বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতির দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের দুই ধাপ অবনমন হয়েছে বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে (সিপিআই) উঠে এসেছে।
বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থাটির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, দুর্নীতির মাত্রার দিক দিয়ে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। ২০২২ সালে যা ছিল দ্বাদশ। অর্থাৎ বিশ্বের শীর্ষ ১০ দুর্নীতির দেশের একটি এখন বাংলাদেশ।
মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) ঢাকার ধানমণ্ডিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশানাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সম্মেলন কক্ষে সিপিআইয়ের তথ্য তুলে ধরেন নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, ২০২২ সাল পর্যন্ত এই সূচকে ১০০র মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর বা পয়েন্ট ছিল ২৫-২৮ এর মধ্যে। এবার তা কমে ২৪ এ নেমেছে। এই এক পয়েন্ট কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের স্কোর এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে।
এই স্কোরকে টিআইবি ‘হতাশাজনক’ বা ‘বিব্রতকর’ বলে মনে করছে, জানান তিনি। বলেন, “এই স্কোর ও অবস্থানের অবনমন প্রমাণ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’-এর ঘোষণাসহ সরকারের বিভিন্ন অঙ্গীকার বাস্তবিক অর্থে কোনও কাজে আসেনি।”
বাংলাদেশের আর্থিক ও ব্যাংক খাতে অনিয়ম, অর্থপাচারসহ বিভিন্ন কারণে দুর্নীতির ধারণা সূচকে অবনতি হতে পারে বলে মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
টিআইয়ের প্রকাশিত এই সূচক ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে করা। গতবছর প্রকাশিত সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম।
সিপিআই’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ ৯০ স্কোর পেয়ে কম দুর্নীতির দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ইউরোপের দেশ ডেনমার্ক। ৮৭ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে দ্বিতীয় স্থানে ফিনল্যান্ড এবং ৮৫ স্কোর নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ড।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত এই সূচক বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির ব্যাপকতার একটি তুলনামূলক চিত্র উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৮০টি দেশকে এই সূচকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
এই দেশগুলোর রাজনীতি ও প্রশাসনে বিরাজমান দুর্নীতির ব্যাপকতা সম্পর্কে ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, সংশ্লিষ্ট খাতের গবেষক ও বিশ্লেষকদের ধারণার ওপর ভিত্তি করে মোট স্কোর ১০০ ধরে দুর্নীতির তুলনামূলক অবস্থান নির্নীত হয়। এটি একটি যৌগিক সূচক, যাকে জরিপের ওপর জরিপও বলা হয়।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এই সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশ বা অন্য কোনও দেশকে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ’ বলা যাবে না। তবে সূচকভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে দুর্নীতির মাত্রা কম বা বেশি বলা যাবে।”
প্রকাশিত সিপিআইর তথ্য অনুযায়ী, ১৮০টি দেশের মধ্যে দুর্নীতির ধারণা সূচকে ১১ স্কোর নিয়ে দুর্নীতির মাত্রা বেশি এমন দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে সোমালিয়া। ১৩ স্কোর নিয়ে যৌথভাবে এই তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলা। ১৬ স্কোর নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইয়েমেন।
এই তালিকায় ১০৫টি দেশ ৪৩ স্কোরের নিচে পেয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বের ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠীই সুচকের শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী অতীব উদ্বেগজনক দুর্নীতির মধ্যে বাস করছে বলে জানায় টিআইবি।
সিপিআই-এ প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ইকোনোমিক ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের গবেষণা অনুযায়ী ২৪টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৪৮টি ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৩৬টি হাইব্রিড গণতান্ত্রিক ও ৫৯টি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের গড় স্কোর যথাক্রমে ৭৩, ৪৮, ৩৬ ও ২৯।
ফ্রিডম হাউজ অনুযায়ী, নির্বাচনী গণতন্ত্র রয়েছে এমন রাষ্ট্রের গড় স্কোর ৫৩ এবং নির্বাচনী গণতন্ত্র নেই এমন রাষ্ট্রের গড় স্কোর ৩১। সেখানে বাংলাদেশের ২৪ স্কোর পাওয়াকে বিব্রতকর বলেই মেন করছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, “দুর্নীতি ও অবিচার পরষ্পর সম্পর্কযুক্ত। দুর্নীতি অবিচার জন্ম দেয় এবং অন্যায় দুর্নীতির দুষ্টচক্র তৈরি করে। সিপিআই-এর তথ্য প্রমাণ করে যেসব দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা রয়েছে, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত, সেসব দেশের কার্যকর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা বেশি।”
১৯৯৫ সাল থেকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এই সূচক প্রকাশ করে আসছে। ২০০১ সালে বাংলাদেশ প্রথম তালিকাভূক্ত হয়। সেসময় এই সূচকে অন্তর্ভূক্ত ছিল ৯১টি দেশ।
এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে সবার নীচে রয়েছে আফগানিস্তান। এই দেশটির স্কোর ২০, দুর্নীতির মাত্রার দিক দিয়ে অবস্থান ষষ্ঠ। সেই হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার এই একটি দেশই বাংলাদেশের থেকে নীচে রয়েছে।
এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে ভূটানের স্কোর ৬৮, মালদ্বীপ ও ভারতের স্কোর ৩৯, নেপালের স্কোর ৩৫, শ্রীলংকার স্কোর ৩৪ এবং পাকিস্তানের ২৯।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বাংলাদেশের দুর্নীতির ক্ষেত্রে আমাদের যদি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয় তাহলে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তাদের অবস্থান ও পরিচয় নির্বিশেষে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি বিরোধী অনেকগুলি অঙ্গীকারের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য। যারা অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের দায়ে অভিযুক্ত হবে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে।
“এই অঙ্গীকারগুলি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে রাজনীতির বাইরে রাখতে হবে, বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রশাসন, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, বিচারিক প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক ও নির্বাহী প্রভাবমুক্ত করতে হবে। যে সমস্ত খাতে সরকারী বিনিয়োগ ও ব্যয় বেশি হয় এবং যেসব খাতের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা সবচেয়ে বেশি সেই খাতগুলোকে স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত থেকে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে।”
সর্বোপরি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি আমূল পরিবর্তন বা প্যারাডাইম শিফট প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
বলেন, “যেখানে মূলত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থান থেকে প্রতিষ্ঠানের নিজ নিজ সম্পদ বিকাশের ক্ষেত্রে অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি না হয়। এটা করতে পারলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে এখন যে অবস্থান তার থেকে আমরা অনেক ভালো করতে পারব।”
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল ও উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের।