মাইক্রোপ্লাস্টিক বা প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা মানবদেহে প্রবেশ করছে। এটি মোটামুটি পুরনো খবর। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্কেও যে এই কণা পাওয়া যাচ্ছে, তা নিয়ে গবেষকরাও এখন পর্যন্ত মুখ খোলেননি।
একদল গবেষক এ বছরের শুরুতে মৃতদেহ থেকে মস্তিষ্কের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করেন। তারা দেখতে পেয়েছেন, আট বছর আগে সংগ্রহ করা মস্তিষ্কের নমুনার তুলনায় এখন মানুষের মস্তিষ্কে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা বেশি পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে।
সম্প্রতি একটি অপ্রকাশিত গবেষণাপত্রে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। অপ্রকাশিত গবেষণাপত্র বলতে বোঝায় এমন একটি গবেষণা যা এখনও সহকর্মীদের মাধ্যমে পর্যালোচিত হয়ে কোনও জার্নালে প্রকাশিত হয়নি।
ইউনিভার্সিটি অব নিউ মেক্সিকোর ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণার প্রধান ম্যাথিউ ক্যাম্পেন বলেন, “আমরা যেসব স্বাভাবিক ব্যক্তির মস্তিষ্কের টিস্যু পরীক্ষা করেছি, তাদের গড় বয়স ৪৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। সেখানে প্রতি গ্রাম টিস্যুতে ৪ হাজার ৮০০ মাইক্রোগ্রাম বা ওজনের হিসাবে ০ দশমিক ৫ শতাংশ পদার্থ পাওয়া গেছে।
“২০১৬ সালে মৃতদেহ থেকে সংগ্রহ করা মস্তিষ্কের নমুনার তুলনায় এটি প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ আজকের আমাদের মস্তিষ্ক ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ মস্তিষ্ক, বাকি অংশ প্লাস্টিক দিয়ে গঠিত।
“পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আমরা মনে করি, মস্তিষ্ক অতি ক্ষুদ্র ন্যানোস্ট্রাকচারগুলোকে, যেমন ১০০ থেকে ২০০ ন্যানোমিটার দৈর্ঘ্যের কণিকাগুলোকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। কিছু বৃহত্তর কণা, যেমন এক মাইক্রোমিটার থেকে পাঁচ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত, লিভার ও কিডনিতে চলে যায়।”
গবেষণার জন্য গবেষকরা ৯২ জন ব্যক্তির মস্তিষ্ক, কিডনি ও লিভারের টিস্যু পরীক্ষা করেছেন। এসব মরদেহের মৃত্যুর কারণ যাচাই করতে ২০১৬ ও ২০২৪ সালে ফরেনসিক ময়নাতদন্ত করা হয়েছিল। মস্তিষ্কের টিস্যু নমুনাগুলো ফ্রন্টাল কর্টেক্স থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল, যা চিন্তা এবং যুক্তি সম্পর্কিত মস্তিষ্কের অঞ্চল। অঞ্চলটি একই সঙ্গে ফ্রন্টোটেম্পোরাল ডিমেনশিয়া (এফটিডি) এবং আলঝেইমার রোগের পরবর্তী পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়।
তবে অপ্রকাশিত ওই গবেষণাপত্রটির সঙ্গে যুক্ত নয় এমন একজন গবেষক নিউ জার্সির রুটগার্স ইউনিভার্সিটির ফার্মাকোলজি ও টক্সিকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফিবি স্টেপলটনের মতে, “মস্তিষ্কে প্লাস্টিকের এই বৃদ্ধি কেবল এক্সপোজার বা সংস্পর্শে আসার পরিমাণ নির্দেশ করে। মস্তিষ্কের ক্ষতি সম্পর্কে কোনও তথ্য দেয় না।”
তিনি এক ইমেইল বার্তায় বলেন, “জীবদ্দশায় এই কণাগুলো প্রবাহী হয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে এবং বেরিয়ে যায়, নাকি স্নায়ুবিক টিস্যুতে জমা হয়ে রোগের সৃষ্টি করে, তা স্পষ্ট হয়। কণাগুলো টিস্যুর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করছে এবং এর ফলে কোনও বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না তা বুঝতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।”
অপ্রকাশিত গবেষণাপত্র অনুযায়ী, মৃতদেহের মস্তিষ্কের নমুনায় কিডনি ও লিভারের নমুনার তুলনায় ৭ থেকে ৩০ গুণ বেশি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে।
বোস্টন কলেজের গ্লোবাল পাবলিক হেলথ অ্যান্ড দ্য কমন গুড এবং গ্লোবাল অবজারভেটরি অন প্ল্যানেটারি হেলথের পরিচালক ড. ফিলিপ ল্যান্ডরিগান বলেন, “বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মানবদেহের হৃদপিণ্ড, বড় রক্তনালী, ফুসফুস, লিভার, শুক্রাণু গ্রন্থি, অন্ত্র ও গর্ভাবস্থায় গর্ভাশয়ের প্লাসেন্টায় প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
“মানুষকে অতিরিক্ত ভীত করার কোনও কারণ নেই। কারণ এক্ষেত্রে বিজ্ঞান এখনও বিকাশের পথে রয়েছে। ২০২৪ সালে কেউই প্লাস্টিক ছাড়া বাঁচতে পারবে না।
“আমি মানুষকে বলি, কিছু প্লাস্টিক এড়ানো সম্ভব নয়। আপনি প্লাস্টিক ছাড়া মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার পাবেন না। তবে আপনার পক্ষে এড়ানো যায় এমন প্লাস্টিক যেমন, প্লাস্টিক ব্যাগ এবং বোতলের সংস্পর্শে আসা যতটা সম্ভব কমানোর চেষ্টা করুন।”
আমেরিকান কেমিকেল কাউন্সিল সিএনএনকে জানিয়েছে, “বর্তমান বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দেখায় না যে খাদ্যে শনাক্ত করা মাইক্রোপ্লাস্টিক বা ন্যানোপ্লাস্টিকের মাত্রা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য কোনো ঝুঁকি সৃষ্টি করে।”
কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রক ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কিম্বার্লি ওয়াইজ হোয়াইট বলেন, “বর্তমান গবেষণা কেবল মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসার বিষয়ে আমাদের তথ্যের ঘাটতি পূরণে সহায়তা করছে তা নয়। এটি মানুষের উপর মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিষাক্ততার মাত্রা পরিমাপের জন্য উন্নত যন্ত্রপাতি বিকাশের লক্ষ্যেও কাজ করছে।”