Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

টিপ সরানো নিয়েও ট্রল

tip-080324
Picture of আইরিন সুলতানা

আইরিন সুলতানা

ভ্রু যুগলের ঠিক মধ্যখানে পূর্ণ চাঁদের মতো একটি টিপ উপমহাদেশীয় নারীর সাজের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তাড়াহুড়ো করে টিপ পরতে গিয়ে একটু ডানে-বামে হয়ে গেলে কখনও নিকটজন তা দেখে আবার কপালের মধ্যখানে বসিয়ে দেয়, নয়ত ছোট গোল আয়নায় উঁকি দিয়ে মাপমতো টিপ বসাতে নিজেই বসে যান নারী।

মুখের গড়ন বুঝে কেউ বিন্দুর মতো টিপ পরেন। কেউ বড়সড় গোলাকার টিপ বসিয়ে দেন কপালে। কেউ একেবারে দুই ভ্রুর মাঝে টিপ বসান। আবার কেউ ভ্রু থেকে উপরে কপালের মাঝামাঝিতে টিপ পরেন; বিশেষ করে ষাট থেকে সত্তরের দশকের বাংলা ও হিন্দি সিনেমাতে নায়িকাদের কপালের মাঝে টিপ পরতে দেখা যেত।

আবেগ থেকে অনেকে বলেন, টিপ বাঙালি নারীর সজ্জা। আদতে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মিয়ানমার, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়ার সংস্কৃতিতেও টিপ রয়েছে বহু বছর ধরে।

আঠারো শতক থেকে টিপের চল সবার কাছেই আলাদা মাত্রা পায়। তবে সমাজে নানা ভাবে টিপের রেওয়াজ পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো।             

টিপ যখন সাধারণ নারীর কপালে বসে সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেল, তখন পুরুষ শাসিত সমাজে কখনও কখনও সেই টিপ হয়ে ওঠে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। 

স্বাধীনতার টিপ

গত শতকের সাতচল্লিশের পর পাকিস্তান সরকারের ভারতবিরোধী তৎপরতায় বারবার পূর্ব বাংলার সংস্কৃতি ও বিশ্বাসে আঘাত করা হয়েছিল। কখনও শহীদ মিনার ভেঙে, কখনও রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করে, কখনও পহেলা বৈশাখ নিষিদ্ধ করে এবং কখনওবা টিপ পরা নিষিদ্ধ করে।

১৯৬১ সাল ছিল পাকিস্তানে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের চতুর্থ বছর। ওই বছর রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী হতে চলেছিল। এক অলিখিত আদেশে রবীন্দ্র সঙ্গীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয় তখন। ছাত্রীদের কপালে টিপ দেওয়ার ওপরও নেমে আসে খড়্গ। পাকিস্তানি সরকার বোঝাতে চেয়েছিল, টিপ এবং রবীন্দ্রচর্চা পাকিস্তানি আদর্শবিরোধী।তখন টিপ পরা মেয়েরা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক বাহিনীর হেনস্তার শিকার হতো।

পাকিস্তানি জান্তার এই নীতিকে সংস্কৃতির উপর আঘাত বলে মনে করে পূর্ব পাকিস্তান। এই নীতির বিরুদ্ধে এগিয়ে আসে কবি ও বুদ্ধিজীবীরা। টিপ এবং রবীন্দ্রনাথবিরোধী পশ্চিম পাকিস্তানকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করেন তারা। এই  আন্দোলন হয়ে ওঠে মধ্যবিত্তের ভাষা।

জান্তা সরকারের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেই রবীন্দ্র জয়ন্তী করেছিলেন তারা। মেয়েরাও পরেছিলেন টিপ। পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পীরা টিপ পরে গান গেয়েছিলেন।

ওই সময় সনজীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হকসহ আরও অনেকে মিলে ছায়ানট গড়ে তোলেন। বেগম সুফিয়া কামালের হাতে প্রতিষ্ঠা পায় শিশু সংগঠন কচি-কাঁচার মেলা।

তবে পাকিস্তানি সরকারের কাছে এরা গাদ্দার হয়েছিল। টিপ পরে গান গাওয়া সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুনকে ১৯৭১ সালে খুঁজেছিল তারা। যে কারণে একাত্তরে গণহত্যা শুরু হলে ছায়ানটের প্রধান দুই কুশীলব ওয়াহিদুল হক এবং সনজীদা খাতুনসহ অনেকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।

কাঁচপোকার টিপ

কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘পরো ললাটে কাঁচপোকার টিপ’। এই টিপ আবার কেমন?

কাঁচপোকার আরেক নাম হলো গুবরে পোকা। উজ্জ্বল নীলাভ সবুজে রঙের এই পতঙ্গ নীল কাঁচের মতো উজ্জ্বল দেখায়। গায়ে রোদ লাগলে ঝিকমিক করে ওঠে। কেউ বলে এই পোকার গায়ের রঙ ময়ূরী সবুজ। তাই সুদর্শন পোকা নামেও চিনতো অনেকে। তবে এরা বিটল জাতের নয়, বরং গন্ধ ছড়ানো গান্ধি বা স্টিঙ্কবাগ জাতীয় পোকা। এক ধরনের ছোট ছোট গাছের ভেতরে বিশেষ মৌসুমে  বাসা বাঁধতো কাঁচপোকারা। অনেকের কাছে এসব গাছের নামও হয়ে যায় কাঁচপোকা গাছ। কাঁচপোকা দেশলাই বাক্সে পুরে কাঁচপোকা ধরে আনা হতো। পোকার গায়ে শক্ত আবরণ ছাড়িয়ে নিয়ে টিপ বানিয়ে কপালে পরত নারীরা।

কাঁচপোকার টিপ গানে ও কবিতায় শুনতে যতটা মনোহারী, পোকার খোলস থেকে টিপ বানানো ততটাই নির্দয়। বরং কাজল পেতে টিপ পরা বেশি কাব্যিক শোনায়। পাতিলের তলা কালো হলে, হারিকেন অথবা জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিয়ে কালো তলানি  হলে কাজল পাতা হয়ে যেত। সেই কাজল চোখে, আবার সেই কাজলে হতো টিপ। বাংলাদেশ এবং ভারতে অনেক মায়েরা এখনও শিশু সন্তানকে কাজলের টিপ কপালের এক পাশে পরিয়ে দেন।

কলমের মতো ভ্রপেনসিল বা ভ্রুপেন এলো এক সময়। চোখের কাজল আর কপালের টিপ দুটোই হতো তাতে। কেউ কেউ নেইলপলিশ দিয়ে লাল রঙের ফোঁটা বসাতো দুই ভ্রুর মাঝে।

আশি-নব্বই দশকে কুমকুমের টিপ খুব জনপ্রিয় হলো। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের কৌটার ভেতরে থাকতো ১০ রঙের শিশি। টিপ লাগানোর জন্য কাঠিও দেওয়া থাকতো বাক্সে। কাঠি আর শিশিতে থাকা রঙ দিয়ে কপালে নকশা করা টিপ বানাতো মেয়েরা।  

ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা সব সময় শাড়ির সঙ্গে টিপ পরত। তখন প্রায় শাড়ি, চুড়ি, আলতা, চুলে ফুল, চোখে কাজল আর কপালে টিপ ছিল নারীর বিশেষ ফ্যাশন।

আঠা লাগানো ছোট-বড় গোল ভেলভেটের টিপের পাতা গ্রাম থেকে শহরের নারীর কাছে সমান ভাবে জায়গা করে নেয়। অর্ধচন্দ্রাকৃতি, লম্বা পাতার আকারেও টিপ দেখা যায়। ঝকমকে পাথর বসানো টিপও আসে বাজারে। এখন টিপের পাতার চেয়ে টিপের বাক্স তরুণীদের কাছে প্রিয় বেশি। বড় একটি বাক্সের ভেতরে বেশ কয়েকটি ঘর করা থাকে। প্রতিটি ঘরে একেক মাপ ও রঙের অসংখ্য টিপ থাকে। এখন শুধু লাল বা কালো নয়, শাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে বহু রঙের টিপ পরে মেয়েরা।

আবার কপালে হাতে আঁকা ঢাউস আকারের টিপ পরাও অনেকের কাছে খুব প্রিয়। কেউ এমন বড় গোল টিপে বাংলাদেশের লাল-সবুজ আঁকেন। কেউ বর্ণমালা থেকে ক-খ-অ-আ লিখে দেন কপালে। ভাস্কর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী বড় গোল টিপ পরতেন। এ ছিল তার দেশপ্রেম। এ ছিল তার মৌলবাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ। নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী ফেরদৌস আরা, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামালকেও টিপ পরতে দেখা যায় সব সময়। ব্যান্ডদল লালনের কণ্ঠশিল্পী সুমির বিশেষত্বই হয়ে উঠেছে কপালে বসানো বড় আকারের একটি টিপ।

বিধবার অধিকার টিপ

ভারতের চেন্নাইয়ে ৭০ পেরোনো এক বিধবা নারী টিপ পরেছিলেন বলে সেখানে সরকারি কর্মকর্তারা তাকে পেনশনের টাকা দেননি।  তারা টিপ ছাড়া ছবি তুলে জমা দিতে বলেন। ওই নারী নতুন ছবি তুলে জমা দেন শেষ পর্যন্ত।

এর উল্টো চিত্রও আছে। ভারতের মহারাষ্ট্রের কোলাপুর জেলার হেরওয়ার গ্রামে বিধবারা টিপ পরবেন বলে ২০২২ সালে সিদ্ধান্ত নেয় পঞ্চায়েত। 

‘টিপ পরছোস কেন?’

২০২২ সালের ২ এপ্রিল সকালে ঢাকার ফার্মগেইট এলাকায় হেঁটে গন্তব্যে চলেছিলেন তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক ড. লতা সমাদ্দার। মোটর সাইকেল আরোহী পুলিশের পোশাক পরা একজন তাকে ‘টিপ পরছস কেন’ বলে কটূক্তি করে। প্রতিবাদ করলে তিনি লতা সমাদ্দারের পায়ের ওপর মোটর সাইকেল উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

এই ঘটনায় থানায় জিডি করেন লতা সমাদ্দার। পরে জানা যায়, ওই পুলিশের নাম নাজমুল তারেক; যিনি তদন্তের সময় ঘটনার মোড় ঘোরাতে ভিন্ন তথ্য দিয়েছিলেন কর্মকর্তাদের। সিসিটিভি ভিডিও বিশ্লেষণ করে নাজমুলের দেওয়া বক্তব্য ভুল প্রমাণিত হয়।

লতা সমাদ্দারের সঙ্গে হওয়া এই ঘটনা সোশাল মিডিয়া থেকে গোটা দেশ তুমুলভাবে প্রভাবিত হয়। টিপ বাঙালির সংস্কৃতি, নারী আত্মবিশ্বাস এমন অনেক কথা লিখে নিজের টিপ পরা ছবি ফেইসবুকে একের পর এক পোস্ট করে চলেছিলেন নারীরা।

ওই সময় বাংলাদেশিদের প্রতিবাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছিল মার্কিন দূতাবাসের কর্মীরাও। ঘটনার পর ৫ এপ্রিল মার্কিন দূতাবাসের নারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা টিপ পরে ছবি তোলেন।

এই ঘটনায় জাতীয় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই সময় সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, “বাংলাদেশের কোন সংবিধানে, কোন আইনে লেখা আছে যে একজন নারী টিপ পরতে পারবে না?”

সেসময় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন দীপু মনি। তিনি নিজের ভেরিফায়েড ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে টিপ পরা কয়েকটি ছবি পোস্ট করেন এবং লেখেন, “আমি মানুষ, আমি মুসলমান, আমি বাঙালি, আমি নারী।”

২০১৩ সালে এমটিভি মুভি অ্যাওয়ার্ডসে কপালে কারুকাজ করা চকচকে টিপ পরে মঞ্চে উঠে কাম অ্যান্ড গেট ইট গান পরিবেশন করেন মার্কিন শিল্পী সেলেনা গোমেজ।

তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে ভারতের হিন্দু নেতা রাজন জেড বলেছিলেন, ”টিপ পরে গান গেয়ে ভীষণ গর্হিত কাজ করেছেন সেলেনা গোমেজ।

“কারণ কপালে টিপ পরা হিন্দু ধর্মে পবিত্র রীতি এবং আবেদন জাগাতে ফ্যাশনের অঙ্গসজ্জা হিসেবে টিপ পরা মেনে নেওয়া যায় না।”

তবে সেলেনা গোমেজের পক্ষ নিয়ে বলিউড অভিনেত্রী প্রিয়াংকা চোপড়া বলেন, “গানের শিল্পীরা যে বিন্দি মানে টিপের সৌন্দর্য  আবিষ্কার করতে পারছে, এটা তো দারুণ ব্যাপার।

“আজকের দিনে টিপকে ধর্মীয় প্রথার মধ্যে আটকে রাখার সুযোগ নেই। টিপ সাজসজ্জায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। টিপ নারীর তৃতীয় দৃষ্টির মতো। টিপ আসলে নারীশক্তি একটি রূপ। আর ঠিক মতো পরলে টিপ পরা নারী ভীষণ আবেদনময়ী হয়ে ওঠে।”

কপালের টিপ সরল কেন?

২৯ ফেব্রুয়ারি দুই বাংলার অভিনয়শিল্পী জয়া আহসান কপালের মাঝে না পরে একটু সরিয়ে টিপ পরা ছবি দেন ফেইসবুকে। সেই সঙ্গে লেখেন, “স্খলিত হয়ে পড়ছে টিপ।মানুষ হিসেবে তাঁদের মর্যাদা খসে পড়ছে। আসুন, আমরা নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করি। কপালের টিপ সরিয়ে পরে সেলফি তুলি …।”

জয়া আহসানের ওই পোস্টে একটি হ্যাশট্যাগ দিয়ে লেখা ছিল অডডটসেলফি। আর এই হ্যাশট্যাগ অনুসরণ করে অভিনয় তারকা নুসরাত ইমরোজ তিশা, জাকিয়া বারী মম, কনটেন্ট ক্রিয়েটর ডানাও কপালের এক পাশে টিপ সরিয়ে পরে ছবি পোস্ট করেন।

তাদের সবাই #অডডটসেলফি ব্যবহার করেছিলেন। ফেইসবুকে একটি পেইজ রয়েছে অড ডট সেলফি নামে। এছাড়া অড ডট সেলফি ডটকম ওয়েবসাইটও করা হয়েছে।

সরকারি সাহায্যকারী হটলাইন নম্বরগুলোর পাশাপাশি এই প্রচারের পক্ষ থেকেও নারী নির্যাতন বিষয়ক যে কোনও সহযোগিতা ও পরামর্শ নিতে ০৯৬৬৬৯২৪৯২৪ নম্বরে কল করতে বলা হয়েছে।

মঙ্গলদীপ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ এই অড ডট সেলফি প্রচার। এর সঙ্গে রয়েছে এশিয়াটিক এমসিএল এবং রেডিও স্বাধীন ৯২.৪ এফএম।

অভিনয়শিল্পী সারা যাকের মঙ্গলদীপ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন। তিনিসহ আরও অনেক নারীমুখ এশিয়াটিকের উচ্চ পদে কাজ করেন এবং তারা নারীর এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দেন নানা মঞ্চে।   

৮ মার্চ উপলক্ষে নারী নির্যাতন নিয়ে পরিবার, কর্মক্ষেত্র এবং সমাজে ধারাবাহিক প্রতিবাদ চালু রাখার ভাবনা থেকেই এই তিন প্রতিষ্ঠানের ওড ডট সেলফি প্রচার শুরু হয়।

কপালের টিপ সরে গেলে তা সহজেই মানুষের নজরে আসে। এই প্রচারণার উদ্দেশ্য মানুষের ওই মনোযোগ নেওয়া এবং সেখান থেকেই প্রতিবাদের ভাষা গড়ে তোলা।

এই প্রচারণার ওয়েবসাইটে নির্যাতনের কয়েকটি ধরন নিয়ে বলা আছে – পথেঘাটে বাজে মন্তব্য বা ইভ টিজিং, শ্বশুরবাড়ি থেকে জোর করে টাকা চাওয়া, কর্মক্ষেত্রে কারও থেকে অশালীন প্রস্তাব পাওয়া, স্বামীর দ্বারা সবসময় শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হওয়া।

কেউ যদি নারীর অর্থ-সম্পদের অধিকার নিয়ন্ত্রণ করে, বেতন নিয়ে নেয়, কাজে যেতে বাধা দেয়, তবে তা অর্থনৈতিক নির্যাতন হিসাবে দেখতে বলা হচ্ছে।

কীভাবে এই প্রচারের পরিকল্পনা হলো তা সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন এশিয়াটিক এমসিএলের কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স আ্যন্ড সলুশ্যন বিভাগের বিজনেস হেড ফৌজিয়া করিম।

“যেহেতু কমিউনিকেশন এজেন্সি, তাই আমাদের বেশির ভাগ কাজ হয় ক্লায়েন্টের জন্য। এর বাইরে আমাদের নিজেদের কিছু ক্যাম্পেইন করি মাঝে মাঝে। এই ক্যাম্পেইনটা একদম আমাদের হাউজ থেকেই করা।”

“আমাদের এক্সিকিউটিভ ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর মোহাম্মদ আকরুম হোসেন, ক্লায়েন্ট সার্ভিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও এক্সিকিউটিভ বিজনেস ডিরেক্টর মানস পাল এবং সারা যাকের ভাবি মিলে পরিকল্পনাটা করেন। প্রতিবাদ তো করে আসছি আমরা যুগের পর যুগ ধরে। এখন প্রতিবাদের ধরনটা কতটুকু মানুষের নজরে আনা যায়, সেই জায়গাটা তৈরি করা নিয়ে ভাবছিলাম আমরা।”

কপালের টিপ সরিয়ে পরা কী বার্তা দিচ্ছে- প্রশ্নে ফৌজিয়া করিম বলেন, “সমাজে অনেক অসঙ্গতি আছে। এরমধ্যে নারীকে সব সময় সমাজের ধারণায় উত্তীর্ণ হতে হয়। নারীকে পরিপাটি হতে হবে, গোছানো হতে হবে। এই যে পরিপাটি একটা ব্যাপার এরমধ্যে যদি অসঙ্গতি হয়, তখন প্রশ্ন তৈরি হয়।

“টিপটা যদি জায়গা মতো না পরে একটু সরিয়ে দিই, তাহলে এটা একটা অসঙ্গতি । এভাবেই মেয়েদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির অসঙ্গতিটা তুলে আনতে চেয়েছি আমরা।”

মঙ্গলদীপ ফাউন্ডেশন প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফৌজিয়া ইব্রাহিম সকাল সন্ধ্যার কাছে নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন।

দেশে গণপরিবহনে চলাচল করা নানা বয়সী নারীদের ৬৩ শতাংশ হয়রানির শিকার হন। এর মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হন।

আর এভাবে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নারীদের প্রায় অর্ধেক বা ৪৫ শতাংশ পরে মানসিক সমস্যা ভোগেন।

বাংলাদেশে প্রতি তিনজনে একজন নারী ঘরে এবং বাইরে  নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

লিঙ্গসমতাসহ নারীর বিভিন্ন অধিকারের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে এর আগে উইমেন অব দ্য ওয়ার্ল্ড- ওয়াও ফেস্টিভাল হয়েছিল রাজধানীতে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ওয়াও ফাউন্ডেশনের সহায়তায় দুই দিনের এই উৎসবের আয়োজদের মধ্যে ছিল মঙ্গলদীপ ফাউন্ডেশনও।

প্রতিষ্ঠানটির এবারের উদ্যোগ ওড ডট সেলফি  নিয়ে ফৌজিয়া ইব্রাহিম বলেন, “আমাদের দেশে সাধারণ নারীও টিপ পরেন। আবার উচ্চবিত্ত নারীও টিপ পরছেন। টিপ তাই সব স্তরের নারীর। এই টিপ সরিয়ে পরলে নারী যে কিছু একটা বলতে চায়, সেটাই বোঝানো হচ্ছে এই ক্যাম্পেইনে।” 

পুরুষের কপালেও টিপ 

যোদ্ধারা তিলক পরতেন কপালে। রাজাদের কপালে বসতো রাজ তিলক।

২০২২ সালে তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক লতা সমাদ্দারের ওই ঘটনায় সোশাল মিডিয়াতে শুধু নারীই প্রতিবাদ করেনি। অনেক পুরুষও নেমেছিল জোরালো প্রতিবাদে। ফেইসবুকে টিপ পরে একেক পর এক ছবি পোস্ট করেন তারা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ-আল মামুন, কবি সৈয়দ তারিক, সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউটের স্কলার ইমামুল বাকের এ্যাপোলো, সাংবাদিক ওমর ফারুক শামীম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক কৌশিক আহমেদ, লেখক শেখ সাদ্দাম হোসেন টিপ পরে ছবি দেন ফেইসবুকে। অভিনেতা সাজু খাদেম এবং আনিসুর রহমান মিলনও প্রতিবাদে যোগ দিয়ে টিপ পরা ছবি দেন ওই সময়।

কিন্তু পুরুষদেরও টিপ পরে প্রতিবাদে যোগ হওয়া তখন মেনে নেননি অভিনেতা সিদ্দিকুর রহমান। তিনি ফেইসবুকে লিখেছিলেন, “শিল্পীরা যে এমন কাজ করতে পারেন, তা আমি ভাবতেও পারি না।”

অড ডট সেলফি প্রচারণা শুরুর পর এই হ্যাশট্যাগ দিয়ে অনেক পুরুষও কপালের একদিকে সরিয়ে টিপ পরা ছবি দিচ্ছেন। পুরুষদের কেউ গালে বড় টিপ বসিয়ে ছবি দিচ্ছেন। কেউ হয়ত প্রকৃত অর্থেই টিপ পরছেন, কেউ ছবিতে এডিট করে টিপ বসিয়ে দিচ্ছেন।

মূল প্রচারণায় থাকা নারী নির্যাতনের কথাটি একটু পাল্টে টিপ পরা পুরুষদের অনেকে লিখছেন, “বাংলাদেশে প্রতি তিনজনে দুইজন পুরুষ ঘরে মা-বোন-বউয়ের কাছে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিন্তু এটা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ হয় না। কারণ, আমাদের সমাজে পুরুষদের শেখানোই হয় চুপ থাকতে এবং ফ্যামিলিকে প্রোভাইড করতে। কিন্তু আমরা চাই, এই ট্যাবু ভেঙে আওয়াজ তুলুক প্রতিটি পুরুষ।”

উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের ছবি এডিট করে এক দিনে সরিয়ে টিপ বসিয়ে পুরুষ নির্যাতনের কথা লিখে পোস্টও দেখা গেছে। এমনকি কুকুরের কপালে টিপ বসানো ছবিও পোস্ট করা হয়েছে।

এবার পুরুষরা যেভাবে টিপ পরেছেন, তা অড ডট সেলফি ক্যাম্পেইনটিকে ব্যঙ্গ করার মতোই। অনলাইনের ভাষায় এই ব্যঙ্গ করাকে বলে ট্রল।

অড ডট সেলফির ওয়েবসাইটে সোশাল মিডিয়াতে হয়রানির কথাও যোগ করা হয়েছে প্রযুক্তিগত নির্যাতন শিরোনামে।

অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ২০২২ সালের নভেম্বরে এক সমীক্ষা থেকে জানায়, দেশে ৬৩.৫১ শতাংশ নারী অনলাইন সহিংসতার শিকার।

অড ডট সেলফি ক্যাম্পেইনটির ট্রল নিয়ে মঙ্গলদীপ ফাউন্ডেশনের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ফৌজিয়া ইব্রাহিম বলেন, “সোশাল মিডিয়া এমন একটা জায়গা যেখানে  ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুটোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। কিছু মানুষ থাকে, যারা একটা সুন্দর বার্তাকে অন্যরকম করে দেখতে চায়। মানুষ কীভাবে এই ক্যাম্পেইনটা নিয়ে কথা বলছে এটা দেখাটাই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল।

“সামাজিক মাধ্যমে আমরা যেটা দেখতে পাই, এটা আমাদের সমাজেরই একটা প্রতিচ্ছবি। তাই একশ জনের মধ্যে বিশ জন আমাদের ট্রল করে তারমানে তো আমাদের সমাজেও এই অবস্থা রয়ে গেছে। এই যে ট্রলিং হচ্ছে, এটাই তো আমরা বলতে চেয়েছি; নারী নির্যাতন সমাজে রয়েছে এবং সমাজ নারী নির্যাতনকে তুচ্ছ করে দেখে এখনও। তাই যতই হাসাহাসি হোক, আমাদের কথা বলতে হবে। আমরা কথা বলেই যাব।”

এ ধরনের ট্রল কি ‍অড ডট সেলফি ক্যাম্পেইনটিকে দুর্বল করে দিচ্ছে?

