বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ককে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা বাড়ানোর দায়িত্ব দিতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মঙ্গলবার ট্রাম্প এ ঘোষণা দেন ট্রাম্প।
মাস্কের নেতৃত্বে ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি’ বা সরকারি দক্ষতা দপ্তর নামে একটি নতুন বিভাগ খোলা হবে ট্রাম্প প্রশাসনে। এটি এমন একটি দপ্তর হবে যা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে কাজ করবে।
দপ্তরটির পরিচালনায় মাস্কের সহযোগী হিসাবে থাকবেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিবেক রামাস্বামী, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি খাতের একজন উদ্যোক্তা, অধিকারকর্মী ও বিনিয়োগকারী।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে ট্রাম্প বলেন, “মাস্ক ও রামাস্বামী আমার প্রশাসনের জন্য সরকারি আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য কমানো, অতিরিক্ত বিধিবিধান ও নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনা, সরকারের খরচ কমানো ও কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরগুলোর পুনর্গঠনের পথ প্রশস্ত করবেন।“
ট্রাম্প বলেন, নতুন বিভাগটি রিপাবলিকানদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে এবং ‘সরকারের বাইরে থেকে পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রদান করবে’।
একথা বলে ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন, মাস্ক ও রামাস্বামী সিনেটের অনুমোদন ছাড়াই কাজ করতে পারবেন। আর মাস্কই বৈদ্যুতিক গাড়ি কোম্পানি টেসলা, সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স এবং রকেট কোম্পানি স্পেস এক্সের প্রধান হিসাবে থাকবেন।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিবেক রামাস্বামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। তবে প্রাথমিক বাছাইয়ে হেরে ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়ে সরে দাঁড়ান বিবেক। এতে তিনি ট্রাম্পের পছন্দের তালিকায় চলে আসেন।
ট্রাম্প বলেন, মাস্কের নেতৃত্বে সৃষ্ট নতুন বিভাগটি হোয়াইট হাউস এবং অফিস অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বাজেটের সঙ্গে কাজ করবে। এর কাজ হবে সরকারি খরচ কমানোর জন্য ‘বড় আকারের কাঠামোগত সংস্কার চালানো এবং উদ্যোক্তা অ্যাপ্রোচ তৈরি করা’, যা আগে কখনও দেখা যায়নি।
অক্টোবরে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ট্রাম্পের এক সমাবেশে মাস্ক বলেছিলেন, ফেডারেল বাজেট কমপক্ষে ২ ট্রিলিয়ন ডলার কমানো সম্ভব।
জনগণের উদ্দেশে মাস্ক বলেন, “আপনাদের অর্থ অপচয় করা হচ্ছে এবং সরকারি দক্ষতা বিভাগ এটি ঠিক করতে যাচ্ছে। আমরা সরকারকে আপনাদের পিঠ এবং পকেটে চাপ দেওয়া থেকে সরিয়ে আনব।”
ট্রাম্প বলেন, এই প্রকল্পের কাজ ৪ জুলাই ২০২৬ এর মধ্যে শেষ হবে। সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ২৫০তম বার্ষিকী।
তবে ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করেছে প্রগতিশীল ভোক্তা অধিকার এনজিও ‘পাবলিক সিটিজেন’। সংস্থাটি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের বেশ কয়েকটি নীতিকেও চ্যালেঞ্জ করেছিল।
পাবলিক সিটিজেন-এর কো-প্রেসিডেন্ট লিসা গিলবার্ট এক বিবৃতিতে বলেন, “ইলন মাস্ক সরকারি দক্ষতা এবং নিয়মনীতি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তার নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিতভাবে যেসব সরকারি নিয়ম-কানুন লঙ্ঘন করে চলেছে, সেগুলোর ওপরই মাস্ক এবার আরও খড়গহস্ত হবেন। এটি একটি চূড়ান্ত করপোরেট দুর্নীতি।”
বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক ইতোমধ্যে ট্রাম্পের বিজয় থেকে উপকৃত হয়েছেন। এবার তিনি তার কোম্পানিগুলোর ওপর সরকারি নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ কমানোর মাধ্যমে আরও লাভবান হবেন।
এতে তার কোম্পানির বাজার মূল্য বাড়াসহ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো ব্যবসায়ও সুবিধা হতে পারে।
নির্বাচনের আগে ইলন মাস্ক ট্রাম্পকে যে সহায়তা দিয়েছিলন এটা তারই পুরস্কার। ট্রাম্পের নির্বাচনী তহবিলে কোটি কোটি ডলার দান করার পাশাপাশি তার পক্ষে সরাসরি নির্বাচনীয় প্রচারণায়ও নেমেছিলেন ইলন মাস্ক।
ইলন মাস্ক গত কয়েক বছর ধরেই একের পর এক সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছিলেন এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিগুলোকে অতিরিক্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তকরণের পক্ষে অসংখ্য গণবিবৃতি দেন। ফেডারেল সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে একটি পূর্ণ-মাত্রার অডিটের আহ্বানও জানান।
তার এই ধারণা ট্রাম্পও লুফে নেন। সেপ্টেম্বরে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে মাস্কের নেতৃত্বে একটি সরকারি এফিশিয়েন্সি কমিশন বা দক্ষতা কমিশন চালু করবেন। যার লক্ষ্য হবে ফেডারেল এজেন্সিগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও খরচ কমানো।
মাস্ক এটিকে সরকারি দক্ষতা বৃদ্ধি বিভাগ বলতে চান, যার মাধ্যমে তিনি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের খরচ কমাবেন, প্রবিধান সংস্কার করবেন এবং লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমিয়ে ফেডারেল আমলাতন্ত্রকে আরও গতিশীল করবেন।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মাস্কের উদ্দেশ্য মূলত তার নিজের কোম্পানিগুলোর ওপর সরকারি নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ কমানো।
এমনকি মাস্কের লড়াই শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ নয়। কখনও কখনও ভিন দেশের সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে তার লড়াই তাকে বিশ্বের অন্য বিলিয়নেয়ারদের বিরুদ্ধেও দাঁড় করিয়ে দেয়।
উদাহরণ হিসাবে ভারতের কথা বলা যায়, যেখানে স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড বিতরণ নিয়ে নয়া দিল্লি সরকারের সঙ্গে লড়াই করে মাস্ক মুকেশ আম্বানির বিরুদ্ধে বিজয়ী হন। এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানি তার নিজের টেলিকমিউনিকেশন সাম্রাজ্যের জন্য আরও অনুকূল শর্ত চেয়েছিলেন। কিন্তু মাস্ক তাতে বাগড়া দেন।
সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে তার লড়াই নিয়মিতই তাকে যে দেশেই কাজ করতে যান সে দেশের বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। ব্রাজিল ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গেও বিরোধে জড়িয়েছেন মাস্ক।
রামাস্বামীও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা কমানোর পক্ষে। তিনি তার ২০২১ সালের বেস্টসেলার বই ওক, ইনক-এ সামাজিক ন্যায়বিচার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের উদ্বেগ ঘিরে ব্যবসায়িক কৌশল নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া কিছু বড় বড় কোম্পানির নিন্দা করেন।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান