ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সুইডেনে এলজিবিটিকিউএ’দের (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়্যাল, ট্রান্সজেন্ডার, ইন্টারসেক্সসহ অন্যান্য) স্বীকৃতি রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে একাধিক আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দেশটিকে এই অবস্থায় যেতে হয়েছে। বিশ্বজুড়ে ট্রান্সজেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকারের প্রশ্নে অনেকেই সুইডেন মডেলকে অনুসরণীয় বলে মনে করেন।
বিশ্বের অনেক দেশই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও সেখানে তাদের প্রতি বৈষম্য রয়ে গেছে। পরিবার, সমাজ, অর্থনীতি থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রেই এই বৈষম্য দেখা যায়। কয়েকটি দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অপরাধী হিসেবে দেখা হয়, যেমন আফ্রিকার দেশ সুদান।
তবে সুইডেনের পরিস্থিতি সবচেয়ে ভিন্ন। সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা সম্পত্তির অধিকারও পায়। দেশটির সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইনে লিঙ্গ পরিচয়ের বিষয়টি প্রাধান্য পায় না। অর্থাৎ, দেশটিতে সম্পত্তির ক্ষেত্রে সবার অধিকার সমান।
দেশটিতে স্বামী-স্ত্রী এবং নিবন্ধিত অংশীদাররা তাদের লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে উত্তরাধিকার আইন অনুসারে একে অন্যের সম্পত্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করে। এটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সম্পর্কে থাকা ট্রান্সজেন্ডারদেরও সুরক্ষা দেয়।
সুইডেনে কেউ মারা যাওয়ার আগে উইল করে না গেলে, তার সম্পত্তি আইনগতভাবে নির্ধারিত একটি নির্দিষ্ট ক্রম অনুসারে ভাগাভাগি হয়। এই ক্রমে স্বামী/স্ত্রী বা নিবন্ধিত অংশীদার, সন্তান, দত্তক নেওয়া সন্তান, পিতা-মাতা, ভাইবোন ইত্যাদিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরাও এই ক্রম অনুসারে তাদের আইনগত সম্পর্ক এবং পারিবারিক বন্ধনের ভিত্তিতে উত্তরাধিকারী হতে পারেন। দেশটিতে ট্রান্সজেন্ডাররা তাদের সম্পত্তি বিলিবণ্টনও করতে পারেন ইচ্ছে মতো।
দেশটিতে বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে এলজিবিটি ব্যক্তিদের আনুষ্ঠানিক অধিকার আরও মজবুত করা হয়েছে। এর মধ্যে আইন পরিবর্তন, বৈষম্যহীনতার নীতি প্রবর্তন, পারিবারিক আইনে উন্নত অধিকারের মতো উদ্যোগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এলজিবিটি ব্যক্তিদের সমান অধিকার নিশ্চিত ও শক্তিশালী করতে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সুইডিশ সরকার, তার বছরভিত্তিক ক্রমই বলে দেবে সুইডেনকে কত দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
>> সুইডেনে ১৯৪৪ সালে সমলিঙ্গের প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সম্মতিসূচক যৌন সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যদিও তখনও দেশটিতে সমকামিতাকে অসুস্থতা হিসাবে বিবেচনা করা হতো।
>> ১৯৭২ সালে দেশটিতে ‘লিগ্যাল জেন্ডার রিকগনিশন’ নামে একটি আইন হয়। এর মাধ্যমে সুইডেন বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে আইনি পর্যালোচনার পর নতুন আইনগত লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণে একটি আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি চালু করে। একই আইনের অধীনে সুইডেনে বিনামূল্যে লিঙ্গ পরিবর্তন চিকিৎসাও দেওয়া শুরু হয়।
>> ১৯৭৯ সালে সুইডেনের জাতীয় স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বোর্ড সমকামিতাকে অসুস্থতা হিসেবে বিবেচনা করা বন্ধ করে। এই সিদ্ধান্তটি দেশটিতে সমকামিতা সম্পর্কিত আইনি ও সামাজিক পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
>> ১৯৮৭ সালে সুইডেনের পেনাল কোডে সংশোধনী এনে সমকামিতার ভিত্তিতে বৈষম্যকে অবৈধ করা হয়।
>> দেশটিতে ১৯৮৮ সালে ‘হোমোসেক্সুয়াল কো-হ্যাবিটেস অ্যাক্ট’ কার্যকর হয়। এই আইন সমকামীদের মধ্যে যৌন সম্পর্ককে আইনি স্বীকৃতি দেয়। এর মাধ্যমে সমকামী দম্পতিরা একত্রে বসবাস, সম্পত্তি ভাগাভাগির অধিকার পায়।
>> ১৯৯৫ সালে দেশটিতে ‘রেজিস্টার্ড পার্টনারশিপ অ্যাক্ট’ কার্যকর হয়। এই আইন সমকামী ও উভকামী দম্পতিদের মধ্যে নথিভুক্ত অংশীদারত্বকে আইনি স্বীকৃতি দেয়।
>> ১৯৯৯ সালে ‘গ্রাউন্ডস অন সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন অ্যাক্ট’ কার্যকর হয়। এর মাধ্যমে, কর্মক্ষেত্রে সব ধরনের বৈষম্যকে অবৈধ করা হয়।
>> ২০০২ সালে দেশটিতে ‘ইকুয়াল ট্রিটমেন্ট অব স্টুডেন্টস অ্যাট ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট’ কার্যকর হয়। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সমান অধিকার ও যৌনতাকেন্দ্রিক বৈষম্য দূর করতে আইনটি করা হয়।
>> ২০০৩ সালে সমকামীদের প্রতি কোনও ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানো বা বক্তব্যকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করার বিধান হয়।
>> আগে সুইডেনে শুধু বিবাহিত দম্পতিরা দত্তক নিতে পারতেন। কিন্তু ২০০৩ সালে নতুন ‘কো-হ্যাবিটেস অ্যাক্ট’ কার্যকরের মাধ্যমে নথিভুক্ত অংশীদাররাও দত্তক নিতে পারে। একই বছরে সেখানে ‘প্রোহিবিশন অব ডিসক্রিমিনেশন অ্যাক্ট’ কার্যকর করা হয়। এর ফলে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যকে নিষিদ্ধ করা হয়।
>> ২০০৫ সালে ‘প্রোহিবিশন অব ডিসক্রিমিনেশন অ্যাক্ট’ আরও সম্প্রসারিত করা হয়। এর আওতায় তখন সামাজিক সেবা প্রতিষ্ঠান, বিমা ব্যবস্থা, বেকারত্ব বিমা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়। ওই বছর সুইডেনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। ‘ইনসেমিনেশন অ্যাক্ট’ এবং ‘অ্যাক্ট অন রিপ্রোডাকশন আউটসাইড দ্য বডি’ সংশোধন করে সমকামী দম্পতিদের সন্তান গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হয়। এর ফলে একজন নারী তার রেজিস্টার্ড পার্টনার বা কো-হ্যাবিটির সহায়তায় সন্তান নিতে পারেন।
>> ২০০৯ সালে সুইডেনে বিয়ে সংক্রান্ত আইনকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ করা হয়। এর ফলে আইনে ‘স্ত্রী’ এবং ‘স্বামী’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘বিবাহিত অংশীদার’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এটি সমকামী দম্পতিদের জন্যও প্রযোজ্য হয়।
>> ২০১৩ সালে ‘লিগ্যাল জেন্ডার রিকগনিশন’ আইনে সংশোধন আনা হয়। এতে লিঙ্গ পরিবর্তন করতে চাওয়া ব্যক্তিদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। নতুন নিয়মে লিঙ্গ পরিচয় পরিবর্তন করতে চাইলে তাকে সুইডিশ বা অবিবাহিত হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। তবে সরকারি নিবন্ধন প্রয়োজন হয়।
>> ২০১৮ সালে দেশটিতে লিঙ্গ পরিচয় পরিবর্তনে অস্ত্রোপচারের জন্য অর্থ দাবি করতে পারার অধিকার দেওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে অবশ্যই সুইডিশ হতে হবে। একই বছরে সুইডেনে ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য ফৌজদারি আইনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। এই পরিবর্তন ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়।