সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হকের অনানুষ্ঠানিক বক্তব্যটি ছিল: আই উইল হ্যাঙ্গ দ্যাট বাস্টার্ড। জিয়াউল হক বর্ণিত সেই জারজটি ছিলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রতিষ্ঠাতা প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো। আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ৪ এপ্রিল ১৯৭৯ ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। আইনের প্রয়োগ কতোটা যথার্থ ছিল এই বিতর্ক বরাবরই ছিল।
৬ মার্চ, ২০২৪ পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট মতামত দিয়েছে যে ফাঁসিতে নিহত সে দেশের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ন্যায়বিচারের সুযোগ পাননি। বিচারে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং তা কার্যকরও করা হয়েছে, কিন্তু সেটা কি ন্যায়বিচার ছিল?
প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে মতামত চেয়ে ২০১১ সালে পকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্স পাঠিয়েছিলেন। পিপিপি অনেকদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে আবার কিছুটা ক্ষমতার ভাগ পেয়েছে, ভুট্টোকন্যা বেনজিরের স্বামী আসিফ আলী জারদারি আবার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এবার দুশ্চিন্তাগ্রস্থ সুপ্রিম কোর্ট ক্ষমতাসীনদের সন্তুষ্ট করতে ১২ বছর পর সেই রেফারেন্সের উপর মতামত দিয়েছে। প্রধান বিচারপতি কাজী ফায়েজ ইসা বলেন, ‘‘জুলফিকার আলী ভুট্টো ন্যায়বিচার পাননি। সংবিধান মেনে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাঁর বিচার করা হয়নি।’’ এবার সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন বিচারকের এটাই সর্বসম্মত মতামত।
১৯৭১-এ পাকিস্তানের পূর্বাংশে হত্যাযজ্ঞের প্রধান রাজনৈতিক দায় মূলত জুলফিকার আলী ভুট্টোরই।
তাঁকে ফাঁসিতেই ঝুলতে হবে— জেনারেল জিয়াউল হক সিদ্ধান্তটি নিয়েই রেখেছিলেন। তাঁর সহায়তায় এগিয়ে এল পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত। অভিযোগ: ১৯৭৪-এ একদা ভুট্টোর অনুগত পরে বিদ্রোহী আহমদ রাজা কাসুরিকে হত্যা করার জন্য তাঁকে অ্যামবুশ করা হয়— গুলিটি এই তরুণ রাজনীতিবিদকে বিদ্ধ করতে না পারলেও গাড়িতে থাকা তাঁর বৃদ্ধ পিতা নওয়াব মাহমুদ আহমদ খান কাসুরিকে হত্যা করতে সমর্থ হয়। এই মামলায় হুকুমের আসামি হয়ে যান জুলফিকার আলী ভুট্টো।
জুলফিকার আলী ভুট্টো (৫ জানুয়ারি ১৯২৮-৪ এপ্রিল ১৯৭৯) ১৯৭১-এর ২০ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৩-এর ১০ আগস্ট পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তারপর পাকিস্তান ‘ইসলামিক রিপাবলিক’-এর সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা। চার দিন পর পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে ১৪ আগস্ট তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। প্রেসিডেন্ট হলেন ফজল এলাহি চৌধুরী।
ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয় পাকিস্তান ন্যাশনাল এলায়েন্স। সিন্ধু থেকে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পর্যন্ত ভুট্টো বিরোধী একটি আন্দোলন বেশ দানা বেঁধে ওঠে।
‘ভুট্টো কে আখরি দিন’
লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) রফি উদ দীন-এর ‘ভুট্টো কে আখরি দিন’ থেকে অবশিষ্টাংশ অনুসৃত হলো:
৩ জুলাই ১৯৭৭ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল আরিফ ভুট্টোকে সতর্ক করেন—পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে। ৫ জুলাই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য গ্রেফতার হন। জেনারেল জিয়াউল হক সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভুট্টোপন্থী জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের নামে কার্যত বন্দি করে রাখেন। সামরিক শাসনের শুরুতে যা করা হয়—দ্রুত গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়া, দ্রুত নির্বাচন ইত্যাদি—ভুট্টোকে অন্তরীণ করে জিয়াউল হকও বললেন, ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
২৯ জুলাই ভুট্টো জেল থেকে ছাড়া পেলেন। আবার গ্রেফতার হলেন পাঁচ দিন পর, এবার হত্যার অভিযোগে। জামিনে ছাড়া পেলেন ১৩ সেপ্টেম্বর। আবার গ্রেফতার হলেন তিন দিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর। ফাঁসিতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁকে কারাগারেই থাকতে হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর ভুট্টোকে জামিন মঞ্জুর করায় হাইকোর্টের বিচারপতি কেএমএ সামাদানিকে হাইকোর্ট থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। নিম্ন আদালতকে (জজ কোর্ট) পাশ কাটিয়ে মামলা আনা হয় লাহোর হাইকোর্টে। কট্টর ভুট্টোবিরোধী মৌলবি মুশতাক হোসেনকে চিফ জাস্টিস করে এবং নতুন পাঁচজন বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে সরকার অনুগত বেঞ্চ তৈরি করে বিচার কাজ শুরু করা হয়। ভুট্টো নিজেই তার পক্ষে আইনি বক্তব্য পেশ করেন। ১৮ মার্চ ১৯৭৮ আদালত তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদান করে।
সুপ্রিম কোর্টে আপিলও ৪-৩ মতামতের ভিত্তিতে খারিজ হয়ে যায়। দুজন বিচারক পৃথক রায়ে ভুট্টোকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। সে সময় ভুট্টো ছিলেন রাওয়ালপিন্ডি জেলে। তিনি প্রাণ বাঁচাতে প্রেসিডেন্টের অনুকম্পা প্রার্থনা করেন, তাঁর পরিবারকেও এমনই নির্দেশ দিয়েছেন।
ভুট্টো তাঁর কন্যা বেনজিরকে বলেছেন, আমার পক্ষে যে সাক্ষ্যই দেওয়া হোক না কেন, যে খুন আমি করিনি সে খুনের দায়ে আমাকে খুন করা হবে।
ভুট্টোর ফাঁসির খবর শুনে প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক আনন্দে বলে উঠেছেন: ওই জারজটি এখন মৃত।
স্মরণ রাখা দরকার কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাকে পাশ কাটিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো জিয়াউল হককে সেনাবাহিনীর প্রধান পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। বহু বছর আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তার ডায়েরিতে লিখে গেছেন: ভুট্টো যত দিন বেঁচে থাকবে পাকিস্তানে শান্তি আসবে না।
ভুট্টোর স্ত্রী নুসরাত কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে রাজি নন যে ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়েছে। তিনি মনে করেন তাঁকে আগে হত্যা করে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। এ নিয়ে সাদিক জাফরি একটি বই লিখেছেন: ওয়াজ ভুট্টো কিল্ড বিফোর হ্যাঙ্গিং। অথচ পবিত্র নগরী মক্কায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক ভুট্টোর নিকটজনদের কাছে কসম কেটে বলেছিলেন, তাঁর হাতে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু ঘটবে না।
ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আধঘণ্টা পর, ডাক্তার তাঁর ডেথ সার্টিফিকেট জারি করলে তাঁর ঝুলন্ত দেহ ২.৩৫ মিনিটে নামানো হয়। তাঁর মৃতদেহকে গোসল করানো হয়, ওখানেই গোসলের আয়োজন করা হয়। একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রেরিত একজন ফটোগ্রাফার ভুট্টো সাহেবের বেশ কয়েকটি ছবি তোলে, এমনকি তার গোপনাঙ্গের ছবিও। কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হতে চাচ্ছিল—তাকে ইসলামি পদ্ধতিতে খতনা করানো হয়েছিল কি না। ছবি তোলা হলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তাকে ইসলামি পদ্ধতি অনুসরণ করে খতনা করানো হয়েছিল।
কোনো সন্দেহ নেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে ভুট্টোর মতো একই সঙ্গে নায়ক ও ভিলেন দ্বিতীয়টি মিলবে না।
কেবল ভুট্টোর প্রাণরক্ষার জন্য পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়কদের অনেকেই জেনারেল জিয়াউল হকের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, কিন্তু তিনি তাদের কথা কানে নেননি। জিয়াউল হকও নিজেও টিকতে পারেননি। ১৭ আগস্ট ১৯৮৮ আমের ঝুড়িতে পেতে রাখা বোমা উড়োজাহাজসহ তাঁকে ভূপতিত করেছে বাহওয়ালপুরের কাছেই। তার আর ইসলামাবাদ পৌঁছানো হয়নি।
৩-৪ এপ্রিল ১৯৭৯ রাতে ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। বিষয়টি তাঁকে জানানোর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন:
১. জেল সুপারিনটেনডেন্ট জনাব ইয়ার মোহাম্মদ|
২. সিকিউরিটি ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল রফি উদ দীন
৩. ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম শ্রেণি জনাব বশির আহমদ খান
৪. জেলখানার ডাক্তার সগীর হোসেন শাহ
এই চারজনের দলটি ৩ এপ্রিল ১৯৭৯ সন্ধ্যা ৬টা ৫ মিনিটে জেলখানার ডেথ সেলে প্রবেশ করল। দলের সদস্যরা দেখলেন জনাব ভুট্টো মেঝেতে বিছানো তোশকের ওপর শুয়ে আছেন।
জেল সুপারিনটেনডেন্ট ইয়ার মোহাম্মদ ফাঁসি কার্যকর করার আদেশটি ভুট্টোকে পড়ে শোনালেন : লাহোর হাইকোর্টের ১৮ মার্চ ১৯৭৮-এর আদেশ মোতাবেক নওয়াব মোহাম্মদ আহমদ খানকে হত্যার অপরাধে আপনি— জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হবে। সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা আপনার আপিল ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ খারিজ হয়ে যায়। আপনার দায়ের করা দণ্ডাজ্ঞা পুনর্বিবেচনার আদেশ ২৪ মার্চ ১৯৭৯ নাকচ হয়ে যায়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে চেয়েছেন। আপনাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জেল সুপারিনটেনডেন্ট যখন আদেশ পাঠ করছিলেন আমি জনাব ভুট্টোর চেহারায় আতঙ্কের কোনো চিহ্ন দেখি নি। বরং তাঁকে মনে হয়েছে শান্ত ও আয়েশি এবং মুখে ঈষৎ হাসি। এই সংবাদটি ভুট্টো যেভাবে গ্রহণ করলেন আমি সত্যিই বিস্মিত হয়েছি। আমি বরং ভাবছিলাম এমন নীরবতা ও প্রশান্তির মধ্যে যিনি তাঁর ফাঁসি কার্যকর করার আদেশটি শুনেছেন এবং ধারণ করেছেন এমন একজন নেতাকে আমরা ফাঁসি দিতে যাচ্ছি। আমার নিজের ভেতরে যে কথা শুনতে পাই তা হচ্ছে: এই নেতার মৃত্যু আমাদের জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর একটি ব্যাপার হবে। সম্ভবত জীবনে এই প্রথম আমার মনে হলো আমি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি।
ভুট্টো সাহেব জেল সুপারিনটেনডেন্টের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন: ‘‘আমাকে ফাঁসি দেওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগে যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষের বিষয়টি আমাকে জানাবার কথা, কিন্তু তা করা হয় নি। বরং আজ সকাল সাড়ে এগারোটায় আমার মেয়ে ও আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, তারাও এ সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না।’’
আমি জেল সুপারিনটেনডেন্টকে ডেকে এর ব্যাখ্যা চাইলাম। তিনি অস্পষ্টভাবে বললেন ফাঁসি কার্যকরের আদেশ দেওয়া হয়েছে, আদেশটি তার কাছেই রয়েছে।
তিনি আমাকে আরও বলেছেন, ‘‘আমার আত্মীয়রা— আমার বোন মোনাওয়ার উল ইসলাম, আমার কাজিন মমতাজ আলী ভুট্টো আমার মেয়ে ও স্ত্রী বিদায় হলে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। তিনি আরও বলেছেন, সবাই চলে যাওয়ার পর ১টা ৫০ মিনিটে তিনি নিজে এসে আমার উইল ইত্যাদি আমার কাছ থেকে গ্রহণ করবেন। আমার ফাঁসি কার্যকর করার কোনো লিখিত আদেশ এখন পর্যন্ত আমাকে দেখানো হয় নি। যত শিগগির সম্ভব আমি আমার আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই। আমাকে দেখার জন্য আমার অন্যান্য আত্মীয়দের অনুমতি দেওয়া উচিত। আমার দাঁতের অবস্থা খারাপ, জরুরি ভিত্তিতে আমার ডেন্টিস্ট জাফর নিয়াজির সঙ্গে আমার দেখা হওয়া দরকার।’’
ভুট্টোর কথা শেষ হলে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট বশির আহমদ খান তাঁকে নিজের পরিচয় দিলেন এবং বললেন, তিনি যদি তাঁর উইল লিখতে চান লিখতে পারেন। এ জন্য তাকে কাগজ ইত্যাদি সরবরাহ করা হবে। এরপর সরকার পক্ষ থেকে দেওয়া সব বার্তা শেষ হলো এবং কর্মকর্তারা ফিরে যেতে শুরু করলেন। আমি তখনো হতবুদ্ধি অবস্থায়। মনে হলো আমি প্রস্তরীভূত হয়ে যাচ্ছি। ভুট্টো সাহেব উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। আমার বাহু বাড়িয়ে তাঁকে ধরতে দিলাম। তিনি বললেন, তাঁর পাকস্থলিতে সমস্যা হচ্ছে।
ভুট্টো সাহেব তাঁর হেলপার আবদুর রেহমানকে ডেকে গরম পানি আনতে বললেন, শেভ করবেন। তারপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, রফি, এখন কোন নাটকটি মঞ্চস্থ হচ্ছে?
আমি কিছুটা সময় চুপ থাকি। তিনি প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন।
সবিনয়ে বললাম, স্যার, আমি কি কখনো আপনার সঙ্গে কৌতুক করেছি ?
তিনি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন, তুমি কী বলতে চাও ?
