Beta
শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫

ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি চক্রে পুরনোরাই ঘুরে ফিরে

কোরবানির ঈদের আগে শুক্রবার কমলাপুর রেল স্টেশনে ছিল এমন ভিড়। ঈদের সময় চাহিদা বাড়ে বলে ট্রেনের টিকেট কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্যও বাড়ে। ছবি : হারুন-অর-রশীদ রুবেল
কোরবানির ঈদের আগে শুক্রবার কমলাপুর রেল স্টেশনে ছিল এমন ভিড়। ঈদের সময় চাহিদা বাড়ে বলে ট্রেনের টিকেট কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্যও বাড়ে। ছবি : হারুন-অর-রশীদ রুবেল
[publishpress_authors_box]

মিজান ঢালী ২০০৩ সালে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে পিয়ন পদে যোগ দেন। তখন ট্রেনের টিকেট কাউন্টার থেকে হাতে হাতেই কিনতে হত। ৫০ শতাংশ টিকেট অনলাইনে বিক্রি শুরুর পর যে সিএনএস বিডি (CNS.bd) এই দায়িত্বে এসেছিল, তখন সেখানে তার চাকরি হয়। ২০২০ সাল থেকে অনলাইনে টিকেট বিক্রি হচ্ছে সহজ ডটকমের ব্যবস্থাপনায়, সেখানেও তার চাকরি বহাল থাকে।

৪৮ বছর বয়সী এই মিজান ঢালীকে রোজার ঈদের আগে টিকেট কালোবাজারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তার সঙ্গে গ্রেপ্তার হন নিউটন বিশ্বাস (৪০) নামে আরেকজন, তিনিও ২০১২ সাল থেকে রেলওয়ের কমলাপুর স্টেশন সাপোর্ট কর্মী হিসাবে নিয়োগ পেয়ে সিএনএস বিডি হয়ে সহজ ডটকমে কাজ করছিলেন সার্ভার অপারেটর হয়ে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ট্রেনের টিকেট কালোবাজারিতে ঘুরে ফিরে পুরনো চক্রই কাজ করে চলেছে। তবে এক সময় কাউন্টার থেকে সরানো টিকেট চলে আসত তাদের কাছে। এখন পরিকল্পিতভাবে অনলাইনে টিকেট কেটে রেখে বিক্রি করছে তারা।

কোরবানির ঈদের আগে র‌্যাব আবারও ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ট্রেনের টিকেট কালোবাজারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে। তাদের মধ্যে রয়েছেন আরিফুল ইসলাম নামে কমলাপুর রেল স্টেশনের এক বুকিং সহকারী। র‌্যাব কর্মকর্তাদের দাবি, এই আরিফুলও দীর্ঘদিন ধরে টিকেট কালোবাজারির এক চক্রের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।

কালোবাজারি চক্রের বিভিন্ন সদস্যকে নানা সময়ে গ্রেপ্তারের পর তাদের মদদদাতা হিসাবে রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বরাবর বলা হলেও তাদের নাম তেমন সামনে আসে না।

অনলাইনে ‘টিকেট যার, ভ্রমণ তার’ এই প্রক্রিয়ায় কালোবাজারে টিকেট কেউ কিনলেও রেলকর্মীদের সায় ছাড়া তার ভ্রমণ করা সম্ভবপর হয় না বলে এখনও রেল বিভাগের দিকেই যাচ্ছে অভিযোগের তীর।

গত জানুয়ারি মাসে সকাল সন্ধ্যার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ঢাকার বিমানবন্দর রেল স্টেশনে টিকেট কালোবাজারি চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উত্তম চন্দ্র দাশ (৩০) নামে এক ব্যক্তি।

এই উত্তম বলেছিলেন, স্টেশনের কাউন্টারে বসা প্রায় সবাই কালোবাজারিতে জড়িত। টিকেট কাটতে আসা বিভিন্নজনের জাতীয় পরিচয়পত্র রেখে দেয় কাউন্টারে বসা কর্মচারীরা। পরে সেই এনআইডি নম্বর দিয়ে টিকেট কাটা হয়। পরে তা বিক্রি করা হয়। অর্থাৎ একজনের এনআইডি নম্বরে কাটা টিকেটে ভ্রমণ করে আরেকজন।

র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে উত্তম সকাল সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, “স্যার আমি প্রতিবন্ধী মানুষ। কয়েকটা টিকেট বিক্রি করে চলি। আমার পেটে লাথি দিবেন না। আরও বড় বড়রা জড়িত আছে, তাদের ধরেন স্যার।”

উত্তম ‘লাখপতি’ নামে পরিচিত এক রেলকর্মীর কথা সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছিলেন। সেই ‘লাখপতি’ এখনও অধরা।

ট্রেনের টিকেট কালোবাজারিতে জড়িত অভিযোগে ১৪ জনকে গত জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

গত জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে উত্তমের পাশাপাশি কমলাপুর রেল স্টেশনে কালোবাজারির হোতা হিসাবে মো. সেলিমকেও গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

তখন র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছিলেন, কাউন্টারে থাকা কিছু অসাধু টিকেট বুকিং কর্মচারীদের দিয়ে বিভিন্ন সাধারণ যাত্রীর টিকেট কাটার সময় এনআইডি নম্বর সংগ্রহ করত তারা। পরে সেগুলো ব্যবহার করে প্রতিটি এনআইডির বিপরীতে চারটি করে টিকেট নিয়ে দিনে ৫ শতাধিক টিকেট দ্বিগুণ দামে বিক্রি করা হচ্ছিল।

তার প্রায় দুই মাস পর গত ২১ মার্চ সহজের কর্মী মিজান ঢালীসহ নয়জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় র‌্যাব।

র‌্যাবের বক্তব্য অনুযায়ী, গ্রেপ্তার সেলিম ৩৫ বছর ধরে টিকেট কালোবাজারিতে জড়িত। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় টিকেট কালোবাজারির অভিযোগে সাতটি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার হলেও জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার একই কাজে জড়িত হন তিনি।

গ্রেপ্তার উত্তমও প্রায় ১৫ বছর ধরে ট্রেনের টিকেট কালোবাজারিতে জড়িত বলে র‌্যাবের দাবি। উত্তমের সঙ্গে তার সহযোগী আলী ও ফারুকও গ্রেপ্তার হন।

সে সময় গ্রেপ্তার আরেকজন আনোয়ার হোসেন কাশেম প্রায় ১৫ বছর ধরে টিকেট কালোবাজারিতে জড়িত বলে র‌্যাবের ভাষ্য। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, সেলিমের অন্যতম প্রধান সহযোগী কাশেমের দায়িত্ব ছিল কাউন্টার থেকে ট্রেনের টিকেট সংগ্রহ করা।

শুক্রবার ১০ জনকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. ফিরোজ কবীর বলেন, “এই চক্রটি সংঘবদ্ধভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় সকল ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি করে আসছিল। প্রতিবছর ঈদ মৌসুমে দেশব্যাপী বিভিন্ন স্টেশনের অসাধু কর্মচারী ও টিকেট কাউন্টারম্যানদের মাধ্যমে আনুমানিক প্রায় ২-৩ হাজার রেলওয়ের টিকেট কালোবাজারির মাধ্যমে বিক্রি করত।”

অনলাইনের টিকেট যেভাবে যায় কালোবাজারে

গত ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামে মো. আরিয়ান হোসাইন নামে এক টিকেট কালোবাজারিকে গ্রেপ্তারের পর তার কাছে পাওয়া টিকেটের সূত্র ধরে আসে আব্দুল আজিজ নামে এক ব্যক্তির নাম।

চট্টগ্রাম নগরীর বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী আজিজ জানিয়েছেন, ট্রেনে চড়ে কখনও শহরের বাইরেই যাননি তিনি। অথচ চট্টগ্রাম রেলপুলিশ দেখছে, গত এক বছরে আজিজের মোবাইল নম্বরের বিপরীতে ট্রেনের টিকেট কাটা হয়েছে ১৮৪ বার। রেল টিকেট কাটার অ্যাপে তার নাম নিবন্ধন করা আছে ইসরাব উদ্দিন জোবাঈর নামে।

আজিজের ডাক পড়ে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানায়। জেরা-জিজ্ঞাসাবাদের পর আজিজ পুলিশকে বোঝাতে সক্ষম হন, ইসবার উদ্দিন জোবাঈর নামে কাউকে চেনেন না তিনি।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশের দীর্ঘ তদন্তে আজিজের মতো প্রায় ৫০ জনের এনআইডি নম্বরের তথ্য মেলে, যারা জানেনই না তাদের নামে কাটা হচ্ছে টিকেট।

কীভাবে কালোবাজারে এই টিকেট বিক্রি চলে, উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বগুড়ার সান্তাহার জংশন স্টেশন অনুসন্ধান চালায় সকাল সন্ধ্যা। এই স্টেশনে থামে উত্তরাঞ্চলের সব ট্রেন। প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রীর চলাচল এখানে।

সান্তাহারে হোয়াটসস্যাপ-মেসেঞ্জারেও পাওয়া যায় আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট। এজন্য ৩৬০ টাকা মূল্যের টিকেট পেতে গুনতে হয় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা।

নাঈম ইসলাম নামে একজন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার চাচাত ভাই ঢাকা থেকে সান্তাহারে আসবে। অনলাইন টিকেট না পেয়ে আমাকে জানায়। পরে আমি স্টেশনের কাছের একটি মোবাইল সার্ভিসিং দোকান থেকে টিকেট নিই। ৩৬০ টাকার টিকেটের জন্য আমাকে দিতে হয় ১ হাজার ৩০০ টাকা।”

ইমন নামে এক শিক্ষার্থী তখন বলেছিলেন, “আমি ঈদের পর ঢাকা যাব। ঈদে বাড়ি আসার জন্য কালোবাজারির কাছ থেকে স্নিগ্ধা কোচের দুটি টিকেট নিই ঢাকা থেকে সান্তাহার পর্যন্ত। এতে আমার খরচ পড়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা। আবার ঈদ শেষে আমি ঢাকায় ফেরার জন্য কালোবাজারির কাছেই অগ্রিম দুটি টিকেট অর্ডার দিই।”

সান্তাহার রেল স্টেশনের টিকেট কাউন্টারের আশপাশের কম্পিউটারের দোকান, ফটোকপির দোকান এমনকি পানের দোকানেও মেলে টিকেট।

গত গত ৩০ মার্চ এই স্টেশনের কাউন্টারের বাইরে মাদুরের উপর শুয়ে থাকা এক দিনমজুর জানান, তার কয়েকদিন আগে একজন তার কাছে এসে তার মোবাইল নম্বর ও এনআইডির ছবি মোবাইলে তুলে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় ৫০ টাকা দিয়ে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায়, তার মোবাইল নম্বরটি আবার প্রয়োজন হবে। তখন আরও ৫০ টাকা দেওয়া হবে।

সেই দিনমজুরের মোবাইলের মেসেজ বক্সে দেখা যায়, ২৭ মার্চ রেলওয়ের টিকেট কাটার জন্য তার মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে নিবন্ধন করা হয়েছে।

মোবাইল দিয়ে কীভাবে টিকেট কাটতে হয়, তার কিছুই জানেন না ওই দিনমজুর। অথচ তার নামে টিকেট কাটা হচ্ছে।

স্টেশনের পাশে থাকা এক দোকানের কর্মী বলেন, তারা অনলাইন থেকে যে কোনও পরিচয়পত্র দিয়ে টিকেট সংগ্রহ করেন। পরে সেই টিকেট বিক্রি করেন।

শুক্রবার ১০ জনকে গ্রেপ্তারের পর র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. ফিরোজ কবীর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এখানে দুই ধরনের চক্র কাজ করে। এক ধরনের চক্র অনলাইনে টিকেট বিক্রি শুরু হলে তা ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর দিয়ে কেটে রাখত। পরে ফেইসবুক পেজে বিজ্ঞাপন দিয়ে চড়া দামে বিক্রি করে। সফট কপি পাঠিয়ে বিকাশ বা নগদে টাকা বুঝে নেয়।”

টিকেট কালোবাজারিতে জড়িত ১০ জনকে গ্রেপ্তারের পর শুক্রবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. ফিরোজ কবীর।

কমলাপুর রেল স্টেশনের বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ট্রেনের বুকিং সহকারী আরিফুল (৩৮) এই কালোবাজারি চক্রের নেতৃত্বে ছিলেন জানিয়ে র‌্যাব বলছে, তার কাছে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ট্রেনের টিকেটও পাওয়া গেছে। তিনি অনেকদিন ধরেই একাজ করে আসছিলেন।

আরিফুলের সঙ্গে যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তারা হলেন- সোহেল রানা (২৭), মাহবুবুর রহমান (২৮), বকুল হোসেন (২৫), শিপন আহমেদ (২৯), আরিফুল ইসলাম (৩৮), শাহাদাত হোসেন রায়হান (৩৫), মো. মনির (২৫), শিপন চন্দ্র দাস (৩৫), মনির আহমেদ মানিক (৩০) ও রাজা মোল্লা (২৬)।

গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তা ফিরোজ কবীর বলেন, আরিফুলের নেতৃত্বে এই চক্রের খোঁজে নেমে ঢাকার মৌচাক থেকে মানিক ও বকুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে সোহেল এবং ঠাকুরগাঁওয়ে থাকা রায়হান ও আনিনের নাম পাওয়া যায়। তাদের কাছে আগামী ১০ দিনের টিকেট পাওয়া গিয়েছিল। এর মধ্যে পঞ্চগড়গামী একতা এক্সপ্রেসের টিকেট তারা ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করছিলেন।

রায়হান একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজ করেন। সেখানে বসে তিনি অন্যের মোবাইল নম্বর ও এনআইডি ব্যবহার করে অনেকগুলো টিকেট একসঙ্গে কাটার কাজটি করতেন বলে র‌্যাব জানায়।

“রায়হান ও আনিস টিকেট পাঠাত সোহেল ও মানিকের কাছে। আর মানিক ও বকুল ফেইসবুক পেজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করত,” বলেন র‌্যাব কর্মকর্তা ফিরোজ।

তিনি বলেন, “টিকেট বিক্রির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে সিন্ডিকেটের মূল হোতাসহ বাকি বিক্রয়কারী সহযোগীদের মাঝে ভাগাভাগি হতো। সিন্ডিকেটের প্রত্যেক সদস্য অবৈধভাবে ট্রেনের টিকেট বিক্রি করে প্রতি মাসে ২০/২৫ হাজার টাকা উপার্জন করত।”

ট্রেনের টিকেট কালোবাজারিতে জড়িত অভিযোগে শুক্রবার এই ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

কালোবাজারের টিকেট ধরা হয় না কেন

ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি ঠেকাতে গত বছর ১ মার্চ থেকে ‘টিকেট যার, ভ্রমণ তার’ স্লোগানে অনলাইন ও অফলাইনে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট কাটার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে রেলওয়ে।

পাশাপাশি রোজার ঈদের সময় মোবাইলে ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) সিস্টেম চালু করা হয়। এ পদ্ধতি টিকেট নিয়ে কারসাজি রোধ করতে পারবে বলে আশা দেখিয়েছিলেন রেল কর্মকর্তারা। কিন্তু সেই তাতেও থামানো যায়নি কালোবাজারিদের।

রেলওয়ের নিয়ম অনুযায়ী, এনআইডি নম্বর ব্যবহার করে টিকেট কিনতে হয়। আর সেই টিকেট যেন কাউকে হস্তান্তর করা না যায়, সেজন্য ট্রেনে তা পরীক্ষা করা হবে।

ফলে কেউ যদি কালোবাজারে টিকেট কেনেনও, তা ভ্রমণের সময় পরীক্ষার সময় ধরা পড়ে যাবে। তখন জরিমানা দিতে হবে। এখানে কালোবাজারি ঠেকাতে মূল দায়িত্ব রেল কর্তৃপক্ষেরই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

ট্রেনে এনআইডি কার্ড দেখা হয় কি না- জানতে চাইলে মো. রাকিব নামে এক নিয়মিত ট্রেনযাত্রী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রথম দিকে একবার দেখেছি এনআইডি দেখে টিকেট চেক করতে। এখন এনআইডি চেক করা তো দূরের কথা, টিকেটই চেক করে না ঠিকমতো।”

যুথি আক্তার নামের এক ট্রেনযাত্রী বলেন, “এনআইডি ছাড়া ট্রেনে ভ্রমণ করা যাবে না শুনে নিজের এনআইডি দিয়ে অনলাইন নিবন্ধন করে নিই। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনওদিন কেউ চেক করেনি এনআইডি।”

যাতায়াতের নিরাপদ মাধ্যম হিসাবে ট্রেন জনপ্রিয়, সেই সুযোগ নেয় টিকেট কালোবাজারিরা।

সিএনএস বিডি থেকে সহজ

বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকেট বিক্রিতে ২০০৭ সালে থেকে কাজ করছিল কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস বিডি)। তবে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে তাদের যে বাদ দেওয়া হয়েছিল, তা তৎকালীন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের কথায় উঠে আসে।

২০২০ সালে সহজের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “২০০৭ সালে সিএনএসের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল রেলের। তারপর থেকে মেয়াদ বাড়িয়ে মামলা-মোকদ্দমা করে এই পর্যায়ে এসেছে। আমার আমলেও চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়টি আমার কাছেও আসে। আমি সেটাকে সমর্থন না করে নতুন টেন্ডার করতে বলি।

“সিএনএসও আবেদন করেছিল। কিন্তু তারা ১ টাকা ৪০ পয়সা সার্ভিস চার্জ চেয়েছিল। আর সহজ ২৫ পয়সার কথা বলেছিল।”

সিএনএসের সঙ্গে রেলওয়ে চুক্তি বাতিল করে ২০১৯ সালে কাজটি দেয় সহজকে। তখন সিএনএস আদালতে মামলা করে। সেই মামলা নিষ্পত্তির পর ২০২০ সালে সহজের সঙ্গে ৫ বছরের চুক্তি করে রেলওয়ে। চুক্তি অনুযায়ী, টিকেট প্রতি ২৫ পয়সা সার্ভিস চার্জ নিচ্ছে সহজ; যেখানে সিএনএসকে দিতে হতো প্রায় তিন টাকা।

নূরুল ইসলাম সুজন বলেছিলেন, “সিএনএস নিয়ে রেলের সাথে বেশ ঝামেলাও ছিল। আমাদের বাজে অভিজ্ঞতাও হয়েছে। টিকেট বিক্রয়ে আমরা সবচেয়ে বড় প্রশ্নের সম্মুখীন হই এবং রেলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছিল টিকেটিং ব্যবস্থা নিয়ে।”

অনলাইনে বাস টিকেট বিক্রির সফল অভিজ্ঞতা নিয়ে সহজ আসে ট্রেনের টিকেট বিক্রিতে। তবে তাদের কর্মীও কালোবাজারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়।

যা বলছে সহজ

রোজার ঈদের আগে টিকেট কালোবাজারিতে সহজের কর্মী গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সকাল সন্ধ্যার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তারা একটি ই-মেইলে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরে।

সেখানে বলা হয়, রেলওয়ের টিকেট বুকিং সহকারীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া সহজের কোনও কর্মী কিংবা কারও পক্ষে জালিয়াতি করা সম্ভবপর নয়।

কাজ পাওয়ার শর্ত হিসাবেই আগের কর্মীদের কাজে নিতে হয়েছিল বলে জানান সহজের এক কর্মকর্তা।

সহজের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ট্রেনের টিকেট ব্যবস্থাপনায় এখন দুটি পক্ষ কাজ করছে- বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং সহজ ডটকম। সহজ ট্রেনের টিকেট ব্যবস্থাপনায় রেলওয়েকে যাবতীয় কারিগরি (হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার) সহযোগিতা করছে।

টিকেট কাউন্টারে ব্যবহৃত কম্পিউটারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম সহজ সরবরাহ করলেও এসব ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণ রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার ও টিকেট বুকিং সহকারীর হাতে থাকে।

কাজেই সহজের কর্মীর পক্ষে সিস্টেমে ঢুকে টিকেট জালিয়াতির কোনও সুযোগ নেই, দাবি প্রতিষ্ঠানটির।

অনলাইন প্রক্রিয়ায় কীভাবে পুরনো কালোবাজারি চক্র ঢুকে পড়েছে, তার সূত্র দেখিয়ে সহজের পক্ষ েথকে বলা হয়, টিকেট কালোবাজারি দুভাবে হয়ে থাকে। প্রথমত রেলওয়ের বুকিং এজেন্টদের মাধ্যমে, যারা যাত্রীদের এনআইডি অবৈধভাবে ব্যবহার করে সিস্টেম থেকে টিকেট কিনে থাকে। দ্বিতীয়টি হয় বাইরের কেউ টিকেট বৈধভাবে কিনে তা বিক্রি করার মাধ্যমে।

এটা ভ্রমণকালীন টিকেট পরীক্ষা করলে সহজেই ধরে ফেলা যায়। আর এই কাজটিতে গাফিলতি হচ্ছে বলে কালোবাজারিরা সুযোগ পাচ্ছে বলে সহজের দাবি।

“রেলওয়ের টিকেট বিক্রির সুযোগ কেবল থাকে স্টেশনের বুকিং সহকারীর। টিকেট কাটতে প্রয়োজন হয় এনআইডি কিংবা জন্ম নিবন্ধন সনদ। একটা এনআইডি/জন্ম নিবন্ধন থেকে সর্বোচ্চ চারটি টিকেট কাটা যায়। প্রত্যেকটা টিকেট কোন কাউন্টার থেকে কাটা হয়েছে এবং রেলওয়ের কোন বুকিং সহকারী বুকিং নিয়েছে, এসব তথ্য টিকেটের গায়ে প্রিন্ট করা থাকছে। টিকেট দেখেই ধারণা পাওয়া সম্ভব, কোনও বুকিং সহকারী কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত কি না?”

তাই কালোবাজারি ঠেকাতে ভ্রমণকালীন টিকেট পরীক্ষার কাজটি ঠিকভাবে করার ওপর জোর দিয়ে সহজ বলছে, এক্ষেত্রে প্রয়োজনে রেলের জনবল বাড়াতে হবে।

“সর্ষের মধ্যের ভূত যদি না তাড়ানো হয়, তাহলে ট্রেনের যেমন কালোবাজারির দৌরাত্ম্য কমানো যাবে না, তেমনি জনপ্রিয় সেবাটিকে লাভজনকও করাও কঠিন হবে,” বলছে সহজ।

যা বললেন রেলের ডিজি

অনলাইনে যাওয়ার পরও টিকেট কালোবাজারি বন্ধ না হওয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) সরদার সাহাদাত আলী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “টিকেট কালোবাজারির বিষয়টি রেগুলার নজরদারিতে রাখব।”

রেলের কর্মীদের যোগসাজশের যে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তেও ধরা পড়ছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “যারা অপরাধী তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

“টিকেট কালোবাজারির অভিযোগে এরই মধ্যে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে র‍্যাব ও আমাদের রেলওয়ে পুলিশের অভিযানে। তাদের জন্য কোনও সুপারিশ করা হয়নি। আর ভবিষ্যতেও হবে না।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত