শনিবারে শনির দশা লেগেছে বাফুফে ভবনে। এক ঝাঁক সাবেক ফুটবলার বাফুফে ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে কাজী সালাউদ্দিনের কমিটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সারিতে ছিলেন ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব, গোলাম গাউস, ইকবাল হোসেন, জাকির হোসেন, আলফাজ আহমেদ, ওয়ালী ফয়সাল, জাহিদ হাসান এমিলি, মামুনুল ইসলাম, বিপ্লব ভট্টাচার্য্যসহ অনেকে।
ফুটবলের বর্তমান কমিটির ওপর তারা অনাস্থা এনেছেন। বাফুফেতে চাকরি হারানো গোলরক্ষক বিপ্লব পদত্যাগী সিনিয়র সহ সভাপতি সালাম মুর্শেদীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “যিনি (সালাম) পদত্যাগ করেছেন তিনি সকল হিসাব বুঝিয়ে দিয়েছেন কিনা আমরা জানি না। এখন যারা আছেন তাদেরও সসম্মানে দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়া উচিত। আমরা চাই সমাজের সর্বস্তরের মতো বাফুফেতেও পরিবর্তন আসুক।”
দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে এখন বিভিন্ন জায়গায় পদত্যাগের হিড়িক চলছে। বাফুফের সিনিয়র সহ সভাপতি সালাম মুর্শেদীও পদত্যাগ করেছেন দুদিন আগে। বাকিরা আছেন বহাল তবিয়তেই। তাদের পদ নাড়িয়ে দিতে রোববার আরেকদল ডাক দিয়েছে ‘মার্চ টু বাফুফে’র। বিশেষ করে ১৬ বছরের ‘নিষ্ফলা’ বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হবেন তারা।
ভাঙচুরের বিনিময়ে চেয়ার আঁকড়ে থাকতে চান
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ফুটবল আল্ট্রাস কাজী সালাউদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে বাফুফে ভবনের সামনে এক মানববন্ধন করেছে। রোববার আবারও এই সমর্থকগোষ্ঠী একই দাবি নিয়ে হাজির হবে প্রকান্ড আকারে। বাফুফেও নির্বিকার থেকে এটাকে এক রকম স্বাগত জানাবে। কারণ তারা চায়, সমর্থকরা ভাঙচুর করলে ফিফার কাছে নালিশ দেওয়া যাবে। এখানে যে ফুটবলের পরিবেশ নেই, সেটা দেখাতে পারবে ফিফার। তাতে ফিফার নিষেধাজ্ঞা নেমে আসতে পারে বাংলাদেশের ওপর। তাই জাহিদ হাসান এমিলির আহবান, “কোনও ভাঙচুর ছাড়া বাফুফে ভবনে পরিবর্তনটা হোক নিয়মতান্ত্রিকভাবে।”
এর আগেও জোর-জবরদস্তি নির্বাহী কমিটি ভেঙ্গে দেওয়ায় বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করেছিল ফিফা ২০০২ সালে। সালাউদ্দিনও এখন পদত্যাগ না করে সেই খেলা খেলার জন্য বসে আছেন। তার পদত্যাগের দাবি ভাঙচুর ও সহিংসতায় রূপ নিলে বাফুফে সভাপতি খেলবেন ফিফা নিষেধাজ্ঞার কার্ড।
দুর্নীতি-অনিয়মের বেড়াজালে বাফুফে
বাফুফের গত দুটো বছর কেটেছে বিতর্ক, অনিয়ম আর জালিয়াতির আনুষ্ঠানিক সিলমোহরে। বাফুফেতে এই অপকর্ম চলছিল অনেক দিন ধরে। ফিফা ফান্ডের অর্থও নয়ছয় করছিল তারা আগে থেকেই। তার বড় উদাহরণ সিলেট বিকেএসপি। ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর পাচঁ মন্ত্রীকে নিয়ে সিলেট বিকেএসপিকে বাফুফে একাডেমিতে রূপ দিয়েছিল যা ১ বছর পর মুখ থুবড়ে পড়ে। এজন্য ফিফা দিয়েছিল ৭ লাখ ডলার ! এছাড়াও আর্থিক অনিয়মের উদাহরণ আছে ভুরি ভুরি। স্থানীয় গণমাধ্যমে এসব তুলে ধরলেও কাজী সালাউদ্দিন ও তার সঙ্গী-সাথীরা মিথ্যা বলে গলাবাজি করে গিয়েছিলেন দীর্ঘদিন। এমনকি গণমাধ্যমের কিছু প্রতিবেদন ‘অসত্য, মানহানিকর’ দাবি করে ১৮ জনকে বিবাদি করে বাফুফে প্রধান গিয়েছিলেন আদালতেও।
শেষমেষ ২০২৩ সালে ফিফাই বাফুফের গায়ে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির সিলমোহর লাগিয়ে দেয় সাবেক বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে নিষিদ্ধ করে। জাড়িত বাফুফের আরও কয়েকজন নির্বাহীকে এবছর নিষিদ্ধ করে এবং সোহাগের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ায় ফিফা। একই সঙ্গে বাফুফের অর্থ কমিটির চেয়ারম্যান ও সিনিয়র সহ সভাপতি সালাম মুর্শেদীকে জরিমানা করে ফিফা।
বাফুফে এমন আস্থাহীন সংস্থায় রূপ নিয়েছে, গত বছর মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন, সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে।
সালাউদ্দিন-নাবিলের আগ্রহ জুতা-জাঙ্গিয়ায়
এমন অনিয়ম, দুর্নীতির পরও কাজী সালাউদ্দিনকে কখনও জবাবদিহি করতে হয়নি। কারণ নির্বাহী কমিটির সদস্যরা সবসময় জ্বি হুজুর করে গেছেন। শুধু গণ মাধ্যমের প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে তাকে। তাই তার যত ক্ষোভ সাংবাদিকদের ওপরই। নিজের অজান্তেই তা বেরিয়ে আসে ২০২৩ সালে ২ মে’র এক ব্রিফিংয়ে। আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং শুরুর আগে আরেক সহ সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদের সঙ্গে তার কথোপকথনে ধরা সাংবাদিকদের রেকোর্ডারে। সালাউদ্দিনের মন্তব্য, “জার্নালিস্ট এখানে (বাফুফে ভবনে) ঢুকতে গেলে তাদের বাপের ছবি দিতে হবে। কন্ডিশন হলো, বাপের একটা জুতা পরা ছবি পাঠাতে হবে। ঠিক আছে ? এটা ম্যান্ডেটরি। আমার এখানে সাংবাদিকদের বাপের জুতা পরা ছবি থাকতে হবে।” তার জবাবে সহ সভাপতি কাজী নাবিল হাস্যরস করেন করে নিজের ইচ্ছার কথা বলেছিলেন, “আমার চাওয়া ভিন্ন। সাংবাদিকরা জাঙ্গিয়া পরে আসে কিনা সেটা দেখে এখানে ঢুকতে দেওয়া হবে।”
তাদের কর্থাবার্তার ছিরি দেখে সবাই যারপরনাই বিস্মিত। অনেকের কাছে এটা বর্ণবাদী আচরণ মনে হলেও, কেউ ভাবেন অন্যভাবে। কেউ আবার মজা করে বলেছিলেন, দুই প্রধান কমকর্তার মানুষের জুতা ও অন্তর্বাসের প্রতি এত আগ্রহের কারণেই ফুটবলে নজর দিতে পারছেন না ! যদিও পরে তারা ক্ষমা চেয়েছিলেন।
খেলাটা গেছে গোল্লায়
দুর্নীতি-অনিয়ম আর বিতর্ক এমনভাবে জড়িয়ে থাকলে মাঠের খেলা তো অধোপাতে যাবেই। ফুটবল নিয়ে তাদের বিশেষ কোনও ভাবনা দেখা যায়নি কখনো। একসময় বাংলাদেশ ছিল এই উপমহাদেশের পরাশক্তি। তাদের সঙ্গে লড়াইটা হতো ভারতের সঙ্গে। সেই জায়গা থেকে নামতে নামতে ২০০৩ সালের সাফজয়ী দলের র্যাঙ্কিং এখন ১৮৪। ২০০৯ সালে সাফের সেমিফাইনালে ওঠার ১৪ বছর পর ২০২৩ সালে সেমিফাইনাল খেলে বাংলাদেশ।
সালাউদ্দিনের আমলে ১৬ বছরে জাতীয় দলের কোচ বদল হয়েছে ২৩ বার। কখনো দেশি, কখনো-বা বিদেশী। কিন্তু কোনও ফল আসেনি। আসলে দেশে ফুটবলার তৈরির কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই আর এভাবে এগোলে মাঠে ফল পাওয়া বড় কঠিন।
২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সালাউদ্দিনের মাথায় কি যেন ভর করেছিল ! হঠাৎ বয়ান দিলেন “বাংলাদেশের ৫০ বছরের সেরা জাতীয় দল এটিই।” তাহলে আগের দলগুলো? সালাউদ্দিন, এনায়েত, চুন্নুসহ অনেক তারকা সন্নিবেশিত দলগুলো? কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর! তবে মাঠে সেরার কিছু দেখা যায়নি ওই দলে। তার আগে আরেকবার তিনি বিশ্বকাপের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ২০১৩ সালে কাজী সালাউদ্দিন বলেছিলেন “২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপ খেলবে বাংলাদেশ”। এরপর সবাই হেসেছিল। কিন্তু তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বিশ্বকাপের রোডম্যাপ করবেন, সে অনুযায়ী এগিয়ে যাবে দেশের ফুটবল।
পরিশেষে
সবই ধোঁকা। বাস্তবে কিছুই এগোয়নি ফুটবল। তাই সালাউদ্দিনের পতনের সুর বেজে উঠেছে বাফুফে প্রাঙ্গনে। যাদের কল্যাণে এত দাপট ছিল, ভোটের মাঠে ভয় দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দিতেন, নানা কায়দা-কানুন করে চেয়ারটা আঁকড়ে রাখতেন সেই প্রভুদের প্রাণই যায় যায়। সবাই হাত তুলে দিয়েছেন। কাজী সালাউদ্দিনেরও..।