ভিড়ের মধ্য থেকে মিশেল প্যানিং তার টার্গেট বাছাই করে নিলেন এমন একজন মানুষকে যাকে তিনি চেনেন না। মোবাইল ফোনের ক্যামেরা চালু রেখে আচমকাই প্রশ্ন করে বসলেন, আপনি কি আমাকে ১০০ ডলার ধার দিতে পারেন, প্লিজ?
অচেনা লোকটি এবং প্যানিং তারপর দুইজনেই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। দুইজন হ্যান্ডশেক করে যে যার রাস্তায় চলে গেলেন। এই পুরো ঘটনায় প্যানিংকে মোটেও অখুশি দেখা গেল না! বরং ক্যামেরার সামনে তিনি বলে উঠলেন- আমি পেরেছি।
আসলে এই ১০০ ডলারের কোনও প্রয়োজন প্যানিংয়ের ছিল না। আবার অচেনা লোকটির প্রত্যুত্তরের ব্যাপারটিও তেমন গুরুত্ব বহন করে না তার কাছে। উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’, যেকোনও কিছুই হতে পারে। এতে কোনও সমস্যা নেই তার। মূল ব্যাপারটি হচ্ছে শুরুতেই এরকম উদ্ভট আবদার কাউকে করে ফেলার ব্যাপারটি।
টিকটকে এ ট্রেন্ডটি ‘রিজেকশন থেরাপি’ হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্যানিং কেবল সেই ট্রেন্ডের সঙ্গে মিলিয়েই ভিডিও তৈরি করেছেন।
‘রিজেকশন থেরাপি’ চ্যালেঞ্জ হলো, কোনও অচেনা বা অপরিচিত লোককে প্রথম দেখায় এমন একটি আব্দার করে ফেলা যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওই ব্যক্তির মেটানোর সম্ভাবনা কম থাকে। অর্থাৎ ‘নেতিবাচক’ উত্তরই পাওয়া যায়। মূল বিষয় হচ্ছে, এই ‘রিজেকশন’ বা ‘না’ সূচক উত্তরের মুখোমুখি হয়ে ভয়কে কাটিয়ে ওঠা।
‘রিজেকশন থেরাপি’ মূলত এক ধরনের ‘এক্সপোজার থেরাপি’। যে পরিস্থিতিকে মানুষ ভয় পেয়ে থাকে, ধীরে ধীরে সেটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমস্যা দূর করার মানসিকতা তৈরি করাই এক্সপোজার থেরাপির মূল লক্ষ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার মনোচিকিৎসক এবং এক্সপোজার থেরাপির বিশেষজ্ঞ ড. টেইলর উইলমার। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইনসট্রাইড হেলথ এর ক্লিনিকাল প্রোডাক্ট বিভাগের পরিচালক। পাশাপাশি ন্যাশনাল সোশাল অ্যাংজাইটি সেন্টারেরও বোর্ড সদস্য।
তিনি বলছেন, যারা কম উদ্বেগে ভোগেন এবং যাদের প্রত্যাখানে ততটা যায় আসে না, তাদের জন্য এ ‘রিজেকশন থেরাপি’র ট্রেন্ডটি অবশ্যই কার্যকর। তবে খেয়াল রাখতে হবে কথোপকথনের সময় যেন যথাযথ নিরাপত্তামূলক বা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ থাকে।
মনোবিশেষজ্ঞ উইলমার এবং বাকি বিশেষজ্ঞরা সোশাল মিডিয়ার নয়া ট্রেন্ড ‘রিজেকশন থেরাপি’-র চ্যালেঞ্জের বিষয়ে নানা পরামর্শ বাতলেছেন, যাতে এটি কোনওভাবেই উপকারের বদলে অপকারী না হয়ে ওঠে।
প্যানিং পেশায় নারীদের ভালোবাসা, সেক্স এবং রিলেশনশিপ কোচ। এ বিষয়ে সোশাল মিডিয়ায় তিনি নানা পরামর্শমূলক পোস্টও দেন। ‘রিজেকশন থেরাপি’ ট্রেন্ড সম্পর্কে তিনি প্রথম জানতে পারেন যখন তিনি চায়নিজ-আমেরিকান ভ্লগার জিয়া জিয়াং এর একটি টেডএক্স শো থেকে। জিয়া জিয়াং ‘রিজেকশন থেরাপি ফর হানড্রেড ডেইজ’ নামের একটি ভিডিও ভ্লগ ও বই লিখে রীতিমত সেলিব্রেটি হয়েছেন। আবার জিয়াংও রিজেকশন থিওরির এই প্রেরণা পেয়েছেন কানাডিয়ান উদ্যোক্তা জেসন কোমের তৈরি একটি কার্ড গেইম থেকে।
২০১৫ সালে জিয়াংয়ের ওই অনুষ্ঠান দেখার পরে প্যানিং আরও বেশ কয়েকজনকে তা দেখান আর বলেন প্রত্যাখান ততটা ভীতিকরও নয়, যতটা মনে করা হয়।
এ বছরের গ্রীষ্মে প্যানিং প্রতিদিনকার একটি চ্যালেঞ্জ হাতে নেয়। টানা ৩০দিন তিনি বাইরে বের হয়ে নানা ব্যাপারে প্রত্যাখাত হওয়ার ভিডিও করে সেটি টিকটকে পোস্ট করেন। এসব ভিডিওতে দেখা যায়, অপরিচিত লোকদের তিনি কখনও জড়িয়ে ধরার অনুরোধ করছেন কিংবা কোনও কাপড়ের দোকানে গিয়ে ম্যানিকুইনের সঙ্গে থাকতে চাইছেন, অথবা কোনও বিছানা-বালিশের দোকানে গিয়ে আব্দার করছেন ডিসপ্লেতে রাখা বিছানার ওপর একটু ঘুমিয়ে নিতে চান বা কোনও স্যান্ডউইচের দোকানে গিয়ে নিজের স্যান্ডউইচ নিজেই বানিয়ে নেয়ারও আব্দার করেছেন।
এ চ্যালেঞ্জের শুরুতে জড়তা ও অস্বাচ্ছন্দ্যতায় ভুগলেও পরে ৩০দিনের মধ্যেই প্যানিং সহজভাবে সবকিছু নিতে শিখেন।
এই ব্যাপারে প্যানিংয়ের অভিজ্ঞতা বেশ মজার। বেশিরভাগ সময় প্রত্যাখ্যাত হলেও কোনও কোনও সময় আজব আব্দার বা প্রশ্নের পর ইতিবাচক উত্তরও পেয়েছেন। এর বিপরীতে তার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, “ওয়াও, সহজে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করে, প্রত্যাখানের ভয়ে আমরা কতটা ছাড় দেই আসলে?”
ওদিকে যার টেডএক্স দিয়ে প্যানিং-এর ‘রিজেকশন থেরাপি’ ট্রেন্ডের প্রতি আগ্রহ সেই জিয়াং সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এ ট্রেন্ডের শৈল্পিক দিকটা হচ্ছে দুইজন মানুষই যেন মজা পায় সেটি নিশ্চিত করা এবং অবাঞ্ছিত প্রশ্ন করার ফলে আরেকজন যেন বিব্রত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা।
এ ক্ষেত্রে নিজের কৌশল সম্পর্কেও প্যানিং বলেন, “আমি নিজের একটি সীমা ঠিক করে নিই। আমি মানুষকে তা করতে বলি না, যেটি আমি নিজে কখনো করবো। আমি যাতে নিজেই অবসাদগ্রস্ত হয়ে যা পড়ি এবং অন্য মানুষটির জন্যও যেন ব্যাপারটি সহজ হয় সেই গাইডলাইন আমি ঠিক করে নিই। আমি প্রশ্নের উত্তরের ইতিবাচকতা বা নেতিবাচকতা নিয়ে ভাবি না। যদি ‘হ্যা’ হয়, তাহলে গ্রেট। যদি উত্তর ‘না’ হয় তাহলেও ব্যাপারটা অপূর্ব।”
টিকটিকের এই নতুন চ্যালেঞ্জ আসলে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ারও একটি মাধ্যম। এর মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উদ্বেগের মতো অস্বস্তিকর আবেগের বহির্প্রকাশ সম্পর্কে সহজেই ধারণা পাওয়া যায় বলে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি ভিত্তিক অ্যাওয়েক থেরাপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাইকোথেরাপিস্ট জর্দান ট্রাভার্স মনে করেন।
কিন্তু কেউ যদি ভিডিও করতে গিয়ে অতিরিক্ত পরিমাণের চাপ অনুভব করেন এবং এই কাজটি করতে গিয়ে গলদঘর্ম হোন তাহলে শুটিং বাদ দিয়ে তার বরং মনোবিদের কাছেই যাওয়া উচিত বলে পরামর্শ দেন ট্রাভার্স।
কীভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় মোকাবিলা করবেন
ট্রাভার্স বলেন, এক্সপোজার থেরাপি মানুষকে অস্বস্তিকর অনুভূতিতে বশে আনার অনুশীলন। বিশেষ যেসব পরিস্থিতি সামাল দিতে মানুষের ভীতি বা উদ্বেগের মতো অনুভূতিতে ভোগে।
তিনি যোগ করেন, অনেক সময়ই এরকম হয় যে, মানুষ উদ্বেগের পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে তার মুখোমুখি হতে চান না। এ অবস্থাটি ওই ব্যক্তির মনের ওপর আরও চাপ বাড়ায়। এটি তার জীবনযাপনের ওপরও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে।
মনোবিদ উইলমার বলছেন, “প্রত্যাখাত হতে পারেন এমন শঙ্কা থেকে নার্ভাস অনুভূত হওয়া, উদ্বেগ বা চাপের পাশাপাশি ভয় অনুভূত হওয়া খুব সাধারণ মানবিক অভিজ্ঞতা। এ অনুভূতিগুলোও আমাদের মূলত নিরাপদ থাকতে সাহায্য করে। তবে সেই ভয় বা মানসিক উদ্বেগ যদি আমাদের জীবনযাপনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তখন কিছু বাড়তি সাহায্য বা উদ্যোগের প্রয়োজন হয়।”
ট্রাভার্স বলছেন, মনে রাখা দরকার, সোশাল মিডিয়ায় রিজেকশন থেরাপি চ্যালেঞ্জে নেমে যে ধরনের অনুভূতি হয়, বাস্তব জীবনে সেই অনুভূতি ভুলও হতে পারে। যেমন- বাস্তব জীবনে একটি কর্মসংস্থানের আবেদন প্রত্যাখ্যান কিংবা প্রেমের প্রস্তাবের ব্যর্থতার পর অনুভূতি রিজেকশন চ্যালেঞ্জে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার চেয়ে ঢের বেশি আলাদা।
এই আত্ম-সহায়তার ট্রেন্ডটি অবশ্য মানুষকে প্রত্যাখানের পর সহনশীল আচরণে অভ্যস্ত হতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি এটাও তাদের ভেতরে গেঁথে দিতে পারছে যে, আমাদের মস্তিষ্ক যতটা প্রত্যাখান আশঙ্কা করে, বাস্তবে আমরা তার চেয়ে বেশি ইতিবাচক উত্তর পাই।
টিকটকের রিজেকশন চ্যালেঞ্জের ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, অনেকক্ষেত্রেই আব্দারকারীকে বিস্মিত করে ইতিবাচক উত্তর এসেছে। আবার অচেনা লোকেরা নেতিবাচক উত্তর দিলেও, তা অমায়িক ও মার্জিত ভঙ্গিতে দিয়েছেন।