Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

একুশে ফেব্রুয়ারি এখন

তিন প্রজন্মের চোখে একুশ

তরুণ প্রজন্মের অনেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি কিভাবে উদযাপন করবে তা নিয়ে বিভ্রান্ত। প্রতীকী ছবি।

বায়ান্নর ভাষা শহীদদের রক্তস্রোত মিশে গেছে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের গৌরবগাথায়। ভাষার জন্য বাঙালির সেই আত্মত্যাগ আজ সারাবিশ্বে এক গৌরবময় আসনে প্রতিষ্ঠিত।

রাষ্ট্রীয় দিবসের সর্বোচ্চ মর্যাদায় একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি এখন ‘শহীদ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। তবে দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে এই দিবস নিয়ে ধারণাও বদলেছে।

২০০০ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত অন্য সবার মতো এই দিনটি ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছিলেন আব্দুল বাতেন মিলন, রাণি বেগম ও নাজমুস সাকিবরা। ৫৬ বছর বয়সী আব্দুল বাতেন এবং ৪৪-এ পা দেওয়া রাণি বেগমের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি এখনও ‘শহীদ দিবস’।

বাতেন বলেন, “একুশ নিয়ে আমার যে আবেগ, সেটা স্কুলকেন্দ্রিকই বেশি। কারণ তখন নিজেকে একজন রফিক মনে করতাম। বন্ধুদেরকেও বলতাম আমাকে যেন, রফিক নামে ডাকে। ভাষা শহীদদের প্রতি যে আবেগ, যে মমতা সেই মমতার কথা মনে হলে এখনো চোখে পানি আসে। বায়ান্নর আন্দোলন সম্পর্কে দাদার থেকে শুনেছি, জেনেছি, ধারণ করেছি।”

শৈশবের একুশ পালনের স্মৃতি এখনও অমলিন তার কাছে।

“এখনকার মতো বাজারে নানা ঢঙে ফুলের স্তবক পাওয়া যেত না। আমার ছোট বোন লিজা ডিসেম্বরে অনেক গাঁদা ফুলের গাছ লাগাতো বাড়ির পাশে। ফেব্রুয়ারি আসতে আসতে ফুলে ফুলে ছেয়ে যেত। সেই ফুল দিয়ে পাড়ার ছেলে-পেলে সবাই মিলে মালা বানাতাম।’’

“ভোরবেলা প্রভাতফেরির সেই গানের সাথে খালি পায়ে ফুল হাতে চলে যেতাম স্কুলমাঠের শহীদ মিনারে। এই যে আবেগ, এই যে শোক সেটা শুরু হতো অনেক আগে থেকে। শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়ালেই হু হু করে কান্না আসতো বুক ভেঙে।”

“এখন সেই দিবসকে ঘিরে যে আয়োজন তাতে আমি বুঝি না, এটা শোক নাকি সুখ,” বলেন বাতেন।

তার সঙ্গে যোগ করে রাণি বেগম বলেন, “শহীদ দিবস হিসেবে আমরা যখন পালন করতাম। সেখানে শহীদ শব্দটা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। সেটা উপেক্ষা করা সহজ না। আপনি সেখানে হাসি মুখ করে সেলফি নেওয়ার কথা চিন্তা করতে পারবেন না। আপনি যতবার শহীদ দিবস উচ্চারণ করবেন, চোখে দেখবেন আপনার মনে পড়তে হবে, সেই আর্তনাদ, সেই মায়েদের খালি কোল, সেসব মুখ যারা জীবন দিয়েছেন। আমি এখনও একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবেই মনে করি।”

তিনি সেই সঙ্গে বলেন, “অবশ্যই এই শোক আমাদের শক্তি জুগিয়েছে। মুক্তি সংগ্রামে জৌলুস এনেছে। সেই জৌলুস থেকে একটি স্বাধীন দেশ আমাদের অর্জনও বটে। কিন্তু এই যে ভাষা শহীদদের যে ত্যাগ, তাদের কথা স্মরণে শোকটা যেন হারিয়ে না যায়।”

নাজমুস সাকিবের প্রতিক্রিয়া কিছুটা ভিন্ন। তিনি স্কুলজীবনে ‘শহীদ দিবস’ পালন করলেও কলেজে গিয়ে পালন করেন ‘শহীদ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।

সাকিব বলেন, “স্কুলে এই দিনটি নিয়ে আমাদের শিক্ষকরা আলোচনা সভার আয়োজন করতেন। ভাষা আন্দোলন আর সেই আন্দোলনে শহীদদের কথা। তাদের আত্মত্যাগের কথাই বারবার উঠে আসতো। সকালে রেডি হয়ে চলে যেতাম স্কুলে। বড় ব্যানারে কালোর উপর সাদা রঙে লেখা ছিল ‘শহীদ দিবস’, আর পুরো ব্যানারের ৭০ শতাংশ জায়গা ছিল শহীদ মিনারের জলছাপ, সেটিও ছিল সাদাকালোতেই। স্কুলের মাইকে বারবার একই গান বাজতো। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…আমি কি ভুলিতে পারি। এই সুরের মধ্যে একটা কি যেন আছে, শুনলেই বুকটা ভার হয়ে আসে।’’

‘‘আব্বা টিভিতে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের নিয়ে নানা প্রতিবেদন বারবার দেখতেন আর দুঃখ প্রকাশ করতেন। বলতেন, দেখ তুই কত প্রিভিলেজড। তারা তাদের জীবন দিয়ে তোকে আমাকে ঋণী করে গেছেন।”

স্কুল শেষ করে কলেজে ওঠার পর একুশে ফেব্রুয়ারির ব্যানার পাল্টে যেতে দেখলেন সাকিব।

“শহীদ মিনার চলে গেল এক কর্নারে। যুক্ত হলো বিভিন্ন রঙে লেখা বর্ণমালা। আর বড় করে লেখা ‘মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।”

শোক ছাপিয়ে কিছুটা উৎসবের আমেজও ধরা পড়ল সাকিবের চোখে।

“একাদশের জুনিয়রদের দেখলাম দল বেঁধে সবাই সাদা-কালো থিমে পাঞ্জাবি-শাড়ি পড়ে এসেছে। স্কুলেও অনেকে পরতো কালো। কিন্তু সেটাতেই এত প্রাধান্য দেওয়া আগে চোখে পড়েনি। মনে হচ্ছে, শোকের দিনটাও যেন অন্যান্য উৎসবের মতো হয়ে যাচ্ছে।”

কোনটা ঠিক— তা বুঝে উঠতে পারছেন না সাকিব।

“ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক বলতে পারব না। তবে আমার মনে হয়, এই দিন যারা গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়েছিল, তাদের স্মরণে আমাদের নিজেদের একটু স্থির রাখা প্রয়োজন। এখন মৃত বাড়িতে গিয়ে তো কেউ দাঁত বের করে হাসবে না, সেলফি তুলতে ব্যস্ততাও দেখাবে না।”

যারা জন্মের পর থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন, তাদের রয়েছে ভিন্নমত।

লুতফুরনেছা রিতু বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিউপি) স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, “অবশ্যই একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস আমি গুরুত্বের চোখে দেখি এবং পালনও করি। অলরেডি আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে নিত্যউপহার থেকে একুশের টি-শার্ট কিনেছি। ইচ্ছা আছে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাওয়ার। শাড়ি পড়ে যেতে পারলে ভালো লাগত।” 

বাঙালির একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে গর্বিত রিতু বলেন, “শোক তো আছেই। কিন্তু শোকে কাতর হওয়ার থেকে সেই শোক থেকে শক্তি সঞ্চয় করাকে আমি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আর এটা যেহেতু দিনশেষে একটা অর্জন। সো, এটি বর্ণিলভাবে পালন করা উচিৎ বলেই আমি মনে করি।”

রিতুর মতোই একই মত প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিন হাসান। তিনি বলেন, “বিশ্বের আর কোনও দেশের নিজের মাতৃভাষা নিয়ে এই অর্জন আছে? আমাদের আছে। এটা আনন্দের। আনন্দ প্রকাশে সীমানা বেঁধে দেওয়া উচিৎ না।’’

‘‘কেউ কি মানা করেছে যে এদিন ফ্যাশন করা যাবে না, সুন্দর করে সাজা যাবে না, হাসা যাবে না, ছবি তোলা যাবে না।”

“আন্দোলন কেন হয়েছে বলেন? নিজের মায়ের ভাষার জন্যই তো। সেটা তো আমরা পেয়েছি। এখন আমাদের বিজয়টাকে ছড়িয়ে দেওয়ার দিন। আমি তো মনে করি, বর্ণিলভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনকে ইতিবাচকভাবে দেখা উচিৎ,” বলেন রাকিন।

দিবসটি পালনের আঙ্গিক নিয়ে এমন নানা মতই আসছে। ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসার কাছে একুশের ফেব্রুয়ারি একইসঙ্গে অর্জনের এবং শোকের দিন। “তবে এই অর্জনটা এসেছে সেই দামাল আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। তাই তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, তাদের আত্মার স্মরণে মন কাঁদা, এটাই আসল।”

আবার উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন মনে করেন, শোক থেকে শক্তিতে পরিণত হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি। “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কারণে শহীদ দিবসের চেতনা হারিয়ে যাচ্ছে, আমি সেটা মনে করি না। এটা যেমন শোকের, তেমনি শক্তির। উদীচী মনে করে একুশের এই শোকই শক্তিতে পরিণত হয়েছে।”

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী পেয়ারা কুমারি পদ্ম সকাল সন্ধাকে বলেন, ভাষা আন্দোলন শুধু নিজের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ শেখায়নি। সব ভাষার প্রতি সমান শ্রদ্ধার কথায় বলেছেন। কিন্তু ইদানীং বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে এক ধরণের বিকৃত বাংলায় কথা বলেন সবাই। এটা সবার আগে বন্ধ হতে হবে। আপনি প্রয়োজনে শুধু ইংরেজিতে কথা বলেন, নতুবা বাংলায় কথা বলেন।

‘শুদ্ধ উচ্চারণ’ই শহীদদের প্রতি আসল শ্রদ্ধা নিবেদন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী পেয়ারা কুমারি পদ্ম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ভাষা আন্দোলন শুধু নিজের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ শেখায়নি। সব ভাষার প্রতি সমান শ্রদ্ধার কথায় বলেছেন। কিন্তু ইদানীং বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে এক ধরনের বিকৃত বাংলায় কথা বলেন সবাই। এটা সবার আগে বন্ধ হতে হবে। আপনি প্রয়োজনে শুধু ইংরেজিতে কথা বলেন, নতুবা বাংলায় কথা বলেন।

“যদিও এই ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলাকেই আধুনিকতা মনে করা হচ্ছে। যেন ইংরেজির দুটো শব্দ না থাকলে জাত চলে যাওয়ার মতো অবস্থা। তাছাড়া, আধুনিকতার ছলে বাংলাকে যখন বিকৃত করা হয়, তখন সেটা একরকম অসম্মানজনক বিষয়। এই যে ধরেন ‘প্যারা খাইছি’। আমার মা একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন এই প্যারা মানে কি? বিশ্বাস করেন, আমার প্রশ্নটা শুনে লজ্জা লাগছিল একদম।”

“শহীদদের প্রতি যদি সত্যিকার অর্থে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হয়, তাহলে আমি মনে করি সেটা কেবল সম্ভব শুদ্ধভাবে বাংলা বলার মাধ্যমে, সেই ভাষা যার জন্য তাদের সেই আত্মত্যাগ,” বলেন তিনি।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিশ্বমানের চলচিত্র বানানো উচিৎ

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) এর মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শিশির ভট্টাচার্য সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা প্রতি বছরই ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষা আন্দোলন…মাতৃভাষা নিয়ে কথা বলি। কিন্তু ফেব্রুয়ারি চলে গেলে ভুলে যাই। এটা খুবই দুঃখজনক।

‘‘গত সাত দশকে খুঁজতে গেলে ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে নির্মিত তিনটির বেশি সিনেমা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে জহির রায়হানের কালজয়ী সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে। এর ৩৬ বছর পর আসে ‘বাঙলা’ নামের একটি সিনেমা। সর্বশেষ ২০১৯ সালে অভিনেতা-নির্মাতা তৌকির আহমেদ ভাষা আন্দোলনকে সেলুলয়েডে ধরেছেন ‘ফাগুন হাওয়ায়’ সিনেমায়।’’

‘‘আমি মনে করি ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমাদের বিশ্বমানের চলচ্চিত্র বানানো উচিৎ। পাশের দেশ ভারতকে দেখেন, তারা কিভাবে শিল্প-সংস্কৃতির দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের দেশ, তাদের ইতিহাস কীভাবে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিচ্ছে। আমি-আপনিও হাতে পপকর্ন নিয়ে সেগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখছি। মনে রাখছি। আর ভুলে যাচ্ছি নিজ দেশের আন্দোলন সংগ্রামের কথা।’’

‘‘মানুষ পড়ার থেকেও দেখাকে মনে রাখতে পারে বেশি। খুব সহজে ভুলে না। চোখ বন্ধ করেই যদি আপনি দেখতে পান রফিক, জব্বারকে, তাহলে কেমন হতো বলেন? আর এটা কেবলমাত্র চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই সম্ভব।’’

লেখক: প্রতিবেদক, সকাল সন্ধ্যা।

আরও পড়ুন