Beta
শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

ট্রাম্পের ‘শান্তিস্থাপক’ প্রতিশ্রুতি ভেঙে পড়ছে যেভাবে

tehran_times
[publishpress_authors_box]

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত জানুয়ারিতে দেওয়া অভিষেক ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন, ক্ষমতাকালে তার সবচেয়ে গর্বের বিষয় হবে ‘শান্তির দূত ও ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে স্মরণীয় হওয়া। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি সব যুদ্ধ বন্ধ করবেন এবং একটি ক্রুদ্ধ, সহিংস ও অনিশ্চিত বিশ্বে ঐক্যের নতুন চেতনা ফিরিয়ে আনবেন।

এমন শান্তির বার্তা দেওয়ার মাত্র পাঁচ মাস পর ট্রাম্পের সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার ব্যর্থতা প্রকটভাবে সামনে চলে এসেছে।

ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী সংঘাতের অবসানের অঙ্গীকার করেছিলেন— এমনকি এক সংঘাত তিনি তার দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মিটিয়ে ফেলার ঘোষণা দিয়েছিলেন। অথচ বাস্তবে তিনি সেই সংঘাতগুলোর আরও বিস্তারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সর্বশেষ উদাহরণ হলো ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষ।

এই সাম্প্রতিক সংঘর্ষের সময়রেখা আবারও দেখায় যে, ট্রাম্পের আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার মধ্যে কতটা বিস্তর ফারাক রয়েছে। কারণ ট্রাম্প ইসরায়েলকে ইরানের ওপর হামলা না চালানোর আহ্বান জানানোর কিছুক্ষণ পরই ইসরায়েলি বিমান হামলার ঢেউ শুরু হয়।

ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জোর দিয়ে বলেন, ইসরায়েলের এই হামলা ছিল ‘একতরফা’ এবং যুক্তরাষ্ট্র ‘ইরানে কোনও হামলায় জড়িত ছিল না’। অথচ ট্রাম্প পরবর্তীতে নিজেই বলেন, তিনি ইসরায়েলের পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন এবং সতর্ক করেন যে, পরবর্তী হামলা ‘আরও ভয়ংকর’ হবে।

মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনে ট্রাম্পের প্রধান কূটনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা স্টিভ উইটকফ এখনও ওমানে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। উদ্দেশ্য হলো তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় বসা। কিন্তু শনিবারই তেহরান থেকে এই আলোচনা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। তেহরানের বক্তব্য হলো, ইসরায়েলি আক্রমণের মধ্যে কোনো আলোচনা হতে পারে না।

আসলে ট্রাম্পের এই জটিল ও বিভ্রান্তিকর শান্তির এজেন্ডা বৃহস্পতিবারের হামলার অনেক আগেই বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যায়।

গাজায় যে যুদ্ধবিরতি ট্রাম্প প্রশাসন মধ্যস্থতা করেছিল, তা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ভেঙে পড়ে। এরপর ইসরায়েল আবারও ব্যাপকভাবে গাজা ভূখণ্ডে বোমাবর্ষণ শুরু করে এবং তিন মাসের জন্য সম্পূর্ণ মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়। সেখানে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৫৫ হাজার ছাড়িয়েছে।

ইউক্রেন নিয়ে ট্রাম্প একসময় গর্ব করে বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় ফিরে আসার প্রথম দিনেই যুদ্ধ থামিয়ে দেবেন। কিন্তু বাস্তবে রুশ বাহিনী এবার গ্রীষ্মকালীন হামলায় আরও অগ্রসর হয়েছে। তারা তিন বছর পর প্রথমবারের মতো দিনিপ্রোপেট্রোভস্ক অঞ্চলে ঢুকে পড়েছে এবং নতুন করে সৈন্য মোতায়েন করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, পুতিন ট্রাম্পের শান্তির প্রস্তাবে মোটেই আগ্রহী নন। বরং যুদ্ধকে আরও সম্প্রসারণ করতে চান।

এদিকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হঠাৎ যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন ট্রাম্প। কিন্তু দিল্লিতে এই ঘোষণা তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ভারতের কর্মকর্তারা ট্রাম্পের মধ্যস্থতার দাবিকে সরাসরি অস্বীকার করেন।

