সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও স্বাধীনতার এতো বছরেও হয়নি উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত আইন। স্বাধীনতার ৫১ বছর পর ২০২২ সালে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কমিশনার নিয়োগে আইন প্রণয়ন সম্পন্ন হলেও আলোর মুখে দেখেনি এ আইন।
বর্তমান সরকার ২০১২ সালে আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। তারপর কেটে গেছে এক যুগ। এ সময়ে আইনটির খসড়া হলেও তা চূড়ান্ত হয়নি। এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
আইনজীবীরা বলছেন, নির্দলীয়, দক্ষ বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে শক্তিশালী বিচার বিভাগ গড়ে তুলতে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য আইন প্রণয়ন না করে বিচারক নিয়োগের ফলে স্বচ্ছতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে প্রশ্ন উঠছে, তা থেকেই যাবে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিচারক নিয়োগ আইনটি সাধারণ আইনজীবীদের দাবি। এটি কিন্তু আওয়ামী লীগের ওয়াদাও। বর্তমান আইনমন্ত্রীরও ওয়াদা ছিল, যে শিগগিরই আইনটি করা হবে। আইন ও নীতিমালা ছাড়া যদি বিচারক নিয়োগ করা হয়, তাহলে আমি মনে করি এটা সংবিধানের পরিপন্থী হবে।”
তিনি মনে করেন, আগামীতে উচ্চ আদালতে কোনও বিচারক নিয়োগ দেওয়ার আগেই আইনটি করা উচিত। এর ফলে বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা আসবে।
স্বাধীনতার ৫১ বছর পর নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে যে আইনটি করা হয়েছে তা ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে এ আইনজীবী নেতা বলেন, “এ রকম ত্রুটিপূর্ণ আইন আমরা চাই না। বিচার বিভাগের জন্য স্বচ্ছ আইন চাই। যে আইনের মাধ্যমে দক্ষ, যোগ্য বিচারক নিয়োগ পাবেন। এর ফলে বিচার বিভাগ শক্তিশালী হবে।”
গণফোরাম নেতা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিচারক নিয়োগের আইন করার বিষয়ে আমাদের সংবিধানে বলা আছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও সরকার আইনটি করে নাই। বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী করছি, করব, করতেছি বলে আসছেন।
“দেশের সর্বোচ্চ আদালতও রায়ের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত আইন করার কথা বলেছেন। সেখানে কিন্তু বিচারক নিয়োগ নিয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে। সরকার আইন প্রণয়ন তো দূরের কথা, সেই নির্দেশনাও মানছে না। বর্তমানে বিচারক নিয়োগে এক ধরনের হ-য-ব-র-ল অবস্থা। স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য এটা আমাদের কাম্য নয়।”
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনও।
২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিদায়বেলায় তিনি বলেছিলেন, সংবিধানের আলোকে বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা বাস্তবতার নিরীখে অপরিহার্য। এতে বিচারপতি নিয়োগের কাজটি আরও স্বচ্ছ ও দ্রুততর হবে এবং জনগণের মধ্যে বিচারপতি নিয়োগের স্বচ্ছতা সম্পর্কে ভিত্তিহীন ধারণা দূরীভূত হবে।
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ আইন প্রণয়নের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। আইনটি নিয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করছি, চলতি বছরের মধ্যেই আইনটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করতে পারব।”
সংবিধানে যা আছে
সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে বিচারক নিয়োগ বিষয়ে বলা আছে।
৯৫(১) এ বলা হয়েছে, “প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারপতিকে নিয়োগদান করবেন।’
৯৫(২) এ বলা হয়েছে, “কোনও ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে এবং (ক) সুপ্রিম কোর্টে অন্যূন ১০ বছর অ্যাডভোকেট না হয়ে থাকলে, বা (খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন ১০ বছর কোনও বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করে থাকলে, অথবা (গ) সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকলে, তিনি বিচারপতি পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।”
বিচারক নিয়োগ নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা
২০০৯ সালের ২ মার্চ দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ এক রায় দেয়। সেই রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে বাদপড়া ১০ বিচারপতিকে স্থায়ী নিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই নির্দেশনায় বিচারক নিয়োগের আইন বা নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়।
এছাড়া ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগ উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে সাত দফা নির্দেশনা দেয়।
তৎকালীন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের (অবসর) হাইকোর্ট বেঞ্চ পর্যবেক্ষণও দেয়।
সেই পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রধান বিচারপতিকেই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। তাকে প্রয়োজনে বিচারক নিয়োগের জন্য আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের দুজন করে জ্যেষ্ঠ বিচারকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতি যে মতামত দেবেন, তা অগ্রাহ্য করা যাবে না, যদি না সুপারিশকৃত ব্যক্তি রাষ্ট্রবিরোধী কোনও কাজে সম্পৃক্ত থাকেন।
ভারতের আইন কমিশনের ৮০তম প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী একজন বিচারকের পরিপক্বতা পেশাগত অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে একটি বয়সসীমা ধরা হয়েছে। সেই হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক মনোনয়নের ক্ষেত্রে বয়স সর্বনিম্ন ৪৫ বছর হওয়া উচিত বলেও পর্যবেক্ষণ দেয় হাইকোর্ট বিভাগ।
অবসরজনিত কারণে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বর্তমানে বিচারক সংকট রয়েছে। সম্প্রতি তিনজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার পরও আপিল বিভাগে এখন বিচারকের সংখ্যা ৮ জন। এর মধ্যে একজন বিচারপতি এক মাসের মধ্যেই অবসরে যাবেন। থাকবেন বাকি সাত বিচারপতি।
হাইকোর্ট বিভাগে ৮৪ জন বিচারপতির মধ্যে ৮১ জন বিচারিক কাজে যুক্ত রয়েছেন, যা মামলার তুলনায় অপ্রতুল।
বিচারক সংকটের বিষয়টি প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যেও ফুটে উঠেছে।
তিনি বলেছেন, “দেশের মাত্র ২ হাজার বিচারক ৪০ লক্ষেরও অধিক মামলা নিষ্পতির কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। তবুও মামলাজট হতে আমরা পরিত্রাণ পাচ্ছি না। অনেক ক্ষেত্রেই একটি মামলা চূড়ান্তভাবে পারি না। অনেক ক্ষেত্রেই একটি মামলা নিষ্পত্তি হতে ১০-১২ বছর লেগে যায়।”
বিশাল এই মামলার জট কমাতে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের কথা উঠছে। আর বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি আসলেই বিচারক নিয়োগের আইন প্রণয়নের দাবিও জোরালো হয়।