তারপর আবার সেই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন।
আমি বললাম, স্যার, আদেশ জারি হয়ে গেছে। আজই আপনাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে।
এই প্রথম তাঁর অবাক হওয়া চেহারা দেখলাম। তিনি হাত নেড়ে চড়া স্বরে বললেন, ঠিক আছে…সব শেষ হয়ে গেছে…ঠিক আছে…সব শেষ হয়ে গেছে।
আমি বললাম, জি স্যার।
আমার মনে হলো আতঙ্কে ভুট্টো সাহেবের চোখ ফেটে বের হয়ে আসতে চাইছে। তাঁর মুখমণ্ডল হলদে এবং শুকনো হয়ে উঠছে। সে সময়কার প্রকৃত অবস্থা সঠিকভাবে বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আজই? কোন সময়?
জাম্প-মাস্টার লাফ দেওয়ার আগে আঙুলে যেমন সময় দেখায় আমি তাঁকে হাতের আঙুল দেখালাম।
তিনি বললেন, ৭ দিন পর?
আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, স্যার, ঘণ্টা।
তিনি বললেন, আজই! ৭ ঘণ্টা পর?
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলাম।
ভুট্টো সাহেবকে যখন পিন্ডি জেলে আনা হয়, তিনি ছিলেন পাথরের মতো শক্ত, এখন মনে হয় তিনি বাষ্পীভূত হয়ে যাচ্ছেন। সে সময় আমি জীবনের বাস্তবতা অনুভব করেছি।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর আমি ভুট্টো সাহেবকে বলি, তাঁর সঙ্গে শেষ দেখার পর বেগম ভুট্টো ও বেনজির আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। আমি কেমন করে জেনারেল জিয়ার কাছে তাঁর প্রাণভিক্ষার আপিল পাঠিয়েছি তা বললাম। আমি দেখলাম তখন তাকে খুব নার্ভাস ও দুর্বল মনে হচ্ছে। আমি তাঁকে সেলের ভেতর চেয়ারে বসতে সাহায্য করলাম।
বললাম, এতক্ষণে বেগম সাহেবা হয়তো জেনারেল জিয়ার কাছে পৌঁছেছেন। আমি আশা করছি আল্লাহতায়ালা সদয় হয়ে এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা করবেন। ভুট্টো সাহেব চেয়ার থেকে উঠে আমাকে আলিঙ্গন করলেন। বললেন, তুমি একজন সাহসী মানুষ। তোমার সঙ্গে আমার আগেই দেখা হওয়া উচিত ছিল। আমি অনুভব করলাম তাঁর শরীর কাঁপছে। তবে আমি বুঝতে পারলাম, তাঁর নার্ভাস অবস্থা অনেকটা কেটে গেছে, তাঁকে প্রায় স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
একটু বিরতি দিয়ে তিনি যেন নিজেকেই শোনাতে থাকেন, আমার উকিলরা সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। আমার ফাঁসির জন্য ইয়াহিয়া দায়ী (ইয়াহিয়া বখতিয়ার, ভুট্টোর একজন আইনজীবী)। সে আমাদের ভুল কথা শুনিয়ে গেছে, সবকিছুর বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছে। তারপর তিনি বললেন, তার দলের দরকার একজন মৃত ভুট্টো, জীবিত ভুট্টো নয়।
যখন আমি বললাম, তাঁর একথা শুনে আমি অবাক হচ্ছি, তিনি আমার হাত ধরলেন। আর উকিলরা যে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে এ জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমি বললাম, এ নিয়ে তাদের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই।
ভুট্টো সাহেব বললেন, পীরজাদা (আবদুল হাফিজ পীরজাদা—ভুট্টোর আরেকজন আইনজীবী) ও বখতিয়ার তোমার বিরুদ্ধে পত্রিকায় বক্তব্য দিয়েছে।
আমি বললাম, তাতে আমার কোনো সমস্যা হয় নি। কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে আমাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে নি, এতে তাঁর উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আমি তাঁকে যে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছি, তার সঙ্গে যে সহৃদয় আচরণ করেছি সে জন্য ধন্যবাদ দিলেন। আমিও তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে তাঁর উইলটি লিখা উচিত। তিনি চাইলেন আমি তাঁর পাশে বসি। কিন্তু আমার উপর তাঁর সঙ্গে একা না থাকার কঠোর নির্দেশ রয়েছে। আরও কিছু সময় তার সঙ্গে কাটাতে পারলে ভালো হতো, সে বিশেষ মুহূর্তগুলো, অনুভূতিগুলো আমাকে জানাতে পারতেন। ঠিক তখনই লেখালেখির জন্য কাগজপত্র নিয়ে ওয়ার্ডবয় এল, আমাকে সেল ত্যাগ করতে হলো।
আমি বলেছি তাঁকে কখনো ফাঁসিকাষ্ঠে আসতে হবে ভুট্টো সাহেব তা কখনো ভাবেননি। তিনি সব সময় ভেবেছেন তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলা দেওয়া হয়েছে তা বানোয়াট, রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এর কোনো সারবত্তা নেই। ৩ এপ্রিল তাঁর স্ত্রী ও কন্যা বুঝতে পারে যে সরকার তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে ছাড়বে।
কিন্তু ভুট্টো মনে করতেন এটা ভুয়া ধারণা, কারা আইন অনুযায়ী ফাঁসির ৭ দিন আগে জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ফাঁসি কার্যকর করার আদেশ তাঁকে দেখানোর কথা।
যদিও সরকারি কর্মকর্তারা সন্ধ্যা ৬টায় আসন্ন ফাঁসি কার্যকর করার কথা তাঁকে জানিয়েছে, তিনি এ নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু তিনি যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কোন নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে এবং আমি যখন সোজাসাপটা বললাম, আজ তাঁকে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে নিশ্চয়ই তিনি তখন থেকে অনুধাবন করেছেন বলে আমার বিশ্বাস। তখনই তিনি বুঝতে পেরেছেন যে তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি। তিনিও তো মানুষ, মৃত্যুভীতি ও আতঙ্ক খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়।
আমি চলে যাওয়ার পর ৭.০৫ মিনিটে পুলিশের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট খাজা গোলাম রসুলের উপস্থিতিতে তিনি শেভ করেন। শেভ করার সময় ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্টের সঙ্গে তাঁর যে আলাপ হয় তার বিবরণ :
ডেপুটি সাহেব, তোমরা আমার মতো নেতা আর কোথায় পাবে? অবশ্য তার আগে তোমাদের কাছে আমার মতো নেতার দরকারটাই বা কী? আমাকে দরকার গরিবদের, তোমাদের মতো যারা তাদের দরকার নেই। আমি মুচি গেটে মুচিদের জন্য ভাষণ দিয়েছি। আমি নিজেও একজন মুচি। তোমরা গরিব মানুষের নেতাকে তাদের কাছ থেকে সরিয়ে দিচ্ছ। আমি একজন বিপ্লবী, আমি গরিবের সমর্থক। আমাকে যদি মারতেই হয় দু’বছর আগে কেন মারলে না? সারা পৃথিবী আমাকে যেমন সম্মান করে তোমরা কেন তা করছো না? আমাকে একটি রেস্ট হাউসে রাখতে পারতে, সম্মানের সঙ্গে আমি মৃত্যুকে বরণ করতে পারতাম। সারা পৃথিবী যাকে ইসলামিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছে সেই মানুষটি নিজের মতো করে শেভও করতে পারবে না। তুমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে যেন আমি নিজেকে ব্লেড দিয়ে কেটেকুটে না ফেলি। হ্যাঁ, আর একটা কথা বন্ধু…আমি তোমাদের অনেক জ্বালিয়েছি… দয়া করে আমাকে ক্ষমা কোরো। এই মামলায় তোমরা অন্য আসামিদের আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেছ। যাতে আমাকে ফাঁসিতে লটকানো যায় আর তারা সবাই মুক্তি পায়।
যে সেন্ট্রি সেলের বাইরে পাহারা দিত, তিনি তাকে ডাকলেন এবং ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্টকে বললেন, মৃত্যুর পর তাঁর হাত ঘড়িটা যেন সেন্ট্রিকে দিয়ে দেওয়া হয়।
ভুট্টো সাহেবের চোখে অশ্রু নামল। তিনি তাঁর হেলপার আবদুর রেহমানকে বললেন এক কাপ কফি আনতে। কফি আনা হলো।
ভুট্টো সাহেব তাকে বললেন, রেহমান, আমি যদি তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা কোরো। আমাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে, আজ রাতই তোমার সঙ্গে আমার শেষ রাত। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য আমি তোমার অতিথি হয়ে থাকব।
ভুট্টো সাহেব পৌনে ন’টা থেকে পৌনে দশটা পর্যন্ত তাঁর উইল নিয়ে কাজ করলেন। তারপর প্রায় ১০ মিনিট ধরে তাঁর আয়না, চিরুনি, হেয়ার ব্রাশ, জায়নামাজ গোছগাছ করে টেবিলে রাখলেন।
৯.৫৫ মিনিট পর্যন্ত দাঁত ব্রাশ করলেন, মুখ ধুলেন, মাথা আঁচড়ালেন। তারপর প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে তাঁর সিগারেটের ছাই ও পোড়া কাগজের ছাই পরিষ্কার করলেন।
আবার রাত ১০.১০ থেকে ১১.০৫ পর্যন্ত লিখলেন। তারপর এতক্ষণ যা লিখলেন তার সবই পুড়িয়ে ফেললেন। গোটা সেল জুড়ে ছাই ছড়িয়ে পড়ল। তিনি আবদুর রেহমানকে ডেকে সেল পরিষ্কার করতে বললেন।
তিনি সেন্ট্রিকে জিজ্ঞেস করলেন, কতটা সময় বাকি?
সেন্ট্রি বলল, এখনো অনেক সময় রয়ে গেছে।
তারপরও ভুট্টো সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কতটা সময় বাকি?
সেন্ট্রি চুপ করে রইল। তিনি তখন নিজে নিজেই বললেন, তাহলে ১-২ ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে পারব।
রাত ১১.১০ মিনিটে সেলের তালা খোলা হলো, আবদুর রেহমান ভেতরে ঢুকে মেঝে থেকে ছাই পরিষ্কার করল। সেল আবার তালাবন্ধ করা হলো। ভুট্টো সাহেব চুপচাপ শুয়ে রইলেন।
রাত ১১.২৫ মিনিটে তিনি বললেন, কিছুক্ষণ ঘুমোতে চেষ্টা করবেন, গত রাতে ঠিকভাবে ঘুমোতে পারেন নি। তাঁকে রাত বারোটার সময় ডেকে তুলতে বললেন। ঘুমঘোরে তিনি কয়েকবার তার মেয়ে সনম-এর নাম ধরে ডাকলেন।
রাত ১১-৫৫ মিনিটে অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট মাজিদ আহমদ কোরেশি এবং কাজিম হোসেন বালুচ হাজির হলেন। তারা সেলের বাইরে থেকে ভুট্টো সাহেবকে জাগাতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু তিনি সাড়া দিলেন না। কোরেশি জেল অফিসে ফোন করে তাদের এ অবস্থায় কী করণীয় জানতে চান। তাকে সেলের ভেতর ঢুকে ভুট্টো সাহেবকে জাগাতে বলা হলো।
কোরেশি ভেতরে ঢুকার পরও তিনি জাগলেন না। কোরেশি আবার ফোন করে বললেন, তিনি জাগছেন না, অজ্ঞানের মতো পড়ে আছেন। এরকম একটি অবস্থায় আমি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম—তিনি যাতে কোনো অবস্থাতেই আত্মহত্যা করতে না পারেন তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমার।
বারোটা বাজার এক মিনিট আগে আমি জেল সুপারিনটেনডেন্ট, জেলখানার ডাক্তার ও ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে সিকিউরিটি ওয়ার্ডে ঢুকলাম। সেলের ভেতরে ভুট্টো সাহেব তোশকের ওপর পড়ে আছেন, তাঁর মুখ সেলের দিকেই। জেল সুপারিনটেনডেন্ট চৌধুরী ইয়ার মোহাম্মদ এবং জেলখানার ডাক্তার দেখেছেন ভুট্টো সাহেব তার এক চোখ খুলেছেন, কিন্তু আমাদের দেখে তিনি তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে ফেলেন।
চৌধুরী ইয়ার মোহাম্মদ এবং আমি ভুট্টো সাহেবকে নাম ধরে ডাকি, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয় না। ভুট্টো সাহেবকে পরীক্ষা করার জন্য ডাক্তারকে নির্দেশ দিই। ডাক্তার তাঁর পালস পরীক্ষা করলেন, তারপর স্টেথোস্কোপে হৃদস্পন্দন শুনে ফিসফিস করে আমাকে বললেন, তিনি ভালোই আছেন।
আমি ডাক্তারকে আমার সঙ্গে সেলের বাইরে আসতে বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, ভুট্টো সাহেব জবাব দিচ্ছেন না কেন?
ডাক্তার আমাকে আশ্বস্ত করলেন, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন, তাঁকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই; তিনি ভান করছেন।
আমি ডাক্তারকে আবার বললাম, যদি তাঁর কিছু হয় তাহলে ডাক্তারকেই তাঁর দায়িত্ব নিতে হবে। তাকে আবার পরীক্ষা করার নির্দেশ দিলাম।
ডাক্তার তৃতীয়বারের মতো পরীক্ষা করে বললেন, সবই ঠিক আছে, ভুট্টো সাহেব ভান করছেন।
রাত ১-১০ মিনিটে ভুট্টো সাহেব নিজেই উঠলেন। মাজিদ আহমদ কোরেশি বললেন, তাঁর গোসলের জন্য গরম পানি রাখা আছে। কিন্তু তিনি জানালেন, তিনি আর গোসল করবেন না।
ভুট্টোর ফাঁসি কার্যকর
আদেশ অনুযায়ী ১৯৭৯ সালের ৩-৪ এপ্রিল রাতে ইন্সপেক্টর অব জেল চৌধুরী নাজির আখতারের উপস্থিতিতে তাঁর ফাঁসি কার্যকর করার কথা। ইন্সপেক্টর ৩ এপ্রিল সকাল থেকে জেলখানায় অবস্থান করছেন। তিনি অনশন ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছিলেন বলে তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে একটি স্ট্রেচার এনে রাখা হয়েছে। রাতটা গভীর অন্ধকার এবং আকাশে পুরো ঘন কালো মেঘ, সেজন্য কয়েকটি পেট্রোম্যাক্সও আনা হয়েছে। রাত ১-৩৫ মিনিটে নিচের কর্মকর্তারা জেলখানার সিকিউরিটি ওয়ার্ডে প্রবেশ করলেন :
১ জেল সুপারিনটেনডেন্ট জনাব ইয়ার মোহাম্মদ
২. সিকিউরিটি ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল রফি উদ-দীন
৩. ম্যাজিস্ট্রেট ফার্স্ট ক্লাস জনাব বশীর আহমদ খান
৪. জেল ডাক্তার জনাব খাজা সগির হোসেন শাহ\
৫. ডেপুটি জেল সুপারিনটেনডেন্ট গোলাম রসুল।
অ্যাসিস্ট্যান্ট জেল সুপারিনটেনডেন্ট মাজিদ আহমদ কোরেশি, কাজিম হাসান বালুচ, মহব্বত খান এবং জেল সুপারিনটেনডেন্ট নির্বাচিত কয়েকজন ওয়ার্ডার উপরে বর্ণিত অফিসারদের পেছনে পেছনে সিকিউরিটি ওয়ার্ড পর্যন্ত এলেন। ইন্সপেক্টর অব জেল চৌধুরী নাজির আখতার তাঁর অফিস থেকে সরাসরি ফাঁসিকাষ্ঠের কাছে চলে গেলেন। সিকিউরিটি ওয়ার্ড থেকে ফাঁসিকাষ্ঠ পর্যন্ত পথটিতে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হলো।
কর্মকর্তারা ভুট্টো সাহেবের সেলে ঢুকলেন।
তিনি জাগ্রত, তোশকের ওপর শুয়ে আছেন।
ম্যাজিস্ট্রেট বশির আহমদ খান তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি কোনো উইল রেখে যেতে চান কি না ? ভুট্টো সাহেব চুপ করে রইলেন। তিনি হলদে ও পান্ডুর হয়ে গেছেন, শরীরও খুব দুর্বল মনে হলো। তাঁর স্বর একটু কেবল শোনা যায়, দুর্বলতা থেকে এ অবস্থা। তারপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন: আমি লিখতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমার ভাবনা এতই এলোমেলো হয়ে গেছে যে আমি কাজটা করতে পারি নি, আমি এটা পুড়িয়ে ফেলেছি।
আমি তাঁর কাছে গিয়ে উবু হয়ে আরও কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার, আপনি কি নিজে হেঁটে যেতে পারবেন, না আমরা আপনাকে তুলে নিয়ে যাব?
তিনি আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি কিছুক্ষণ পর আমার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলাম। তিনি একইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমার দুঃখ হচ্ছে (বিড়বিড় করে আরও কিছু বললেন যা আমরা বুঝতে পারি নি)।
আমি সামনের দিকে ঝুঁকে তাঁকে বললাম তিনি কী বলেছেন বুঝতে পারি নি। তিনি একইভাবে কিছু বললেন, তার শেষ কয়েকটি শব্দ আমি বুঝতে পারি নি। আমি বললাম, ক্ষমা করবেন স্যার, আপনি কী বলেছেন বুঝতে পারি নি।
একটু বিরতি দিয়ে এবং কিছুক্ষণ চেষ্টা করে তিনি বললেন, আমার দুঃখ হচ্ছে আমার স্ত্রী চলে গেছে।
তাঁর মন তখন অত্যন্ত বিষন্ন। হয়তো তিনি বলতে চেয়েছেন তিনি হাঁটতে পারবেন না, আবার তাকে বহন করে নেওয়া হোক এটাও চাচ্ছেন না। হয়তো তিনি ভাবছেন এ সময় তাঁর স্ত্রী পাশে থাকলে তাঁকে সহায়তা করতে পারতেন।
ম্যাজিস্ট্রেট আবার এগিয়ে এসে তিনি একটি উইল লিখতে আগ্রহী কি না জানাতে বললেন। কিন্তু তিনি নীরব রইলেন। ম্যাজিস্ট্রেট আবার একই কথা জিজ্ঞেস করলেন।
ভুট্টো সাহেব বললেন, হ্যাঁ, আমি ডিকটেশন দিতে চাই।
ততক্ষণে সময় শেষ হয়ে গেছে। জেল সুপারিনটেনডেন্ট প্রধান ওয়ার্ডারকে আদেশ করলেন সিকিউরিটি ওয়ার্ডের ভেতরে অবস্থানরত তার লোকজন যেন ভুট্টো সাহেবকে উঠিয়ে নিয়ে আসে। চারজন ওয়ার্ডার ভেতরে ঢুকলেন। দুজন তাঁর দু’পায়ে এবং দুজন দু’বাহুতে ধরে ভুট্টো সাহেবকে উঠিয়ে ফেললেন।
যখন তাকে উঠানো হচ্ছিল তিনি বললেন, আমাকে ছেড়ে দাও।
ভুট্টো সাহেবকে যখন এভাবে উঠিয়ে সেল থেকে বের করা হচ্ছিল তাঁর পিঠ সেলের সঙ্গে প্রায় লেগে যাচ্ছিল। তাঁর শার্টের নিচের অংশ ওয়ার্ডারের জুতোর সঙ্গে পেঁচিয়ে যাচ্ছিল; আমি তাঁর শার্ট ছিঁড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাই। লনে রাখা স্ট্রেচারে তাঁকে শুইয়ে দেওয়া হয়। তাঁর হাত দুটি রাখা হয় পাকস্থলির ওপর, তারপর তাঁকে হাতকড়া লাগানো হয়। ততক্ষণে হেলপার এক কাপ চা নিয়ে আসে, আমরা সেলে ঢোকার আগে ভুট্টো সাহেব কফি আনার আদেশ দিয়েছিলেন।
আমি অবাক হই। জেলখানার দেয়ালের ওপারেই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। ভুট্টো সাহেব তখন যা চাইতেন পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকেই হোক তা তিনি পেয়ে যেতেন। আর আজ তার এক কাপ চা খাওয়ার সাধারণ ইচ্ছেটিও পূর্ণ হচ্ছে না।
চারজন ওয়ার্ডার চারদিক থেকে স্ট্রেচার তুলল। ভুট্টো সাহেব কেবল মাথা তুললেন, স্থির রইল তাঁর শরীর। তাঁর পা হলুদ রঙ ধরেছে—যেন শুষে তাঁর রক্ত বের করে নেওয়া হয়েছে। ফাঁসিকাষ্ঠ পর্যন্ত আসতে তিনি নিথর হয়েই পড়েছিলেন। ফাঁসিকাষ্ঠের কাছে মাটিতে স্ট্রেচার নামানো হলো। তখন আমিই ভুট্টো সাহেবের সবচেয়ে কাছে। দুজন ওয়ার্ডার ভুট্টো সাহেবের বগলতলায় হাত ঢুকিয়ে তাঁকে তক্তার ওপর দাঁড় করাতে চেষ্টা করলেন। তার মুখমণ্ডল থেকে সামান্য দূরে আমার কান। তাঁর হ্যান্ডকাফ খুলে দু’হাত ও দু’বাহু সজোরে ঝাঁকি দিয়ে পেছনে নিয়ে আবার হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দেওয়া হলো।
ইতিমধ্যে জল্লাদ তারা মশিহ চলে এল। ভুট্টো সাহেবকে মুখোশ পরিয়ে দিল। মুখোশের কারণে হয়তো তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল কিংবা যেভাবে তার হাত বাঁকিয়ে পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগানো হয়েছে তাতে যে ব্যথা পেয়েছেন, সেই ব্যথায় কাতরাচ্ছেন।
ভুট্টোর শেষ দিনগুলো রাওয়ালপিন্ডি জেল কেটেছে। ডানে জল্লাদ তারা মশিহ।
তিনি সম্ভবত বলতে চেয়েছেন, এগুলোতে আমার ব্যথা লাগছে। আমি তাঁর খুবই কাছাকাছি। আমি তাঁর এত কাছাকাছি এসে গেছি তক্তাটিকে উপেক্ষা করে তাঁর মুখ ও আমার কানের দূরত্ব দেড় ফুটের বেশি নয়। কিন্তু তাঁর শেষ বাক্যটি আমি শুনতে পাই নি।
মধ্যরাত পেরিয়ে ৪ এপ্রিল ১৯৭৯, ২-০৪ মিনিট জল্লাদ লিভার চাপ দিল, ভুট্টো সাহেব ঝুলে পড়লেন। আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম—ভুট্টো সাহেব ঝুলে আছেন। আমি দেখলাম তাঁর শরীর আলতো করে দুলছে—এটা শরীরের নিম্নমুখী ভরবেগের কারণেই। ততক্ষণে নিশ্চয়ই তাঁর দম বেরিয়ে গেছে। ভুট্টো সাহেবের ঝুলন্ত শরীরের একপাশে রাখা চেয়ারে আমি জেল সুপারিনটেনটেডেন্ট-এর পাশে বসলাম।
ফাঁসিতে ঝুলে থাকা ভুট্টো সাহেবকে যেমন দেখেছি তা কখনো ভুলতে পারি নি, সে সময়ের কথা মনে হলে এখনো গা কেঁপে ওঠে।
কয়েক মিনিট পরে দেখলাম, কে-একজন জনাব ভুট্টোর শরীর নাড়াচাড়া করছে। আমি চৌধুরী ইয়ার মোহাম্মদকে জিজ্ঞেস করলাম, লোকটি কে? তাঁর পরিবর্তে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন জবাব দিলেন। বললেন, লোকটা তারা মশিহ। সে ভুট্টো সাহেবের পা ও হাত টেনে সোজা করছে, যাতে খিঁচুনির কারণে তাঁর শরীর বেঁকে না যায়।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
ইমেইল: momen98765@gmail.com