যুক্তরাষ্ট্রের এ বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোট পেতে অভিনব পন্থা বের করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সাহায্যে তাদের নেতার ছবি তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এসব ছবিতে দেখা যাচ্ছে, আফ্রিকান আমেরিকান নারী-পুরুষ যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ঘিরে আছেন। সবার মুখে হাসি।
বলা বাহুল্য, ট্রাম্পের এসব ছবি ভুয়া।
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রকাশ্যে তোষামোদ তত বাড়িয়েছেন ট্রাম্প। কারণ ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত কৃষ্ণাঙ্গরা ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ জো বাইডেনকে ভোট দিয়েছিলেন। ট্রাম্প ও তার দল রিপাবলিকান পার্টির বর্ণবাদী চিন্তাকাঠামো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এই কৃষ্ণাঙ্গরা। তাই তাদের ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার প্রশ্নই ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে আফ্রিকান আমেরিকানরা যে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তা ২০২০ সালে বাইডেনের কাছে হেরে টের পেয়েছিলেন ট্রাম্প। তাই আর ভুল করতে নারাজ তিনি।
কৌশলী ট্রাম্প এবার তার বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আপাত মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার, তাদের দাবি-দাওয়ার পক্ষে কথা বলে সহানুভূতি কুড়ানোর চেষ্টা করছেন। এদিক থেকে ট্রাম্পের ঘোর সমর্থকরা আরও এক কাঠি সরেস। তারা নেতার মনোবাঞ্ছা বুঝতে পেরে এআইয়ের শরণাপন্ন হয়েছেন। তৈরি করছেন ভুয়া ছবি।
এসব ছবি নিয়ে সম্প্রতি অনুসন্ধানে নামে বিবিসি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটি তাদের অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্রের অনুষ্ঠান প্যানোরামায় সোমবার তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তুলেও ধরে।
অনুসন্ধানে কৃষ্ণাঙ্গ নারী-পুরুষ পরিবেষ্টিত সাবেক প্রেসিডেন্টের এআই দিয়ে বানানো ছবির সঙ্গে ট্রাম্পের প্রচার দলের সরাসরি কোনও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
ট্রাম্পের ছবি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের সংগঠন ব্ল্যাক ভোটার্স ম্যাটারের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি।
কৃষ্ণাঙ্গদের ভোট দিতে উৎসাহ প্রদানকারী এই সংগঠনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ক্লিফ অলব্রাইট বলেন, “ভুয়া ছবির মাধ্যমে ‘কৌশলগত বয়ান’ তুলে ধরা হচ্ছে। এর লক্ষ্য, কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যে ট্রাম্প কত জনপ্রিয়, তা দেখানো।”
যুক্তরাষ্ট্রে এ বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের সমর্থকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়াতে জোরেশোরে লেগেছেন। তবে এবার তারা একটু সতর্ক।
২০১৬ সালের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখছেন ট্রাম্পের সমর্থকরা। সেবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ট্রাম্পকেন্দ্রিক নানা ধরনের ভুল তথ্য ছড়ানো হয়। পরে প্রমাণ মেলে, সেসব তথ্য সৃষ্টি ও বিস্তারে বিদেশিদের হাত ছিল।
এবার তাই কৃষ্ণাঙ্গ নারী-পুরুষসহ ট্রাম্পের ছবি এআইকে দিয়ে তৈরি করছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেগুলো ছড়াচ্ছেনও তারা। তাদেরই একজন মার্ক কে। তিনি ফ্লোরিডায় রক্ষণশীল চিন্তাধারার একটি রেডিও স্টুডিওতে উপস্থাপক হিসেবে কাজ করেন।
সম্প্রতি এআইকে দিয়ে ট্রাম্পের একটি ছবি বানান মার্ক ও তার দল। এতে দেখা যায়, একটি পার্টিতে হাস্যোজ্জ্বল ট্রাম্পকে ঘিরে আছে একদল কৃষ্ণাঙ্গ নারী-পুরুষ। ট্রাম্পের হাত তাদের কাঁধে।
ছবিটি তৈরির পর তা ফেসবুকে শেয়ার করেন মার্ক। সামাজিক এই যোগাযোগমাধ্যমটিতে তার ফলোয়ার ১০ লাখের বেশি।
মার্ক ও তার দলের বানানো ছবি দেখলে শুরুতে আসল মনে হয়। কিন্তু কাছ থেকে দেখলে খুঁতগুলো চোখে পড়ে। যেমন, ছবির প্রতিটির মানুষের ত্বকের রঙ যেন একটু বেশিই উজ্জ্বল। এছাড়া ছবিতে তাদের হাতের সব আঙুলও নেই।
ছবির খুঁত সম্পর্কে এর কারিগর মার্ক বলেন, “আমি তো ফটো সাংবাদিক নই। ওই পার্টিতে আমি ছিলাম না। ছবিও তুলিনি। আমি একজন গল্পকার।
“আমি ছবিটিকে নিখুঁত বলে দাবি করছি না। আমি বলছি না, দেখ দেখ, পার্টিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আছেন আফ্রিকান আমেরিকান ভোটাররা। দেখ, তারা তাকে কতই না ভালোবাসেন।’”
ট্রাম্প যে কৃষ্ণাঙ্গদের সমর্থন পাচ্ছেন, এ নিয়ে ফেইসবুকে একটি নিবন্ধ পোস্ট করেছিলেন মার্ক। সেই নিবন্ধের সঙ্গেই ওই এআইসৃষ্ট ছবি জুড়ে দেন তিনি।
মার্ক মনে করেন, ফেসবুকে এআইসৃষ্ট ছবি দেখে যদি কেউ প্রভাবিত হন এবং তা ব্যালট বাক্স পর্যন্ত গড়ায়, তাহলে সেটি ওই ব্যক্তির সমস্যা। ছবিসম্বলিত পোস্টটি সেক্ষেত্রে কোনোভাবে দায়ী নয়।
ট্রাম্পের আরেকটি এআইসৃষ্ট ছবি নিয়ে অনুসন্ধান করে বিবিসি। সে ছবিতে ট্রাম্পকে একটি বাড়ির সামনের বারান্দায় কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণের সঙ্গে পোজ দিতে দেখা যায়। ছবির ক্যাপশন ছিল এমন-এই কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে পরিচিত হতে মাঝপথে গাড়ি থামিয়েছেন ট্রাম্প।
ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন শ্যাগি নামের এক ব্যক্তি। ট্রাম্পের কড়া এই সমর্থক থাকেন মিশিগানে। যথারীতি এই ছবি বেশ ভাইরাল হয়।
ওই ছবি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে শ্যাগি বলেন, “আমার ছবি হাজারো হৃদয়বান খ্রিস্টান ফলোয়ারকে আকৃষ্ট করেছে।”
ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কি না, বিবিসির সাংবাদিকের এই প্রশ্ন এড়িয়ে যান শ্যাগি। শুধু তাই নয়, বিবিসির ওই সাংবাদিককে তিনি ব্লকও করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স বলছে, ১৩ লাখের বেশি মানুষ ছবিটি দেখেছে।
এ জাতীয় ছবি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। তবে এআই দিয়ে যে তার ছবি বানানো হচ্ছে না, তা নয়। সেসব ছবিতে হয় তিনি একা আছেন, নয়তো তাকে বিশ্বের বড় বড় নেতা যেমন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে দেখা গেছে।
বাইডেনের এসব ছবির কয়েকটি সমালোচকরা বানিয়েছেন। বাকিগুলো তার সমর্থকদের হাতে তৈরি।
এ বছরের জানুয়ারিতে বাইডেন খোদ এআই প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হয়েছিলেন।
সে সময় নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী বাছাইয়ের লড়াইয়ের আগে বাইডেনের একটি অডিও বার্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বার্তায় তিনি ভোটারদের প্রার্থী বাছাইয়ের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার আহ্বান জানান।
স্পষ্টতই বাইডেন ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতাদের প্রতি এ ধরনের কোনও আহ্বান জানাননি। পুরো অডিওটাই ছিল বানোয়াট, এআই দিয়ে তৈরি।
এ ঘটনার দায় পরে নিয়েছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির এক সমর্থক। তার যুক্তি ছিল, প্রযুক্তি অপব্যবহারের সম্ভাবনার দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করাই ছিল তার উদ্দেশ্য।