Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪

ট্রান্সজেন্ডার কণ্ঠশিল্পী রামিসার ভরসা ‘নিজের শক্তিতেই’ 

রামিসা
রামিসা চৌধুরী
[publishpress_authors_box]

রামিসা চৌধুরী একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী। সংগীতের প্রতি আশৈশব ভালোবাসা নিয়ে গড়ে তুলছেন নিজেকে। কর্মরত আছেন সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘সুরের ধারা’র সঙ্গে। সহকারী শিক্ষক হিসেবে গানের তালিম দিচ্ছেন ছোট ছোট শিশুদের। 

রামিসার গল্পটা শুরু হয় ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ থেকে। খুব ছোটবেলায় ভর্তি হয়েছিলেন সংস্থাটির শিক্ষা কার্যক্রমে। আর সেখানেই গড়ে ওঠে গানের সাথে তার সখ্য। স্কুলের নানান অনুষ্ঠানে তো গান গাইতেনই, এমনকি আপন মনেই গাইতেন বাংলা আধুনিক এবং চলচ্চিত্রের গান। সেসব শুনে স্কুলের এক শিক্ষিকা, রামিসার প্রিয় জেসমিন ম্যাডাম একবার তাকে বলেছিলেন, ওয়ার্ল্ড ভিশনেই আছে তার গান শেখার সুযোগ। রামিসা চাইলে সেখানে ভর্তি হতে পারে। 

দেরি না করে রামিসা তাই ভর্তি হয়ে যান গানের ক্লাসে। 

একদিন জেসমিন ম্যাডামের কাছেই জানতে পারেন, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সংগীতের তালিম দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে সংগীত সংগঠন ‘সুরের ধারা’। এ সংগঠনের কর্ণধার বাংলাদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। গরীব শিশুদের গান শেখার সুযোগ করে দিতেই ‘মিউজিক ফর ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পের অধীনে এই উদ্যোগ। 

কিন্তু কী করে ভর্তি হওয়া যায় ওই স্কুলে?

গান শেখার অদম্য বাসনা নিয়েই চলছিল রামিসার পড়াশোনা। একসময় তাকে ভর্তি করানো হলো ইউসেপ বাংলাদেশের শিক্ষা কার্যক্রমে। সেখানে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে গান দিয়েই সকলের মন জয় করে নিলেন। এ স্কুলের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই তার দেখা হয়ে গেল রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সঙ্গে। রামিসার সুরেলা গলা তার খুব মনে ধরে গেল। আর এরপরই আস্তে আস্তে পালটে যেতে থাকলো রামিসার জীবন।   

সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রামিসা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “উনার প্রজেক্টের কর্মীদের উনি জানিয়ে দেন আমাকে ভর্তি  করানোর যেন ব্যবস্থা করা হয়। ২০১৩ সালে আমি সুরের ধারায় অডিশন দিই এবং টিকে যাই। উনারা আমাকে প্রজেক্টের শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি করান। এখানে আমার সংগীত জীবন শুরু হয়। এখানে বন্যা দি’র কাছে গান শেখার সুযোগ পেয়েছি।  পাশাপাশি বেশকিছু বড় বড় শিল্পীদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ আমার হয়েছে।”

শৈশবে ‘সুরের ধারা’ স্কুলের ভ্যান রামিসার বাসার সামনে দিয়েই যেত। তখন রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি। যদি তাকে ভ্যান নিয়ে যায় গানের স্কুলে! 

সেই তিনি নিজেও কি জানতেন একদিন এই স্কুলেরই সহকারি শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করবেন? গান শেখাবেন দরিদ্র শিশুদের? 

দারিদ্রের সঙ্গে নিজের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে রামিসা বলেন, “ছোটবেলা থেকেই আমার গানের প্রতি ভালোবাসা ছিল। কিন্তু একজন দরিদ্র শিশুর পক্ষে তো টাকা দিয়ে গান শেখা সম্ভব না। আমার মা অন্যের বাসায় কাজ করে আমার পড়াশোনা চালাতো। বাবাও একসময় আমাদের ছেড়ে চলে গেল। তিনি আরেকটি বিয়ে করলেন”।

আর দশজন স্বচ্ছল পরিবারের শিশুর মতো ছিল না রামিসার বেড়ে ওঠা। দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ তো ছিলই, পাশাপাশি আরও একটি যুদ্ধ রামিসাকে করতে হয় প্রতিদিন। আর এই যুদ্ধ হলো নিজের লিঙ্গ পরিচয় প্রতিষ্ঠা করার। 

আমরা সেই গল্প শুনতেই খুব অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম।

রামিসা বলেন, “আমি ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের জামাকাপড় পড়তে পছন্দ করতাম। খেলতামও মেয়েদের সাথে। স্কুলের ছেলে বন্ধুরা এসব নিয়ে হাসাহাসি করতো। এলাকার লোকজন আমার বাবাকে বলতো আপনার ছেলে সারাদিন মেয়েদের সাথে খেলে কেন? এটাতো ঠিক না। ওতো একজন ছেলে মানুষ। ওকে গাইড করেন ভাই, নাইলে ছেলেটা নষ্ট হয়ে যাবে। বাবা বলতো- তুমি কি হিজড়া হবা বড় হয়ে!”

সমাজে নারী অথবা পুরুষ বাদেও আরও বেশ কয়েকটি লৈঙ্গিক পরিচয় বিদ্যমান। এদের মধ্যে অনেকেই জন্মগতভাবে পুরুষ অথবা নারী শরীরের অধিকারী হলেও মানসিকভাবে এরা ঠিক উল্টোটি। আর এদের বলা হচ্ছে ‘ট্রান্সজেন্ডার’। 

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা যেখানে প্রান্তিক, সেখানে লিঙ্গ বৈচিত্রের এই মানুষের সামাজিক অবস্থান নারীর চেয়েও করুণ। রামিসার কণ্ঠেও ঝরে পড়েছে সে হতাশা। 

“সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি পরিবার আমাকে নিজের মতো বেড়ে উঠতে দিচ্ছেনা। কিন্তু আমিতো আমার মনের বিরুদ্ধে যেতে পারবোনা। ”

এমনকি তার নিজের যে বিচরণের জায়গা- সংগীত, এখানেও যে পরিস্থিতি তার অনুকূলে থাকে এমন নয়। সে কথা বলতে গিয়ে রামিসা বলেন, “দেখেন সবাই মনে করে যারা গান করে তারা বোধয় চিন্তা ভাবনায় অনেক উন্নত। আসলে ব্যাপারটা সবসময় এরকম না। এখানেও এমন অনেক মানুষ আছেন যারা আমাকে সহজভাবে নিতে পারেন না। এখানেও বহু মানুষ আছেন যারা আমাকে গ্রহণ করতে পারেন না।”

অর্থাৎ রামিসার নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার এই যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে হচ্ছে সর্বত্র। 

আত্মপরিচয় নির্মাণের সংগ্রামটা শুরু হয় তার এসএসসি পরীক্ষার পর পর- 

“একসময় আমি বুঝলাম আমার যে সত্ত্বা তার সঙ্গে আমি বেড়ে উঠছিনা। আসলে আমিতো ছেলেদের মতো না। আমার চাওয়া পাওয়া ভিন্ন। ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর আমি বুঝতে পারি আমি আসলে পুরুষের মতো নই।”

আর তাই সমাজের চোখে নারী-পুরুষের যে প্রচলিত নির্মাণ, তার সাথে আপস করে চলতে একেবারেই রাজি নয় রূপান্তরকামী নারী রামিসা ওরফে রামিসা চৌধুরী।

যদিও লৈঙ্গিক পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হবার যুদ্ধে অনেকটাই এগিয়ে গেছেন রামিসা। এইচএসসি পাশ করেছেন সরকারি সংগীত কলেজ থেকে। ভর্তি হবেন একই কলেজের ডিগ্রি পর্যায়ে। ইতিমধ্যে গান করেছেন বড় বড় মঞ্চে। সে কথা বললেন এভাবে- 

“অনেক বড় বড় মঞ্চে গান করেছি। সুরের ধারার রজত জয়ন্তীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন। ওখানে গান গেয়েছি। সুরের ধারা পহেলা বৈশাখ এবং চৈত্র সংক্রান্তিতে বড় গানের আয়োজন করে। সেখানে আমি প্রতি বছর গান করছি। চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ‘হাজারো কণ্ঠে বর্ষবরণ’ শিরোনামে এক বিরাট আয়োজন হয়। ওখানেও গান করা হয়।” 

এ পর্যন্ত আসার পেছনে কৃতিত্ব দিতে ভুললেন না নিজের মা-কে। সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত মা-ই যে ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন তাকে।

কথায় কথায় রামিসা স্মরণ করলেন আরও কিছু নাম। বললেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার কথা। 

“সুরের ধারার অধ্যক্ষ ডক্টর রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাদি সবসময় আমাকে ভালোবেসে সাহস জুগিয়েছেন। আমাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। একই কথা বলবো সংগীত সংগঠন জলতরঙ্গের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন তপন দাদার ব্যাপারে। তিনিও আমাকে প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন।”

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রামিসার গান ভাইরাল হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে সংগীত প্রতিষ্ঠান জলতরঙ্গ। এই সংগঠনের ঐকান্তিক চেষ্টায় আজ তাকে অনেকেই চেনে বলে কৃতজ্ঞতা স্বীকারও করলেন রামিসা।

একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী হিসেবে রামিসার লড়াই এখন দুটো। একটি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, আর অন্যটি সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ভেঙ্গে নিজের লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার।

এই লড়াইয়ে একেবারেই দমে যাওয়ার মানুষ নন তিনি। কেনইবা হবেন? আত্মবিশ্বাসের জোগান যে তিনি পেয়েছিলেন এই গান থেকেই। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় রামিসা এক গানের প্রতিযোগিতায় ২০০ শিশুর মধ্যে হয়েছিলেন প্রথম। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আয়োজিত ওই প্রতিযোগিতায় তিনি তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। 

এগিয়ে চলার পথে বাঁধা আসবে- এমনটাই মনে করেন রামিসা চৌধুরী। নিজের যুদ্ধটাকে তাই বাস্তবতার লেন্সেই দেখার চেষ্টা করেন এই শিল্পী। 

তার মতে, “পৃথিবীতে কিছু মানুষ আমাকে দূরে সরিয়ে দেবে, কিছু কাছে টানবে। কিন্তু নিজের শক্তির ওপর ভরসা রাখতে হবে। আমাকে আমার মতো করে এগিয়ে যেতে হবে।”

এবার চোখ তার আরও সুদূরে। জানালেন নিজের স্বপ্নের কথা। 

বললেন, “আমার খুব ইচ্ছা ভারতের শান্তিনিকেতন থেকে মাস্টার্স করবো। এরপর দেশে ফিরে সংগীত নিয়েই জীবনটা কাটাতে চাই।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত