দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ‘একপাক্ষিক ও পাতানো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ হয়েছে উল্লেখ করে দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জিম্মিদশা প্রকটতর হয়েছে। সংস্থাটির দাবি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার কৌশল বাস্তবায়নে এই ধরনের নির্বাচন করেছে।
নির্বাচনে সংসদীয় আসনপ্রতি প্রার্থীদের সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা ব্যয় বেঁধে দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি), তবে তার তোয়াক্কা না করে তফশিল ঘোষণার আগ থেকে নির্বাচন পর্যন্ত ৬ গুণ বেশি, ১ কোটি ৫৬ লাখ ৮৩ হাজার ৭৭৭ টাকা ব্যয় করেছে তারা। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ব্যয় করেছে ১১ দশমিক ৪৫ গুণ বেশি বলে টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
ঢাকার ধানমণ্ডির মাইডাস সেন্টারে বুধবার ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া ট্র্যাকিং’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি এসব কথা জানিয়েছে।
টিআইবি দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫০টি নির্বাচনী আসন প্রধান তিন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের ওপর তথ্য সংগ্রহ ও সরাসরি পর্যবেক্ষণ করে এই প্রতিবদেন তৈরি করেছে।
সেখানে ১৪৯ প্রার্থীর ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্যের ভিত্তিতে সংস্থাটি এমন দাবি করেন।
‘একপাক্ষিক পাতানো ভোট’
টিআইবি সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘সার্বিক অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত, যা গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা ও স্বপ্নের সাথে সাংঘর্ষিক।
‘‘নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে দুই বড় দলের বিপরীতমুখী ও অনড় অবস্থানের কারণে অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ নির্বাচন হয়নি। এবং এ বিপরীতমুখী ও অনড় অবস্থানকেন্দ্রিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের লড়াইয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জিম্মিদশা প্রকটতর হয়েছে।’’
ক্ষমতায় অব্যাহত থাকার কৌশল বাস্তবায়নের একতরফা নির্বাচন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন,‘‘যার আইনগত বৈধতা নিয়ে কোনও চ্যালেঞ্জ হয়তো হবে না, বা হলেও টিকবে না। তবে এ সাফল্য রাজনৈতিক শুদ্ধাচার, গণতান্ত্রিক ও নৈতিকতার মানদণ্ডে চিরকাল প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে।’’
গবেষণা প্রতিবদেনে বলা হয়, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক দেখাতে নিজ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করলেও বেশিরভাগ আসনেই নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি; ২৪১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। সারাদেশে অধিকাংশ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাড়া অন্য দলের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট ছিল না। প্রতিপক্ষ প্রার্থীর এজেন্টদের হুমকির মাধ্যমে কেন্দ্রে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখা হয়।
স্বল্প ভোটার আগমন ও ডামি লাইন তৈরি, বিভিন্ন আসনে অন্য প্রার্থীর এজেন্ট বের করে দেওয়া হয়। ভোটের আগেই ব্যালটে সিল মারা, ভোট চলাকালে প্রকাশ্য সিল মারাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ আওয়ামী লীগ, জোট ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও করেছেন।
জাপান, রাশিয়া, চীন ও ভারতসহ কয়েকটি দেশের পর্যবেক্ষকদের মতে, নির্বাচন ব্যবস্থা স্বচ্ছ ও সুশৃঙ্খল হলেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ এবং জাতিসংঘ ও কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে সমালোচনা হয়েছে।
প্রার্থীদের ৬ গুণ বেশি ব্যয়
টিআইবির তথ্যমতে, একাদশ সংসদ নির্বাচনে গড়ে ৭৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ব্যয় করেছে প্রার্থীরা, যা ইসির বেঁধে দেওয়া সীমার চেয়ে তিন গুণ বেশি। তবে দ্বাদশ নির্বাচনে প্রার্থীরা যে ব্যয় করেছে, তা ইসির বেঁধে দেওয়ার সীমার চেয়ে ৬ গুণ বেশি।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, তফসিল ঘোষণার আগে থেকে নির্বাচন পর্যন্ত প্রার্থীরা গড়ে ব্যয় করেন ১ কোটি ৫৬ লাখ ৮৩ হাজার ৭৭৭ টাকা। প্রচারণা শুরুর পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রার্থীরা ব্যয় করেছে ১ কোটি ৭ লাখ ৮৪ হাজার ৭১০ টাকা। গবেষণা অন্তর্ভুক্ত আসনগুলোর মধ্যে ৬৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ (৯৮) জন নির্ধারিত ব্যয়সীমার বেশি ব্যয় করেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা, তা কমিশনের বেঁধে দেওয়া ব্যয়সীমার চেয়ে ১১ দশমিক ৪৫ গুণ বেশি।
ভোটের আগে নির্বাচন কমিশন ভোটারপ্রতি ১০ টাকা ও আসনপ্রতি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ের সীমা বেঁধে দিয়েছিল ইসি। ভোট শেষে গেজেট প্রকাশের পর প্রত্যেক প্রার্থীকে ৩০ দিনের মধ্যে ব্যয়ের হিসাব বিবরণী দেওয়ার বিধান রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ৯০ দিনের মধ্যে তাদের হিসাব জমা দিতে হবে।
টিআইবির তথ্যমতে, বিজয়ী প্রার্থীরা ব্যয় করেছেন গড়ে ৩ কোটি ৯ লাখ ৫৬ হাজার ৪৩৮ টাকা, যার মধ্যে ১ জন বিজয়ী প্রার্থী ব্যয় করেছেন ৩৮ কোটি ৭৭ লাখ ১০ হাজার ১৪ টাকা। সর্বনিম্ন ব্যয় করা হয়েছে ১৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।
সংস্থাটির মতে, ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য খাত হচ্ছে পোস্টার, নির্বাচনী ক্যাম্প ও জনসভা কর্মীদের জন্য ব্যয়। নির্বাচনী ব্যয়সীমা লঙ্ঘনের ধারা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।