গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন পুনর্গঠন ও সংস্কারের জন্য গঠিত আহ্বায়ক কমিটি থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন মামুনুর রশীদ। সংগঠনের সদস্যদের কাছে এক চিঠিতে এ আবেদন জানিয়েছেন তিনি।
কোন প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত চিঠিতে বর্ণনা করেছেন তার বিস্তারিত। চিঠিটির সত্যতার বিষয়ে সকাল সন্ধ্যাকে নিশ্চিত করেছেন মামুনুর রশীদ।
দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের জের ধরে সবক্ষেত্রেই চলছে সংস্কার। মঞ্চনাটকের দলগুলোর সম্মিলিত প্লাটফর্ম গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
সংগঠনটির সভাপতি পদে থাকা বিতর্কিত লিয়াকত আলী লাকিকে অব্যাহতি দিয়ে সংগঠন সংস্কারের লক্ষ্যে ২৫ অক্টোবর একটি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভাতেই লাকী ইনামকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও মামুনুর রশীদকে আহ্বায়ক করে তার নেতৃত্বে একটি কমিটি অনুমোদিত হয়।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অধ্যাপক মলয় ভৌমিক, আহমদ ইকবাল হায়দার, নাদের চৌধুরী ও নাজনীন হাসান চুমকি। ফেডারেশনের স্থায়ী সদস্য ২৩২টি নাট্য সংগঠনের মধ্যে ১৯১টির প্রতিনিধিরা সভায় উপস্থিত ছিলেন।
সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ফেডারেশন পুনর্গঠনের সকল সিদ্ধান্ত আহ্বায়ক কমিটিই নিবে। পাশাপাশি রুটিনমাফিক কাজ করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটিও বহাল থাকবে।
তবে, বাস্তবে তা প্রতিফলিত হয়নি বলেই পুরো কমিটি নিয়েই সরে দাঁড়াতে চাইছেন মামুনুর রশীদ। চিঠিতে তিনি অভিযোগ করেন, আহ্বায়ক কমিটির কাজে হস্তক্ষেপ করছে কেন্দ্রীয় কমিটি।
তবে, বিষয়টি বেশিদূর গড়াতে দিতে চায় না কেন্দ্রীয় কমিটি। সমঝোতা চাইছেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজিদ। বুধবার সকালে এই বিষয়ে মামুনুর রশীদের সাথে ফোনে বিষয়টি নিয়ে সমঝোতা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “মামুনুর রশীদ আমাদের নাট্যগুরু, সর্বজন শ্রদ্ধেয়। কাজ করতে গেলে কিছু ভুল ত্রুটি হয়ই। সে জায়গায় আমাদেরও কিছু ভুল ত্রুটি হতে পারে। তবে, চিঠিতে তিনি কিন্তু অব্যাহতি নেননি, চেয়েছেন। আমরা ওনাকে ছাড়ছি না। সকালেই ওনার সাথে কথা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সমঝোতা হয়েছে। তার নির্দেশ ও পরামর্শক্রমেই আমরা এগুবো।”
কামাল বায়েজীদ আরও বলেন, “দেশের এখন সংকটকাল। নাট্যদলগুলো নাট্যচর্চা করতে পারবে কিনা তা নিয়ে নানা সংকট চলছে। সে জায়গায় আমরা চাই ঐক্যবদ্ধ থেকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে। আগামী নব্বই দিনের মধ্যে সংগঠন সংস্কার ও পুনর্গঠনের কাজটি সমাপ্তির ব্যাপারে মামুন ভাইর সাথে কথা হয়েছে।”
তবে, সমঝোতার বিষয়টি নাকচ করে করেছেন মামুনুর রশীদ।
“আমার সাথে ফোনে কথা হয়েছে এটি সত্য। তবে, কোন সমঝোতা হয়নি। আমার সাথে ওরা দেখা করতে চেয়েছিল। আমি আগামী সপ্তাহে আসতে বলেছি, সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন।
চিঠিতে মামুনুর রশীদ যে অভিযোগ করেছেন তা জানাতে পুরো চিঠিটি পাঠকের জন্য তুলে ধরা হল-
প্রিয় সহকর্মী বন্ধুগণ,
সম্প্রতি বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান এর একটি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ১৯১ জন থিয়েটার প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। ফেডারেশনের নিষ্ক্রয়তা, অর্ন্তবিরোধ নিরসন এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটির কার্যক্রম পুনরায় কি করে শুরু করা হবে সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানান বিতর্কের পর ফেডারেশান পুর্নগঠনের জন্য একটি আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়। ওই দিন সাধারণ সভার আগে কেন্দ্রিয় কমিটির একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত প্রতিনিধিদের সামনে কেন্দ্রিয় কমিটির প্রস্তাবগুলি উত্থাপন করা হয় এবং সেই সাথে নানান দিক আলোচনা করে একটি আহবায়ক কমিটি গঠিত হয় যার আহবায়ক করা হয় আমাকে। সেই সঙ্গে রুটিনমাফিক কাজ করার জন্য কেন্দ্রিয় কমিটিকেও রাখা হয়। কিন্তু এ কথাও বলা হয় যে, ফেডারেশানের পুর্নগঠনের জন্য সকল সিদ্ধান্ত আহবায়ক কমিটিই নেবেন।
এই কাজে কেন্দ্রিয় কমিটি আহবায়ক কমিটিকে সহায়তা করবে। আমি এবং সাধারণ সভায় নির্বাচিত তিনজন সদস্য মলয় ভৌমিক, আহমদ ইকবাল হায়দার, নাদের চৌধুরী ও আমাদের মনোনীত সদস্য নাজনীন হাসান চুমকিকে নিয়ে কাজ শুরু করি। এ যাবৎ কেন্দ্রিয় কমিটির সাথে তিনটি সভা হয় এবং আমাদের কার্যক্রমও চলতে থাকে।
প্রথমেই ফেডারেশানকে আরো সক্রিয় করার স্বার্থে সকল দলের কাছে তিন বছরের কার্যক্রমের একটি বিবরণী চেয়ে পাঠানো হয়। কোনো কোনো সংগঠনের বিবরণী ইতিমধ্যেই আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। এ দিকে নাট্যদলগুলির কার্যক্রম পাঠানোর বিষয়ে কেন্দ্রিয় কমিটির কিছু সদস্যের বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। উপরন্ত ইতিমধ্যে কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য তপন হাফিজ আবার একটি তথ্য পাঠানোর অনুরোধ করেন। ফলে আবারও নতুন করে প্রশ্ন জাগে। অথচ সম্পুর্ন কাজটি আমাদেরই করার কথা ছিল।
রুটিন ওয়ার্ক এর বিষয়ে একটি নতুন ব্যাখা উপস্থাপন করেন কামাল বায়েজিদ। কেন্দ্রিয় কমিটির নিয়মিত সভা এবং কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ারও তারা এককভাবে ঘোষণা করেন।। ইতিমধ্যে দেশ নাটকের প্রদর্শনী বন্ধ হবার পর ফেডারেশন থেকে আমরা একটি প্রতিবাদী সমাবেশের ব্যবস্থা করি। সেই প্রতিবাদী সমাবেশে দেশ নাটকে হামলাকারীরা পুনরায় আক্রমণ করে এবং তাৎক্ষনিকভাবে আমরা ১৫ই নভেম্বর একটি প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দেই।
পরের দিন সেখানে আরণ্যকের কম্পানী নাটকের প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়া হয় এবং সারা দেশে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশের কর্মসূচী গ্রহণের আবহান জানানো হয়। পরের দিন কেন্দ্রিয় কমিটিকে এবং বিভিন্ন সদস্যদলকে নিয়ে প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়। প্রেস কনফারেন্সটি হয় এবং ওই দিনের হামলাকারীরা যথারীতি শিল্পকলা একাডেমির গেটে আবার উত্তেজনার সৃষ্টি করে। যাই হোক বাংলাদেশের কোথাও কোথাও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তেমন কোনো বিক্ষোভ প্রদর্শনের ঘটনা ঘটেনি।
তবে ১৪ নভেম্বর আরণ্যক নাট্যদল একটি প্রতিবাদী সভা ও পথনাটকের প্রদর্শনী করে প্রাচ্যনাটকে সঙ্গে নিয়ে। এরপরেই কামাল বায়েজিদ দুটি ফেসবুক পোস্ট দিয়ে ১৫ নভেম্বরের সমাবেশ বাতিল করে দেয় এবং সংস্কৃতি উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করে। এসব ঘটনার বর্ণনা থেকে নিশ্চয়ই বোঝা যায় আহবায়কদের কর্মপদ্ধতির সাথে কেন্দ্রিয় কমিটির পদ্ধতিগত কিছু সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্যে আবার একটি যৌথ সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় ইতিমধ্যে সংগঠিত ফেডারেশনার নির্বাহী কমিটির অর্ন্তগত কিছু বিরোধ এক পর্যায়ে বচসায় পরিনত হয়। কিন্তু এ অবস্থায় আবারও সকলকে মনে করিয়ে দেয়া হয় যে যেকোনো বিষয়ে আহবায়কদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
পরবর্তীকালের কর্মকান্ড এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের বিভিন্ন মন্তব্য থেকেই এই বিষয়গুলি আপনাদের কাছে স্পষ্ট হবে। এমতাবস্থায় আমরা মনে করি আহবায়ক কমিটির পক্ষে সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। সুতরাং আমাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে যোগ্যতর কোনো ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিগণদ্বারা এই দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা করে ভবিষ্যতে ফেডারেশানকে সুন্দর ও সুচারুভাবে পরিচালনার পথ অনুসন্ধান করা
উচিত।
ধন্যবাদান্তে-
মামুনুর রশীদ আহবায়ক
১৯ নভেম্বর ২০২৪