এমনকি যখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ কংগ্রেসকে জানান যে, পেন্টাগন গ্রীনল্যান্ড ও পানামাকে সামরিকভাবে দখলের জরুরি পরিকল্পনা তৈরি করেছে, তখন প্রশ্ন ওঠে— এই ধরনের আঞ্চলিক দখল কিভাবে ট্রাম্পের “শান্তি স্থাপন” দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেও কোনও যুদ্ধ শেষ হয়নি। বরং ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল পরিস্থিতি। তার সবচেয়ে আলোচিত “শান্তির কৃতিত্ব” হলো আব্রাহাম চুক্তি, যা ইসরায়েলের সঙ্গে এমন কিছু দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, যারা আদৌ যুদ্ধাবস্থায় ছিল না।

ট্রাম্পের অনেক ভোটারের কাছে তার জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ ছিল তার প্রতিশ্রুতি— যুক্তরাষ্ট্রকে বিদেশি যুদ্ধজটিলতা থেকে দূরে রাখা। তার অভিষেক অনুষ্ঠান ঘিরে যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা ‘গার্ডিয়ান’কে বলেছিলেন, তারা ট্রাম্পের সেনা মোতায়েন না করা এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া “আমেরিকা-ফার্স্ট” নীতিকে মূল্য দেন। অনেকেই মনে করেন, ট্রাম্পের কাছে “শান্তি” মানে কেবল সংঘাতহীনতা নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রকে সেসব সংঘাত থেকে দূরে রাখা।

তবে ইরানে সর্বশেষ হামলা নিয়ে একটি সম্ভাব্য ইতিবাচক ব্যাখ্যা উঠে এসেছে। 

ওয়াশিংটনের মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের ইরান পরিচালক অ্যালেক্স ভাটাঙ্কা বলেন, ইসরায়েলের হামলা একটি হিসাব করা ঝুঁকি হতে পারে। এর উদ্দেশ্য ইরানকে নতুন করে আলোচনায় বসতে বাধ্য করা। এই তত্ত্ব অনুসারে, ইসরায়েল ট্রাম্পকে সীমিত আকারে হামলার অনুমতি নিতে রাজি করায়, যাতে তেহরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায়। কিন্তু ইরানের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের কোনও বিষয় ছিল না। অর্থাৎ সামরিক চাপ ব্যবহার করে অচল কূটনৈতিক প্রক্রিয়াকে আবার চালু করার কথা ছিল।

শুক্রবার ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন, ইরানে হামলা হয়তো পারমাণবিক চুক্তির সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

কিন্তু ফ্ল্যাশপয়েন্ট নামের বৈশ্বিক নিরাপত্তা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা দপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা অ্যান্ড্রু বোরেন বলেন, “এই হামলার ফলে ইরান আলোচনায় ফিরবে— এমনটা খুব সম্ভব নয়। বরং এটি বিশ্বব্যাপী এক নতুন ধরণের হাইব্রিড শীতল যুদ্ধের আরেকটি বিস্ফোরণস্থল হিসেবে গড়ে উঠছে। আর এটি মাটিতে এবং সাইবার জগতের অন্ধকার কোণেও চলবে।”

এই কৌশল সফল হবে কি না, তা পুরোপুরি নির্ভর করছে ইরানের প্রতিক্রিয়ার ওপর। ইরান হয়তো আলোচনায় ফিরে আসতে পারে। আবার পুরোদমে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথেও এগোতে পারে। 

তবে প্রাথমিক লক্ষণ বলছে, তেহরান হয়তো আলোচনার পক্ষপাতী নয়— বিশেষ করে যেভাবে তাদের স্থাপনাগুলো বোমাবর্ষণে ধ্বংস হয়েছে এবং নেতারা নিহত হয়েছেন।

তবে এই ইতিবাচক ব্যাখ্যাগুলো সত্যিও হলেও একটি বড় বাস্তবতা বদলায় না— ট্রাম্প যে প্রতিটি বড় সংঘাত উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন বা যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলোর প্রতিটিই তার শাসনকালে আরও তীব্র হয়েছে।

ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি হবেন শান্তির দূত। বাস্তবে তিনি এখন একাধিক যুদ্ধ পরিচালনা করছেন এবং তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টাগুলো চোখের সামনে ভেঙে পড়ছে। গাজা থেকে ইউক্রেন, ইউক্রেন থেকে ইরান— বিশ্ব এখন আগের চেয়ে আরও অনিরাপদ ও অস্থির হয়ে উঠেছে। অথচ তিনি মাত্র পাঁচ মাস আগে শপথ নিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত