অভূতপূর্ব এক রাজনৈতিক অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে এর আগে এতটা অস্থিতিশীলতা দেখা যায়নি।
ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। নিজের প্রার্থীতা প্রত্যাহারের দিন তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দিয়ে যান।
এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীতা করার ক্ষেত্রে কমলা হ্যারিসের রাস্তা খুলে যায়। ডেমোক্র্যাট পার্টির দাতারাও কমলাকে সমর্থন জানান। নির্বাচনকে সামনে রেখে এক মসৃন যাত্রা শুরু হয় কমলার।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, কমলার এই মসৃন রাস্তা দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারাভিযানের পোলস্টার টনি ফ্যাব্রিজিও কমলার এই যাত্রাকে ‘হ্যারিস হানিমুন’ বলে অভিহিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী একাধিক মিডিয়া হ্যারিসের এই উত্থানকে ডেমোক্র্যাটদের জন্য ইতিবাচক হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
বিবাহিত জীবনের বাস্তবতা হিসাবে হানিমুন একসময় শেষ হয়। এক্ষেত্রে হানিমুন হলো, হ্যারিস ও যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের মধ্যকার সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়া। এখন সেই সম্পর্ক বেশ দৃশ্যমান।
রিপাবলিকানরা বাইডেনের সরে দাঁড়ানোর ঐতিহাসিক ঘোষণায় শুরুতে ধাক্কা খেয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই নতুন প্রার্থীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো শুরু করেছে।
হ্যারিসকে আক্রমণের জন্য রিপাবলিকানরা তিনটি ক্ষেত্রে মনোযোগ দিয়েছে। ডেমোক্র্যাটরাও বিভিন্ন উপায়ে সেগুলোর মোকাবেলার চেষ্টা করছে।
হ্যারিসকে ‘বিপ্লবী বামপন্থী’ তকমা
২০২০ সালে ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট মনোনয়নের জন্য হ্যারিসের ব্যর্থ প্রচারের প্রচেষ্টাগুলো ভালোভাবেই নথিভুক্ত আছে। এর মধ্যে রয়েছে, স্পষ্ট বার্তার অভাব, অভ্যন্তরীণ বিরোধপূর্ণ প্রচারণা এবং প্রার্থী হিসেবে বাজে সাক্ষাৎকার ও ভুল বক্তব্য।
এ ছাড়া তিনি সেবার ডেমোক্র্যাট দলের প্রাইমারি ভোটারদের মন জয় করতে বামপন্থার দিকে বেশি ঝুঁকেছিলেন।
মধ্যপন্থী ডেমোক্র্যাটিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক থার্ড ওয়ের পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী ভাইস-প্রেসিডেন্ট ম্যাট বেনেট মনে করেন, বামপন্থায় ঝুঁকেই ভুল করেন কমলা।
ম্যাট বলেন, “প্রাইমারিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় যেসব ইস্যুকে প্রাধান্য দিতে হয় সেসব সাধারণ নির্বাচনের দৌড়ের চেয়ে অনেক আলাদা হয়।”
২০১৯ সাল জুড়ে বিভিন্ন বিতর্ক ও সাক্ষাৎকারে কমলা হ্যারিস বেসরকারি স্বাস্থ্যবীমা বাতিল করে সবার জন্য সরকারি স্বাস্থ্যবীমা চালু করার কথা বলেছিলেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বাজেট কমিয়ে অন্য খাতে ব্যয় করাসহ পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের প্রশংসা করেন।
বৈধ কাগজপত্র ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকে অপরাধমুক্ত করার বিষয়েও সমর্থন দেন। অভিবাসন ও কাস্টমস আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ‘আইস’কে বিলুপ্ত করার কথা বলেন। নির্বিচারে গ্রিন নিউ ডিল পরিবেশ আইন এবং জীবাশ্ম জ্বালানি তোলার জন্য ফ্র্যাকিং ও অফ-শোর ড্রিলিংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করেন।
এখন সেই অবস্থানগুলো তাকে বিপাকে ফেলতে ফিরে আসতে পারে।
পেনসিলভেনিয়ার সেনেটের একজন রিপাবলিকান প্রার্থী ডেভিড ম্যাককরমিক হ্যারিসের ২০১৯ সালের অবস্থানগুলো নিয়ে আঘাত করে একটি টেলিভিশন বিজ্ঞাপন তৈরি করেছেন।
ট্রাম্পও “মিট সান ফ্রান্সিসকো র্যাডিক্যাল কমলা হ্যারিস” শিরোনামে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন। এতে সেই সময়ে হ্যারিস সমর্থিত অনেক বামপন্থী নীতি তুলে ধরা হয়েছে।
রক্ষণশীল ভাষ্যকার ম্যাট ওয়ালশ এটিকে, কীভাবে কমলা হ্যারিসকে আক্রমণ করতে হবে তার একটি ‘ব্লুপ্রিন্ট’ বলে অভিহিত করেছেন।
ডেমোক্র্যাটিক কৌশলবিদ বেনেট বলেন, “তিনি যুক্তি দিতে পারেন, একজন ভালো নেতা কোনও নীতি নিয়ে তার অবস্থান পরিবর্তন করতে পারেন। কিন্তু তিনি তার মূলনীতি পরিবর্তন করেন না। তার কোনও নীতিই পরিবর্তিত হয়নি।”
যদি তিনি বিশ্বাসযোগ্যভাবে এটি না করেন, তবে তিনি স্বাধীন এবং সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের সমর্থন হারাতে পারেন। যাদের ভোট প্রধান দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে নির্বাচনের ফল নির্ধারণ করে দেবে।
বাইডেনের ব্যর্থতার দায় হ্যারিসের ওপর চাপানো
একাধিক জরিপ বলছে, বাইডেনের প্রচার কয়েক মাস ধরে ব্যর্থ হচ্ছিল। তার অভিবাসন নীতি অজনপ্রিয় ছিল। মুদ্রাস্ফীতির নিম্নমুখীতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ভোটাররা তাকে মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী করেছেন। গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের প্রতি তার অটল সমর্থনের কারণে তিনি তরুণ ভোটারদের সমর্থন হারাচ্ছিলেন।
কমলা হ্যারিসও ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে অন্তত কিছুটা হলেও বাইডেন প্রশাসনের ব্যর্থতাগুলোর জন্য দায়ী হবেন।
রিপাবলিকানরা ইতোমধ্যেই তার গলায় অভিবাসন ইস্যুটি ঝোলানোর চেষ্টা করছে। তাকে বাইডেন প্রশাসনের ‘সীমান্ত জার’ তকমা দেওয়া হয়েছে। এটি একটি ভুল কিন্তু ক্ষতিকর তকমা, যা গণমাধ্যমেও ব্যবহৃত হয়েছিল। রিপাবলিকানরা অভিবাসন সংক্রান্ত তার অতীতের বিবৃতি এবং ২০২২ সালের একটি সাক্ষাৎকারের একটি দাবির উদ্ধৃতি দেন। ওই সাক্ষাতকারে হ্যারিস বলেছিলেন, “সীমান্ত নিরাপদ আছে”।
ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজনৈতিক অ্যাকশন কমিটির পরিচালক টেলর বুডোভিচও কমলার সমালোচনা করছেন।
টেলর বলেন, “কমলা হ্যারিস বর্তমানে শুধু একজন ব্যর্থ ও অজনপ্রিয় ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত। অতীতে যিনি তার বসের পিঠে ছুরি মেরেও মনোনয়ন অর্জন করতে পারেননি। কিন্তু ভোটাররা জানে এবার আরও খারাপ হতে চলেছে।”
কমলার সমালোচনার জন্য টেলিভিশন বিজ্ঞাপনগুলোর জন্য ৩২ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
বেনেটের মতে, হ্যারিস বাইডেন প্রশাসনের ব্যর্থতার দায় থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রাখতে পারবেন না। তবে রিপাবলিকানদের আক্রমণের মুখেও তিনি বিষয়টি ভোটারদের সামনে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হতে পারেন।
বেনেট বলেন, “কমলা যা করতে পারেন তা হলো ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলা, যা একজন ৮১ বছর বয়সী লোকের পক্ষে করা খুব কঠিন হতো। তিনি আরও যুক্তি দিতে পারেন যে, ট্রাম্প কেবল পেছনের দিকে তাকাতে চান।”
আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবনের ভুল নিয়ে আক্রমণ
কমলা হ্যারিস তার নির্বাচনী প্রচারের প্রথম জনসভায় সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আক্রমণের একটি বিশেষভাবে নির্দেশিত লাইন উন্মোচন করেছিলেন। আদালতে প্রসিকিউটর ও ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে কাজ করেছেন উল্লেখ করে কমলা বলেন, আমি ‘সব ধরনের অপরাধীদের’ মুখোমুখি হয়েছি।
কমলা বলেন, “তাই আমার কথা শুনুন- যখন আমি বলি, ডোনাল্ড ট্রাম্প কী ধরনের মানুষ তা আমি জানি।”
ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রচার পরামর্শক আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অ্যাডজাঙ্কট ইনস্ট্রাক্টর ক্রেইগ ভারোগা হ্যারিসের আইন পেশার ব্যাকগ্রাউন্ডকে তার ‘সুপার পাওয়ার’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু হ্যারিস ২০১৯ সালের প্রচারাভিযানে এর পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে পারেননি, যখন পুলিশি ব্যবস্থায় সংস্কার ছিল শীর্ষ সমস্যা।
ট্রাম্পের প্রচার শিবির ইতোমধ্যেই লক্ষণ দেখাচ্ছে যে, তারা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। তার প্রচার ব্যবস্থাপক ক্রিস লাসিভিটা এর আগে আরেকজন ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থীর কথিত শক্তির জায়গাকে তার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করে রিপাবলিকান পার্টিতে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করেন।
২০০৪ সালের ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জন কেরি নিজেকে ইরাক যুদ্ধের সময় একজন কার্যকর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে তুলে ধরার জন্য তার ভিয়েতনাম যুদ্ধের অভিজ্ঞতা দেখান।
ক্রিস লাসিভিটা কেরির দেশপ্রেম ও বীরত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য আক্রমণাত্মক সিরিজ বিজ্ঞাপনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ওই বিজ্ঞাপনে ভিয়েতনামের নদী ও উপকূলে টহলরত সেদেশের নৌবাহিনীর একটি সুইফট বোটে নাবিকদের সঙ্গে কেরিকে বসে থাকা অবস্থায় দেখানো হয়।
সেখান থেকেই ‘সুইফট-বোটিং’ শব্দটির জন্ম। শব্দটির অর্থ দেওয়া হয়- কোনও প্রার্থীকে তাদের অনুভূত শক্তিকে আক্রমণ করে নিরস্ত্র করা।
এখন লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে ট্রাম্পের প্রচার শিবির কমলার আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবনের রেকর্ডের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
একদিকে তারা তাকে খুব কঠোর হওয়ার জন্য আঘাত করছে, বিশেষ করে মাদক অপরাধের জন্য কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের ওপর তার কঠোর বিচারিক আচরণ তুলে ধরছে। এর মধ্য দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে কমলার যে জনপ্রিয়তা আছে তা নষ্ট করতে চাইছে তারা।
অন্যদিকে, তারা এমন ঘটনার উদাহরণও দিচ্ছেন যেখানে হ্যারিস হয় বিচার করেননি বা নতুন অপরাধ করতে যাওয়া ব্যক্তিদের প্যারোলে মুক্তির অনুমতি দিয়েছেন।
ভারোগা স্বীকার করেছেন, ডেমোক্র্যাটরা ২০০৪ সালে ঠিকভাবে ‘সুইফট-বোট’ হামলার মোকাবেলা করতে পারেননি। তবে এবার তারা সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে রিপাবলিকানদের আক্রমণ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকবেন।
তিনি বলেন, “যদি লাসিভিটা মনে করেন যে, তিনি আবারও ডেমোক্র্যাটদের বোকা বানাতে পারবেন, তবে তিনি ভুল করবেন। এই বিভ্রম থাকলে তিনি নিজের কাছেই হেরে যাবেন।”
কমলা হ্যারিসকে সংজ্ঞায়িত করার প্রতিযোগিতা
ফ্যাব্রিজিও তার মেমোতে বলেছিলেন, “তিনি কে বা তিনি কী করেছেন তা পরিবর্তন করতে পারবেন না হ্যারিস। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ভোটাররা শীঘ্রই তাকে ‘বাইডেনের অংশীদার এবং সহ-পাইলট’ হিসেবে দেখবে এবং তার সম্পর্কে জানবে।”
ট্রাম্পের গণবিবৃতি ও সমাবেশে বক্তৃতায় আক্রমণের পাশাপাশি আসন্ন বিজ্ঞাপনে হ্যারিসকে আক্রমণের কেন্দ্রেও থাকবে এই প্রচারণা।
অন্যদিকে, হ্যারিস এবং তার প্রচার শিবির তিনি কে এবং তিনি কিসের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন তার নিজস্ব সংজ্ঞা দেওয়ার জন্য কাজ করবে।
ভারোগার মতে, এটি করার একটি বিশেষভাবে কার্যকর উপায় হবে হ্যারিসের রানিং-মেট বা ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নির্বাচনে সতর্ক থাকা।
তিনি বলেন, “কোনও প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর এটিই প্রথম বাস্তব সিদ্ধান্ত, যা জনগণের দেখার জন্য আছে।
“হ্যারিস কী ধরনের ভবিষ্যৎ অনুসরণ করতে চলেছেন, তা জনগণকে বোঝানোর জন্য এই সিদ্ধান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ।”
কমলা হ্যারিস যদি আরও বেশি মধ্যপন্থী রানিংমেট বেছে নেন, তাহলে তিনি ভোটারদের বিশ্বাস করাতে পারবেন যে তিনি মধ্যপন্থা থেকেই শাসন করবেন। রিপাবলিকানরা যেভাবে তাকে বিপ্লবী বামপন্থী বলে তকমা দিচ্ছেন তিনি সেরকম হবেন না।
সামনের সপ্তাহগুলোতে হ্যারিসের নিজেকে সংজ্ঞায়িত করার লড়াই, নভেম্বরে ব্যালট বাক্সে যাওয়ার সময় জনগণ তাকে কীভাবে দেখবেন তা নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি