ধর্ম অবমাননার অভিযোগে চার বছর আগে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাময়িক বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী তিথি সরকারকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
তবে এর মধ্যে এক বছরের জন্য তিনি প্রবেশনে থাকবেন। সেই সঙ্গে রায় ঘোষণার আগে যে ২১ মাস কারাভোগ করেছেন, তাও বাদ যাবে মোট সাজার মেয়াদ থেকে।
সাধারণ ক্যালেন্ডারের হিসেবে, আর সোয়া দুই বছরের মতো কারাগারে থাকতে হবে তিথি সরকারকে।
সোমবার দুপুরে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত এ রায় ঘোষণা করেন।
আদালতের বেঞ্চ সহকারী জুয়েল মিয়া জানান, তিথি সরকারকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। তবে রায় ঘোষণার আগে যে ২১ মাস তিনি কারাভোগ করেছেন তা এই পাঁচ বছর থেকে বাদ যাবে।
রায় ঘোষণার আগে ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুযায়ী তিথি সরকারকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয় আদালত। সাক্ষ্যে রাষ্ট্রপক্ষ কী উল্লেখ করেছে তা পড়ে শোনানো হয় তাকে।
এরপর তিথির কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি নির্দোষ কিনা। এ পর্যায়ে তিনি দোষ স্বীকার করলে বিচারক রায় ঘোষণা করেন।
জুয়েল মিয়া আরও বলেন, তিথি সরকারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাকে এক বছরের জন্য প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছে। এ সময় তিনি সমাজ সেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বধায়নে থাকবেন এবং তাকে প্রবেশন সংক্রান্ত সব নিয়ম নীতি মেনে চলতে হবে।
প্রবেশন সম্পর্কে
একজন অপরাধীকে তার প্রাপ্য শাস্তি স্থগিত রেখে, কারাবদ্ধ না রেখে বা কোনও প্রতিষ্ঠানে আবদ্ধ না করে সমাজে খাপ খাইয়ে চলার সুযোগ দেওয়ার পদ্ধতিই হলো প্রবেশন। প্রথম ও লঘু অপরাধে আইনের সঙ্গে সংঘর্ষে বা সংস্পর্শে আসা শিশু-কিশোর বা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যাক্তিকে প্রথম ও লঘু অপরাধে দায়ে কারাগারে বা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে না রেখে আদালতের নির্দেশে প্রবেশন দেওয়া হয়।
এক্ষেত্রে অফিসারের তত্ত্বাবধানে এবং শর্ত সাপেক্ষে তার পরিবার ও সামাজিক পরিবেশে রেখে তার অপরাধ সংশোধন ও সামাজিকভাবে একীভূত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
প্রবেশন মঞ্জুর করা বিচারকের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা।
দি প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ (১৯৬৪ সালে সংশোধিত) এর আওতায় ক্ষমতাপ্রাপ্ত আদালত প্রথম ও লঘু অপরাধে জড়িত শিশু কিশোর বা প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিকে শর্ত সাপেক্ষে এক থেকে তিন বছরের জন্য প্রবেশন মঞ্জুর করতে পারে। সাধারণত শিশু-কিশোররা এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়। শিশু আইন ২০১৩ এর আওতায়ও শিশু-কিশোররা শিশু আদালতের মাধ্যমে প্রবেশন ব্যবস্থার সুযোগ পায়।
এ দুটি আইনের আওতায় আদালতের শর্ত যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য, তত্ত্বাবধান ও সংশোধনী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ঘটনাক্রম
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সময় তিথি নিজের ফেইসবুক আইডি থেকে ধর্মীয় উস্কানিমূলক পোস্ট, কমেন্ট ও কন্টেন্ট শেয়ার করেছিলেন বলে ২০২০ সালের ২৪ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে কিছু শিক্ষার্থী।
এর ধারাবাহিকতায় ২৬ অক্টোবর তাকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
তবে ২৫ তারিখ থেকে তিনি নিখোঁজ উল্লেখ করে ২৭ অক্টোবর পল্লবী থানায় সাধারণ ডায়রি করেন তিথির বোন স্মৃতি সরকার। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার দিন সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার পর তিথিকে আর পাওয়া যাচ্ছিল না।
অন্যদিকে নিজের ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক হওয়ার অভিযোগে ২৩ অক্টোবর পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়রিও করেছিলেন তিথি।
তবে ২০২০ সালের নভেম্বরে তিথিকে গ্রেপ্তারের পর সিআইডি যে বিবৃতি দিয়েছিল সেখানে বলা হয়েছিল, নিজেকে নিরাপদ রাখতেই তিথি এই জিডি করেন।
তিনি ‘স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে’ থেকে ‘অপহরণের দায়ভার অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সংক্রান্ত ঘটনা থেকে রেহাই’ পাওয়ার কৌশল হিসেবে নরসিংদীতে আত্মগোপনে ছিলেন বলেও সেখানে অভিযোগ করে সিআইডি।
তিথির বিরুদ্ধে মামলায় বলা হয়, ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তিথির বহিষ্কার চেয়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে সাময়িক বহিষ্কার করে।
এরপর তার পরিবার থেকে অভিযোগ আসে তিথি নিখোঁজ। পরে ওই বছরের ৩১ অক্টোবর সিআইডির সাইবার মনিটরিং টিম দেখতে পায়, সিআইডির মালিবাগ কার্যালয়ের চারতলা থেকে তিথি সরকারকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে, এমন তথ্য উল্লেখ করে একটি ‘মিথ্যা’ পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা হয়। এটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলেও প্রকৃতপক্ষে সিআইডিতে এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটেনি।
এ ঘটনার তদন্তে নেমে গুজব রটনাকারী নিরঞ্জন বড়াল নামের একজনকে রামপুরার বনশ্রী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। ওই বছর ২ নভেম্বর নিরঞ্জনসহ অজ্ঞাত আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি করা হয়। পরে ১১ নভেম্বর তিথি সরকারকেও গ্রেপ্তার করে সিআইডি।
২০২১ সালের ১১ মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এসআই মেহেদী হাসান নিরঞ্জন ও তিথির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই বছরের ৪ নভেম্বর তিথি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। সেসময় নিরঞ্জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এরপর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষে সোমবার মামলায় রায় ঘোষণা করা হলো।