নির্বাচনী প্রচার চালাতে চাই বিপুল পরিমাণ অর্থ। ধনকুবের ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেলায়ও তাই। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন।
এত টাকা কোথায় পাবেন, এনিয়ে চলছিল জল্পনা কল্পনা। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে যে টাকা সংগ্রহ করবেন, সেই রাস্তাও তার জন্য সংকুচিত। কারণ আয়কর থেকে শুরু করে একাধিক বিভাগ তার ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি করছে। তিল থেকে তাল হলেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার সাধ ঘুচে যাবে তার।
ট্রাম্প তাই এবার ব্যবসায়িক বুদ্ধি খাটিয়ে অর্থ সংগ্রহে ছোট কোম্পানি নিয়ে খেলছেন বড় বাজি। ১৯৯৫ সালের পর নিজের আরও একটি প্রতিষ্ঠানকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসাবে গঠন করলেন তিনি।
কোম্পানিটির আগের নাম ছিল ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড অ্যাকুইজিশন করপোরেশন (ডিডব্লিউএসি)। এটি মূলত একটি শেল কোম্পানি। পাবলিক লিমিটেড করার জন্য নামকরণ করা হয় ট্রাম্প মিডিয়া নামে।
ট্রাম্প মিডিয়ার অধীন একটি ছোট প্রতিষ্ঠান ট্রুথ সোশাল। এটি একটি সোশাল মিডিয়া প্লাটফর্ম। মঙ্গলবার ‘ডিজেটি’ প্রতীকের আওতায় কোম্পানিটির শেয়ার ছাড়া হয় বাজারে।
শেয়ারবাজার খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রুথ সোশালের দাম ৫৬ শতাংশ বেড়ে ৭৮ ডলারে পৌঁছায়। মানুষ হুমড়ি খেয়ে কিনতে শুরু করে শেয়ার। শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। তাতে টনক নড়ে ওয়াল স্ট্রিটের। এক পর্যায়ে কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি বন্ধ রাখতে হয়।
দিনের শুরুতে শেয়ারের দাম ৭০ ডলারে অনেকটা সময় আটকে ছিল। কিন্তু বাজারের লেনদেন শেষ হওয়ার আগে দাম ৫৭ দশমিক ৯৯ ডলারে পৌঁছায়।
এই ঘটনায় ট্রাম্প মিডিয়ার মূল্য ১১ বিলিয়ন ডলার ছোঁয়ায় ওয়াল স্ট্রিটে বেশ উত্তেজনা চলছে। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এই মূল্য বাস্তবতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ, বিপর্যয় হতে পারে যে কোনও মুহূর্তে।
বছর জুড়ে ডিডব্লিউএসি এর শেয়ারের মূল্য ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছিল। এর মধ্যে গত সোমবার এক ধাক্কায় বাড়ে ৩৫ শতাংশ।
তবে ট্রাম্প মিডিয়ার শেয়ারের মূল্য যখন বাড়ছে, তখন কিন্তু ট্রুথ সোশালের ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমছে। এসব প্লাটফর্মের উর্দ্ধগতি ও আর্থিক উন্নতি নির্ভর করে ব্যবহারকারী ও বিজ্ঞাপনের ওপর।
ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার ওয়ারিংটন কলেজ অব বিজনেসের অর্থায়নবিষয়ক অধ্যাপক জে রিটারের মতে, “এটি একটি বিরল ঘটনা। শেয়ারের মূল্য তার মৌলিক ভিত্তি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।”
রিটার বলেন, “ট্রাম্প মিডিয়ার নিকটতম অবস্থানে আছে গেমস্টপ, এএমসি ও অন্য তথাকথিত মেমে স্টক। এগুলো কভিড-১৯ এর সময় খুচরা ব্যবসায়িদের একটি বাহিনী হিসাবে আকাশচুম্বী হয়েছিল।” ট্রাম্প মিডিয়ার শেয়ার প্রতি মূল্য সম্ভবত ২ ডলারের কাছাকাছি। কিন্তু এখন এটি হয়েছে ৫৮ ডলার।
আর্থিক রিপোর্ট অনুসারে, ট্রাম্প মিডিয়া গত বছরের প্রথম নয় মাসে মাত্র ৩৪ লাখ ডলার আয় করেছে। কোম্পানিটি এই সময়ে হারিয়েছে ৪৯ মিলিয়ন ডলার। তবুও বাজারে ট্রাম্প মিডিয়ার মূল্য এখন প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার।
ট্রাম্প মিডিয়ার চেয়ে ১৬০ গুন বেশি আয় করেও রেডিটের (সোশাল মিডিয়া) গত সপ্তাহের মূল্য ছিল ৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে রেডিট আয় করেছিল ৮০৪ মিলিয়ন ডলার। আর একই বছরে ট্রাম্প মিডিয়ার আয় ছিল মাত্র ৫ মিলিয়ন ডলার।
ট্রুথ সোশ্যালকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গত ফেব্রুয়ারিতে আইফোন ও অ্যান্ড্রয়েড মিলিয়ে ট্রুথ সোশালের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৯৪ হাজার।
ওদিকে অন্য দুই সোশাল মিডিয়া এক্সের ছিল ৭৫ ও ফেইসবুকের ১৪২ মিলিয়ন ব্যবহারকারী। এমনকি নতুন সোশাল মিডিয়া থ্রেডেও গত ফেব্রুয়ারিতে ট্রুথ সোশালের চেয়ে দশগুন বেশি ব্যবহারকারী ছিল।
ট্রুথ সোশাল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমশ কমছে। গত ফেব্রুয়ারিতে কমেছে ৫১ শতাংশ। গত বছর ওয়েবসাইটটিতে ভিজিটরের সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৪৮ হাজার। এমনটা হওয়ার কারণ বলা হচ্ছে, ওয়েবসাইটটিতে বিজ্ঞাপনের রেট কম থাকাকে।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমা সত্ত্বেও ট্রুথ সোশালের শেয়ারের মূল্য বাড়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলো এটিকে কিনে নিতে পারে, এমন সম্ভাবনা রয়েছে।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক জোনাথন ম্যাকি ট্রাম্প মিডিয়ার শেয়ারের দামকে ‘বুদবুদের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার মতে, এই বুদবুদ একদিন ফেটে যাবে, তবে সেটা কখন তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
তবে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অহলর্গে বলেন, “এমন শেয়ার আমরা অতীতেও দেখেছি। অনেক সময় এমন মেমে শেয়ার আবার স্বাভাবিক দামে ফিরে এসে বাজারে টিকেও যায়। বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে, এই শেয়ার খুব বেশি স্ফীত দামে থাকতে পারে। কারণ এর প্রতি ট্রাম্পের সমর্থকদের নজর আছে।”
ট্রাম্পের শুধু সুনামের ঘাটতি রয়েছে তাই নয়, তার কোম্পানিগুলোর দেউলিয়া হওয়ারও ইতিহাস রয়েছে।
১৯৯৫ সালে ট্রাম্প হোটেল অ্যান্ড ক্যাসিনো রিসোর্টসকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করা হয়েছিল। তখনও একই ‘ডিজেটি’ প্রতীক ব্যবহার করে শেয়ার বিক্রি করা হয়। ওই কোম্পানি ২০০৪ সালে দেউলিয়া হয় এবং নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকা থেকে এর নাম সরিয়ে ফেলা হয়।
ট্রাম্প মিডিয়াও একই ধারাবাহিকতার ইতিহাস তৈরি করতে পারে, এমন শঙ্কা অনেকের।
তবে সবকিছু নির্ভর করছে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের উপর। বাইডেনকে হারিয়ে ট্রাম্প যদি ক্ষমতায় যেতে পারেন, সেক্ষেত্রে ট্রুথ সোশালই হয়ে উঠবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। আর তখন স্বাভাবিকভাবেই শেয়ারবাজারেও ভালো করবে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি বর্তমানের চেয়েও আরও বেশি হতে পারে ট্রাম্প মিডিয়ার শেয়ারের দাম, এমন শঙ্কাও অনেকের।
তথ্যসূত্র : সিএনএন