সত্যি করে বলুন তো শেষ কবে কানে ইয়ারফোন না দিয়েই একা হাঁটতে বেড়িয়েছিলেন? আসলে কানকে একেবারে প্রকৃতির কাছে সঁপে দিয়ে একা একা হাঁটার অভিজ্ঞতা বেশিরভাগ মানুষেরই নেই। ভোরবেলা যারা জগিং কিংবা হাঁটতে বের হন, তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই কানে থাকে ইয়ারফোন। তবে নতুন এক টিকটক ট্রেন্ড, ‘সাইলেন্ট ওয়াকিং’এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে, উৎসাহিত করছে ইয়ারফোনবিহীন মর্নিং ওয়াককে।
টিকটকের এই ট্রেন্ডটি এরিমধ্যে পেয়েছে জনপ্রিয়তা। কারণ কোন রকম ডিজিটাল সঙ্গ ছাড়াই হাঁটার এই অভ্যাস মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। ভোরবেলা ইয়ারফোন বিহীন হাঁটার অভ্যাস জীবনে নিয়ে আসতে পারে প্রশান্তি, চিন্তার স্পষ্টতা এবং কমাতে পারে উদ্বেগ, বলছেন মনোবিদরা।
সাইলেন্ট ওয়াকিং কী?
‘সাইলেন্ট ওয়াকিং’ এর মানে কোনো ধরনের ডিজিটাল সঙ্গ ছাড়াই হাঁটা। না কোনো গান, না কোনো পডকাস্ট, না কোনো ফোনকল। শুধু আপনি আর আপনার চিন্তা, এবং আপনার চারপাশ। খুব ভোরে প্রকৃতির সৌন্দর্য এভাবেই উপভোগ করা সংগত নয় কি?
মুম্বাইয়ের হিন্দুজা হসপিটালের সাইকোলজিস্ট এবং কাউন্সেলর শীনা সুদ এ ব্যাপারে বলেন, “আজকের দিনে আমাদের সবচেয়ে বড় বাধা হলো মোবাইল ফোন। তাই ফোন এবং যেকোনো ধরনের বাধা দূরে রেখে, একা হাঁটতে যাওয়াই হলো সাইলেন্ট ওয়াকিং। এটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী, কারণ এটি আমাদের ভার্চুয়াল এবং বিশৃঙ্খলাপূর্ণ দুনিয়ার বাইরে মনোযোগী হতে এবং নিজের পর্যালোচনা করতে সাহায্য করে।”
ফোর্টিস মেমোরিয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট রোশনি সন্ধি বলেন, “সাইলেন্ট ওয়াকিং আমাদের বর্তমান মুহূর্তের দিকে মনোযোগ দিতে উৎসাহিত করে এবং নিরন্তর মনযোগহীনতা থেকে মুক্তি দেয়। এটাকে ডিজিটাল ডিটক্সের সঙ্গেও তুলনা করা যায়। বৌদ্ধ ধর্মে একে ‘হাঁটা ধ্যান’ও বলা হয়।”
মানসিক স্বাস্থ্যের উপকার
শারদা হসপিটালের সাইক্রিয়াটিস্ট ড. নিখিল নায়ার বলেন, ‘সাইলেন্ট ওয়াকিং’ মানুষকে তার চারপাশ এবং শরীর সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন করে তোলে। এটি ব্যক্তির ‘ইনার পিস’ বা মনোগত শান্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
‘সাইলেন্ট ওয়াকিং’ প্রতিদিনের কাজকর্ম এবং স্রেফ হাঁটাকেই মননশীলতার চর্চায় রূপান্তরিত করে। কারণ এতে থাকে না কোনো গান বা কথোপকথনের বাধা। আমাদের চারপাশের প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো তখন আরও গভীরভাবে আমাদের নজরে পড়তে শুরু করে। ভোরের পাখির কলতান, পাতার শব্দ, এমনকি নিজের পায়ের শব্দও। আর এটি আমাদের বর্তমানে থাকতে সাহায্য করে যা মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ কমায়।
আমরা এমন এক দুনিয়ায় বাস করি যেখানে তাৎক্ষনিক সন্তুষ্টিই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে আমরা শুধু চাই আর চাই। কিন্তু অল্পেই যা পাওয়া যায়, তাতেই আমাদের সব মনযোগ আটকে থাকে। নিমেষেই যা পাওয়া যায়, তার স্থায়ীত্বও হয় কম। সাইলেন্ট ওয়াকিং আমাদের এই চক্র থেকে রক্ষা করে।
তাই, ডিভাইসহীন দিনের শুরুটা সুদূর কোনকিছুতে আমাদের মনযোগ নিবদ্ধ করে। যা আমাদের আত্মিক উন্নয়ন ঘটায়।
হাঁটলে শরীরে এন্ডরফিন নামক হরমোন নিঃসৃত হয়। যাকে বলা হয় ‘ফিল-গুড’ হরমোন। যেখানে হাঁটা নিজেই একটি প্রশান্তিদায়ক ব্যাপার সেখানে ইয়ারফোন কানে গুজে এই অনুভূতি মাটি করার মানেই হয়না। পাশাপাশি ভোরের নীরবতা যদি এতে যুক্ত হয় তবে মনে তা প্রশান্তিদায়ক অনুভূতি দেয়। অনেক টিকটক ব্যবহারকারীর দাবী সাইলেন্ট ওয়াকের পর তারা আরও স্বস্তি অনুভব করছেন। তারা এটিকে এক ধরনের থেরাপি হিসেবে দেখতে চাইছেন।
ভোরবেলা হাঁটা, রাতের ঘুমে সহায়ক। তবে কোন কোন গবেষকের মতে সন্ধ্যাবেলায় হাঁটায় নাকি আরও বেশি উপকার পাওয়া যায়। তাই সন্ধ্যা অথবা ভোর যখনই হোক, ইয়ারফোনকে বলুন টাটা। উপভোগ করুন ডিভাইস বিহীন হাঁটা।
কিন্তু কানে ইয়ারফোন অথবা হেডফোন গুজে রাখার অভ্যাস অনেকেরই দীর্ঘদিনের। দীর্ঘদিনের এই অভ্যাস ঝেরে ফেলে কিভাবে ডিভাইস বিহীন এই হাঁটার অভ্যাস রপ্ত করা যায়?
সমাধান আছে। বিশেষজ্ঞরা বাতলে দিয়েছেন কিছু উপায়-
অল্প সময় দিয়ে শুরু করুন
আপনার বাড়ির আশেপাশেই, ঘড়ি ধরে শুরুতে ১০ মিনিট হাঁটুন। যখন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন, সময় বাড়াবেন। কানে থাকবে না ইয়ারফোন।
সুবিধাজনক পথ নির্বাচন করুন
এমন একটি পথ বেছে নিন যে পথ দিয়ে হাঁটতে গেলে আপনাকে খুব বেশি ভাবতে হবেনা। কিন্তু হাঁটুন মনযোগ দিয়ে। আর মনযোগ দিতে হলে ইয়ারফোন রেখে আসতে হবে বাড়িতে।
ফোন রেখে আসুন বাড়িতে
এটা শুনতে যদি খুব আজগুবি মনে হয় তবে ফোন রাখুন সাইলেন্ট মুডে। হাঁটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফোন চেক করার প্রবণতা থেকেও দূরে থাকুন। গান তো শুনবেনই না।
শুধুই কি ট্রেন্ড?
টিকটকে কিছু জনপ্রিয় হলেই তাকে শুধুমাত্র একটি ট্রেন্ড হিসেবেই ভাবা হয়। কিন্তু এই ট্রেন্ডটি সত্যিই মানুষের মধ্যে ভালো অভ্যাস উসকে দিচ্ছে। বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি দিতে মানুষকে করছে সহায়তা। তাই, এটি কেবলই একটি ট্রেন্ড নয়।