এশিয়াটিক এমসিএলের কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স আ্যন্ড সলুশ্যন বিভাগের বিজনেস হেড ফৌজিয়া করিম বললেন, এমন প্রতিক্রিয়াও অপ্রত্যাশিত নয়।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন,“যদিও শুরুতে আমরা মন খারাপ করেছিলাম। কারণ অনেকে বাজে কথা বলছে। তারপর আমরা দেখলাম, আসলে এটাই তো সামাজের প্রতিচ্ছবি। একটা মেয়ে যখন ট্যাবু ভাঙার চেষ্টা করে, সমাজের বেঁধে দেওয়া গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, তখন কিন্তু তাকেও এভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।

“হয়ত এমনও তুলনা আসতে পারে, পুরুষও নির্যাতিত হচ্ছে, তাহলে আর নারীর কথা বলার দরকার আছে কি না। এসব ট্রল আমাদের ক্যাম্পেইনের জায়গাটাকে আরও শক্তিশালী করছে। পুরুষতান্ত্রিক জায়গা থেকে বাধাগুলো আসে। এটাই তো আমাদের বাস্তবতা। আমরা এই বাস্তবতাটাই দেখাতে চেয়েছিলাম সবাইকে।” 

নারী নির্যাতনের মতো পুরুষ নির্যাতনের পরিসংখ্যানও রয়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ম্যান’স রাইটস ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন জানায়, বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ বিবাহিত পুরুষ মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন এবং লোকলজ্জার ভয়ে অনেকেই তা প্রকাশ করতে চান না।

তাহলে যারা ট্রল করছেন তারা নারী নির্যাতনের পাশাপাশি পুরুষ নির্যাতনের চিত্রটিকেও হালকা করে দেখছেন কি?

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ফৌজিয়া ইব্রাহিম বলেন, “পুরুষদের মধ্যে এখন অনেকে মনে করেন, নারীদের তো উন্নয়ন হয়ে গেছে; আর কথা বলার দরকার কী? তাদের জানতে হবে, বিষয়টা এরকম না। তাই আমরা ক্যাম্পেইনটা বন্ধ করব না।”

“পুরুষ নির্যাতন নিয়েও আমরা কথা বলি বিভিন্ন মঞ্চে। আগামীতেও পুরুষ নির্যাতন নিয়ে আরও কথা তুলে আনব আমরা। আমরা পুরুষ নির্যাতনকে অস্বীকার করছি না। এবং পুরুষ নির্যাতন ট্রল করারও বিষয় না।”

হ্যাশট্যাগ অড ডট সেলফি দিয়ে কেউ কেউ বলছেন, এভাবে কি নারী নির্যাতন আদৌ প্রতিরোধ করা সম্ভব?

ফৌজিয়া ইব্রাহিম এমন সমালোচনাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “ট্রল যারা করছেন, তাদের মধ্যে তো পুরুষরা রয়েছেন। অনেকে বলছেন, সেলফি তুলে দিলে কি নির্যাতন বন্ধ হবে?

“না, নির্যাতন বন্ধ হবে না। কিন্তু প্রতিবাদের জায়গাটা আমাদের ধরে রাখতে হবে। এই ক্যাম্পেইন থেকে আমরা এটা প্রত্যাশা করব না যে একদিনে বা এক মাসে সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে আমাদের ওয়েবসাইট থেকে তথ্য নিয়ে সচেতন হতে পারেন অনেকে।

“দেখা যায়, বাসে নারীর জন্য যে নির্দিষ্ট আসন রয়েছে, তা নিয়েও অনেক সময় পুরুষরা একভাবে তর্ক-আপত্তি করেন। নারী ও পুরুষ দুজনেরই সমান ভাবে আসন পাওয়ার অধিকার অবশ্যই আছে। কিন্তু ওই জায়গাটায় আমরা এখনও যেতে পারছি না। কারণ নারীদের সম্মান করার বিষয়টায় আমাদের ঘাটতি আছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত