Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

মাতামুহুরি আর বাঁকখালীর বাঁকে তামাকের হানা

বাঁকখালী নদীর তীরে  তামাক ক্ষেত। ছবি: সকাল সন্ধ্যা
বাঁকখালী নদীর তীরে তামাক ক্ষেত। ছবি: সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

কক্সবাজারের পাঁচটি নদীর মধ্যে মাতামুহুরি আর বাঁকখালীই প্রধান। এক সময় এই দুই নদীর তীরই সবুজ থাকত শাক-সবজিতে। সেই স্থান এখন দখল করেছে তামাক।

কৃষি কার্যালয়ের তথ্য বলছে, এ বছর রামু উপজেলায় ১৭০ হেক্টরের বেশি জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে।

এই উপজেলায় শাক-সবজি চাষ করা জমির পরিমাণ ২৩০ হেক্টর, যা ২০২২ সালে ছিল ৪০০ হেক্টর।

অন্যদিকে চকরিয়া উপজেলায় ৬২০ হেক্টরের বেশি জমিতে তামাক চাষ করা হচ্ছে এবছর। সেখানে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে শাকসবজি চাষ হচ্ছে। ২০২২ সালে শাক-সবজি আবাদের জমির পরিমাণ ছিল সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর।

মাতামুহুরি ও বাঁকখালী নদীর তীরে বর্তমানে ঠিক কী পরিমাণ জমি তামাক চাষের জন্য উপযোগী করা হয়েছে, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রামুর রাজারকুল, মৈষকুম, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়ার নাপিতেরচর, কাউয়ারখোপ, মনিরঝিল ও ফাক্রিকাটা এলাকায় বাঁকখালী নদীর দুই তীরে এখন কেবল তামাকের ক্ষেত। এলাকার ফসলি জমিগুলোও তামাকের দখলে।

একই চিত্র চকরিয়ায়ও। এই উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টি ইউনিয়নে তামাকের চাষ হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ হচ্ছে বমু বিলছড়ি, সুরাজপুর মানিকপুর ও কাকারা ইউনিয়নে।

এই তিন ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মাতামুহুরী নদীর চর এবং তীরবর্তী জমিতেও তামাকের আবাদ চলছে।

যদিও নদীবেষ্টিত এসব এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তামাক চাষ না করতে সরকারি নির্দেশনামূলক সাইনবোর্ড দাঁড়িয়ে আছে।

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫-এর ধারা ৫ ও ১১-এ তামাকজাত দ্রব্যের পৃষ্ঠপোষকতা, তামাকজাতীয় ফসল উৎপাদন ও ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা আছে।

তবে তামাক কোম্পানিগুলো এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করে তামাক চাষে কৃষকদের প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে।

রামুর কাউয়ারখোপ এলাকার কৃষক মো. আবদুস ছোবহান ৭ কানি জমিতে তামাক চাষ করছেন। তিনি জানান, একরপ্রতি ১০ হাজার টাকা সুদমুক্ত ঋণ দিয়েছে কোম্পানি। পাশাপাশি বীজ, সার ও পোকা দমনে বিশেষ ধরনের কীটনাশকও দিয়েছে তারা।

উপজেলার আরেক এলাকা কচ্ছপিয়া নাপিতেরচরের কৃষক আবুল কালামও তামাক চাষের জন্য মোটা টাকা পাওয়ার কথা জানান।

একদিনে সুদমুক্ত ঋণ, অন্যদিকে শীতকালীন শাক-সবজির দাম না পাওয়ায় অনেক কৃষক তামাক চাষে ঝুঁকছেন।

চাষিরা এখন বিভিন্ন তামাক কোম্পানির প্রলোভনের লোভের শিকার বলে মন্তব্য করেন চকরিয়ার সুরাজপুর মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম।

তিনি বলেন, “দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে এখানে তামাক চাষ হচ্ছে। এর আগে তামাক চাষ বন্ধে চাষিদের নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলাম। কিন্তু তামাক কোম্পানির লোভের ফাঁদে পড়ে প্রান্তিক চাষিরা তামাক চাষ বাদ দিতে পারছে না। এটির চাষ সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হলেই কেবল এটির চাষ বন্ধ সম্ভব।”

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেই তামাক চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে তামাক কোম্পানিগুলো। তবে কোম্পানির কোনও বক্তব্য সকাল সন্ধ্যা জানতে পারেনি।

নদীর বুকে ও তীরে তামাক চাষের ফলে পরিবেশের কী ক্ষতি হতে পারে, এ প্রশ্ন রাখা হয় নদী নিয়ে কাজ করা সংগঠন রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকনের কাছে।

তিনি বলেন, “তামাক চাষের ফলে আমাদের পরিবেশগত ক্ষতি হবে বেশি। এটি চাষের মাত্রা ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের উৎপাদনমুখী কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া তামাকের ক্ষেতে ভয়াবহ কীটনাশক ব্যবহারের কারণে নদীর পানি ও মাছের স্থায়ী ক্ষতি হবে, যা অপূরণীয়।”

তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরেন কৃষি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উবিনীগ কক্সবাজারের আঞ্চলিক সমন্বয়ক মো. জয়নাল আবেদীন খান।

তিনি বলেন, “তামাক চাষের কারণে যেমন জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে, তেমনি চাষি ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ আশপাশের বহু মানুষ প্রতি বছর নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া তামাক শোধন করতে গিয়ে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার কাঠ পোড়ানো হচ্ছে।”

সংশ্লিষ্টদের তথ্যে জানা যায়, ৪০ শতক জমির তামাক শোধনের জন্য ৫০ মণ কাঠ পোড়ানোর প্রয়োজন পড়ে।

সে হিসেবে এ বছর ৭৯০ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত তামাক পোড়াতে প্রায় ১০ হাজার টনের বেশি কাঠের প্রয়োজন হবে।

এসব কাঠের বেশির ভাগই আসে টেকনাফ, ফাঁসিয়াখালী ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির গহিন বন থেকে।

কক্সবাজারে নদীতীরে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর তামাকের চাষ করা হলেও এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি স্থানীয় প্রশাসনকে।

আদৌ পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না- এ প্রশ্নে চকরিয়া উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাহাত উজ–জামান খাস জমিতে তামাক চাষ প্রতিরোধের কথাই বলেন শুধু।

“নদীতে জেগে ওঠা চর ও নদী তীরবর্তী খাস জমিতে তামাকের আবাদ করা হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। খাস জমিতে কোনও অবস্থাতেই তামাক চাষ করতে দেওয়া হবে না।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত