Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

বাঘের বাড়ি ঠিক রাখতে যত আয়োজন সুন্দরবনে

সুন্দরবনে বাঘের জন্য এমন টিলা তৈরি করা হচ্ছে।
সুন্দরবনে বাঘের জন্য এমন টিলা তৈরি করা হচ্ছে।
[publishpress_authors_box]

১২টি টিলা তৈরি করা হয়েছে। জোয়ারের সময় বাঘ যেন এই উঁচু স্থানে আশ্রয় নিতে পারে সেজন্য। বাঘ গোনার জন্য বসানো হচ্ছে স্যাটেলাইট ট্র্যাকার। ড্রোনও ওড়ানো হবে, সে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বনরক্ষীদের। সুন্দরবনে বাঘ রক্ষায় এমন সব আয়োজন চলছে।

বিশ্বে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র প্রাকৃতিক আবাসস্থল সুন্দরবন। তাই এই প্রাণীটির বিলুপ্তি ঠেকাতে সুন্দরবন ঘিরে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটির অধীনে নানা কাজ চলছে।

বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০২২ সালে শুরু হওয়া ‘সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প’ ২০২৫ সালের মার্চ মাস অবধি চলবে।

প্রকল্পের অধীনে বাঘ জরিপের কাজটিও চলছে। তাতে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা বাড়ার আভাস মিলেছে বলেও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

বাঘের টিলা

বাঘের আনাগোনা বেশি সুন্দরবনের এমন ১২টি স্থানে টিলাগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের নীল কমল, পাটকোষ্ট, ভোমরণালী, সাতক্ষীরা রেঞ্জের পুষ্পাকাটি, মান্দারবাড়িয়া ও নোটাবেকী; আর পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের কটকা, কচিখালী, কোকিলমুনি, সুপতি, টিয়ারচর ও দুধমুখিতে নির্মিত হচ্ছে এই টিলা।

টিলাগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে বাঘের টিলা। এগুলো নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে কয়রা উপজেলার নীলকমল অভয়ারণ্যে টিলার কাজ শেষ হয়েছে। অভয়ারণ্যের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবু সাঈদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বনের মধ্যে মাটি তুলে উুঁচু টিলা বানানো হয়েছে। পাশেই মিঠাপানির পুকুর খনন করা হয়েছে। এখন টিলার ওপর ঘাস লাগানোর কাজ চলছে।”

এই টিলা তৈরির কারণ ব্যাখ্যা করে প্রকল্প পরিচালক ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই টিলার মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঘ ও অন্যান্য প্রাণীরা সুরক্ষা পাবে। এছাড়া জোয়ার ভাটায়ও পানি প্রবেশ করে বনের ভেতরে। এ সময় তারা টিলায় অবস্থান নিতে পারবে।”

বন কর্মকর্তারা জানান, বর্ষায় ভরা জোয়ার, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার সময় বাঘসহ সুন্দরবনের অনেক প্রাণীই বিপদে পড়ে। তারাও এসব টিলায় আশ্রয় নিতে পারবে। এই টিলাগুলোতে অন্য প্রাণীরা আশ্রয় নিলে বাঘের খাবারেরও অভাব হবে না।

বাঘ যেসব প্রাণীকে খায়, যেমন চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, বন্য শূকর, বানর, সজারু ও গুইসাপ সেসবের বসবাসেও সহায়ক হবে এসব টিলা।

টিলাগুলোর পাশে পুকুরও খনন করা হচ্ছে, যাতে জলোচ্ছ্বাস বা বন্যার সময় বন্য প্রাণীগুলো উঁচু টিলায় আশ্রয় নিয়ে পানি পান করতে পারে।

বন কর্মকর্তারা বলেন, প্রজননের মৌসুমের পুরো সময়টাই বাঘ উঁচু স্থানে থাকে। তাই বাঘের সংখ্যা বাড়াতে তাদের প্রজননে সুবিধা করে দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

আর টিলার পাশে পুকুর থাকলে ওই সময়টাতে বাঘকে সন্তান ছেড়ে পানির জন্য আর দূরে যেতে হবে না।

প্রকল্প পরিচালক জানান, বনকর্মী ও কর্মকর্তাদের স্মার্ট পেট্রোলিংয়ের আওতায় ড্রোন চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, একই সঙ্গে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারেরও। পরবর্তীতে তাদের ড্রোন ও আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করা হবে। ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম ও সিপিজি সদস্যদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

বাঘ সংরক্ষণে প্রথম প্রকল্প

২০২২ সালে ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয়ে সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করে বনবিভাগ। এর মেয়াদ শেষ হবে ২০২৫ সালের মার্চ মাসে।

এই প্রকল্পের দুটি অংশ রয়েছে একটি ক্যামেরা ট্র্যাপিং এর মাধ্যমে বাঘ জরিপ। অন্যটি হচ্ছে বাঘ সংরক্ষণ। বাঘ সংরক্ষণের মধ্যে উচুঁ টিলা নির্মাণ ছাড়াও রয়েছে ৫ কিলোমিটার এলাকায় বেড়া নির্মাণ, ২টি বাঘের শরীরে স্যাটেলাইট ট্র্যাকার লাগানো, জিপিএস ট্র্যাকিং, নাইলনের বেড়া নির্মাণ, ড্রোন ক্যামেরা এবং বাঘ অজ্ঞানের জন্য ট্রাঙ্কুলাইজিং গান, ক্যামেরা, ভিটিআরটি ও সিপিজি সদস্যদের জন্য পোশাক ক্রয় ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।

পাশাপাশি শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে যেখানে নদী বা খাল শুকিয়ে লোকালয় ও বন মিলে গেছে সেখানে বেড়া নির্মাণ করা হবে।

প্রকল্প পরিচালক সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের বলেন, এর আগে ২০১৫ ও ২০১৮ সালে বৈদেশিক সংস্থার অর্থায়নে সুন্দরবনে বাঘের সুরক্ষায় প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। তবে ২০২২ সাল থেকে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।

বাঘ জরিপ

২০১৫ সালে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে জরিপে সুন্দরবনে ১০৬টি বাঘ পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৮ সালে বাঘের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৪টিতে। এবার বাঘের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বর্তমান প্রকল্পের দুটি অংশের মধ্যে বাঘ জরিপের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগ খুলনা ও সাতক্ষীরা অংশে বাঘ জরিপের ছবি সংগ্রহের কাজ শেষ হয়েছে। এখন তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে পূর্ব বন বিভাগের ক্যামেরা থেকে তথ্য সংগ্রহ এখনও চলছে।

প্রকল্প পরিচালক আবু নাসের বলেন, “২০১৮ সালে সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের ১২২টি গ্রিডে মাত্র ৫ শতাংশেরও কম গ্রিডে বাঘের ছবি পাওয়া গিয়েছিল। এবছর ৫৭ শতাংশ গ্রিডেই বাঘের ছবি পাওয়া গেছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর বাঘের সংখ্যা বাড়বে।”

এ ছাড়া সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের বিভিন্ন ফরেস্ট অফিসেও বাঘের আনাগোনা দেখা গেছে বলে জানান তিনি। তবে সংখ্যাটি কত, তা চলতি বছরের ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবসে জানা যাবে।

তিন কোটি ২৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ব্যয়ে বাঘ জরিপে ২০২৩ সালে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের কালাবগি ইকোট্যুরিজম সেন্টার থেকে শুরু হয় ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের কাজ।

সুন্দরবনকে প্রতি ২ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় একটি গ্রিড করে মোট ৬৬৮টি গ্রিডে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি গ্রিডে দুটি করে ক্যামেরা ব্যবহার করে বাঘের ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কাজে মোট ৮০০টি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছে। যার মধ্যে ৬০০টি আগের জরিপে ব্যবহৃত ক্যামেরা। ২০০টি ‘স্কাউট গার্ড’ ক্যামেরা এক কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা হয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক জানান, প্রথমে ক্যামেরা ট্রাকিংয়ের মাধ্যমে ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত সেই ছবি স্যাম্পলিং করছে রিসোর্চ ম্যানেজমেন্ট ইউনিট ইনফরমেশন (আরআইএমএস ইউনিট)। পরে তারা তা জরিপের জন্য দেবেন সার্ভে টিমকে। সার্ভে টিমে রয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজীজ, রাঙ্গামাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের শিক্ষক ড. সুপ্রীয় চাকমা ও গবেষক হাসান আরীফুর রহমান। তারা জরিপ শেষে এর ফলাফল দেবেন টেকনিক্যাল কমিটির কাছে।

উপ প্রধান বন সংরক্ষক মো. জাহিদুল কবীরসহ ১১ সদস্যের এই টেকনিক্যাল কমিটি জরিপটি পরীক্ষা করে দেখবে। এরপর ভারত বাংলাদেশ যৌথ সুন্দরবন রক্ষা চুক্তি অনুযায়ী ভারতের বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের দুই গবেষক ড. জালাল ও ড. কোরেশিকে দিয়ে পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাবে। তারপর চুড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত