসরে চালানো হয়। ফলে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া জানানো জরুরি হয়ে ওঠে না, কিন্তু ভারতের জনগণের কাছে এটা দেখানো যায় যে, সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে।
“তবে এমন হামলা পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ডেকেও আনতে পারে। কারণ ইসলামাবাদ দাবি করছে, পহেলগামের ঘটনায় কোনও ধরনের তদন্ত বা প্রমাণ ছাড়াই ত্বরিত প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে তাদের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে।”
তথ্যসূত্র : বিবিসি