জগতে আছে দু’রকমের সুখ- হেডোনিক এবং ইউড্যায়মনিক। তবে সুখের একটিমাত্র ধরনই স্থায়ী হয়। কিন্তু মনোবিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল একটিতেই রয়েছে চিরসুখী হওয়ার মন্ত্র।
হেডোনিক হ্যাপিনেস
সত্তরের দশকের যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত ট্রেন্ড ছিল- ড্রাগস, সেক্স এবং রক অ্যান্ড রোল। এর মানেটা খুব সোজা। জীবনে সুখ পেতে চাও, তবে এই তিনের মাঝে ডুব দাও। আর এই শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহার করেন ‘লাইফ’ গ্রন্থের লেখক অ্যাডওয়ার্ড কার্ন। অর্থাৎ, ইন্দ্রিয় সুখকেই এখানে সকল সুখের মূল বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য কিন্তু নয়! এদিকে ‘হেডোনিক’ সুখ বলতে সেই ইন্দ্রিয় সুখের কথাই বলা হচ্ছে।
‘হেডনিক সুখ’ এর প্রথম ধারণা দেন খ্রিস্টের জন্মের ৪০০ বছর আগে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিসটিপ্পাস। তিনি বলেন, জীবনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত আনন্দের মাত্রাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপভোগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া। হবস এবং বেন্থামসহ ইতিহাসের অনেক দার্শনিকই এই হেডোনিক মতাদর্শকেই অনুসরণ করেছেন। হেডোনিক সুখের পক্ষের মনোবিজ্ঞানীরা মন ও শরীর দুইয়ের সামঞ্জস্য করে একে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, শরীরকে কম কষ্ট দিয়ে মনের সর্বাধিক আনন্দ খোঁজার ব্যাপারগুলোতে জোর দেন তারা।
আমেরিকান সংস্কৃতিতে, হেডোনিক সুখ প্রায়শই চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে চ্যাম্পিয়ন হয়। জনপ্রিয় সংস্কৃতি জীবনের বহির্মুখী, সামাজিক, আনন্দময় দৃষ্টিভঙ্গি চিত্রিত করে। ফলে, আমেরিকানদের বেশিরভাগই বিশ্বাস করেন যে হেডোনিজম তার বিভিন্ন আকারে সুখ অর্জনের সর্বোত্তম উপায়।
মানুষ প্রায়ই সুখকে আনন্দের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। আর গুলিয়ে ফেলে বলেই, জীবনভর আশা করে অন্তহীন সুখ। অথচ আনন্দ একটি সাময়িক অনুভূতি। মানুষের জীবনে সাময়িক আনন্দ হয়ে হাজির হয় এমন অনুভূতিগুলোই আসলে ‘হেডনিক হ্যাপিনেস’। এই অনুভূতিগুলো ব্যক্তিকে উত্তাল ইন্দ্রিয় সুখের এমন এক রাইডে চড়িয়ে দেয় যে, সুখের চাহিদা তার দিন দিন বাড়তেই থাকে। ‘হেডোনিক হ্যাপিনেস’ তাই সুখের ভেক ধরে থাকা আনন্দের অসুখ।
তাছাড়া বাজার অর্থনীতির এই দুনিয়ায় ‘সুখ কিনতে পাওয়া যায়’ এমন ধারণা বেশ চালু আছে। আর এ জন্য বাজারে রাখা আছে অসংখ্য পণ্য বা সেবা- ‘এক্সটিক’ কোন খাবার, বিলাসবহুল রিসোর্ট, হোটেল, ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি, ট্রেন্ডি পোশাকসহ আরও কত কী!
আজকের এই বৈষয়িক পৃথিবীতে উপরের সবগুলো থাকলেই কি কেউ একজন ‘সব পেয়েছি’ দাবি করতে পারেন?
উত্তর হল ‘না’।
বরং সমাজ ব্যক্তির ভেতর কৃত্রিম নানা চাহিদা চাপিয়ে দেয়। যেগুলোকে ‘সুখ’ বলে ধরে নেওয়া হয়। ঘুরে ফিরে সেই ‘হেডোনিক হ্যাপিনেস’ তাই সবাইকে গ্রাস করতে থাকে। যেগুলোর নেই কোন স্থায়িত্ব, নেই চাহিদা বা জোগানেরও কোন শেষ। তাহলে স্থায়ী সুখ মানুষ কোথায় পাবে?
ইউড্যায়মনিক হ্যাপিনেস
সুখের আরেক ধরন ইউড্যায়মনিক হ্যাপিনেস, যেটি মানুষকে ব্যক্তিগত আনন্দ থেকে নিয়ে যায় আরও বৃহৎ পরিসরে। মানুষ খুঁজে বেড়ায় জীবন এবং সম্পর্কের গূঢ় অর্থ। সুখের এই পর্যায়টি ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সংযোগ ঘটায়। ফলে একটি সামষ্টিক ‘ভালো’র জন্য শান্তি খোঁজে ব্যক্তি। ইউড্যায়মনিক হ্যাপিনেস তাই সাময়িক আনন্দের বদলে চিরস্থায়ী শান্তির প্রস্তাব দেয়।
অন্যকে দান, ছাড় দেওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ যে অনুভূতি লাভ করে তার মাধ্যমেই ইউড্যায়মনিক হ্যাপিনেস অথবা সত্যিকার সুখ অর্জন সম্ভব। ইউড্যামনিয়া শব্দটিও খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ শতকে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টোটল তার ‘নাইকোম্যাকিয়ান এথিকস’ গ্রন্থে এটি প্রথম ব্যবহার করেন। তার মতে, মানুষের বেঁচে থাকা উচিত প্রজ্ঞার জন্য। তিনি দাবি করেন, মানুষ সবসময় তার নিজের ভেতরের সম্ভাবনা অন্বেষণে চেষ্টা করে এবং নিজের সর্বোত্তম সত্তায় পৌঁছাতে চায়, যা তাকে বড় ও অর্থবহ লক্ষ্য পূরণের দিকে নিয়ে যায়।
ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর এলিজাবেথ ডান তার এক নিবন্ধে দেখিয়েছেন যে নিজের জন্য খরচ করার চাইতে অন্যকে দান করার মনোভাব মানুষের ভেতর ভালো থাকার অনুভূতি বাড়ায়। আর এটি প্রমাণ করতে তাকে এক জরিপ চালাতে হয় । জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের এক পক্ষকে কিছু অর্থ দিয়ে তা অন্যের জন্য খরচ করতে বলা হয়। আর আরেক পক্ষকে কিছু অর্থ দিয়ে তা নিজের জন্য ব্যয় করতে বলা হয়। ফলাফলে দেখা যায়, যারা অন্যের জন্য খরচ করেছে তাদের মধ্যে সুখের অনুভূতি নিজের পেছনে খরচ করা পক্ষের চাইতে বেশি।
আমেরিকান নিওরোসাইকোলজিস্ট জর্ডান গ্রাফটম্যানসহ আরও অনেকেই তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন দান-খয়রাতের মনোভাব, ভোগের মনোভাবের চাইতে বেশি সুখের অনুভূতি সৃষ্টিতে সক্ষম।