Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪

ট্রাম্পের ‘টু আই’ এজেন্ডা বাস্তবায়ন হলে বিশ্বের সব দেশেই ঝাঁকুনি লাগবে

এম হুমায়ুন কবির

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি ইনফ্লেশান মোকাবেলায় তাঁর ইকোনমিক প্ল্যান এবং ইমিগ্রেশন নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেন তাহলে সারা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কমবেশি ঝাঁকুনি লাগবে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিজি ও নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন এম হুমায়ুন কবির। কাজ করেছেন জাতিসংঘে। এখন তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনীরুদ্দিন

ট্রাম্পের ‘টু আই’ এজেন্ডা বাস্তবায়ন হলে বিশ্বের সব দেশেই ঝাঁকুনি লাগবে

এম হুমায়ুন কবির

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি ইনফ্লেশান মোকাবেলায় তাঁর ইকোনমিক প্ল্যান এবং ইমিগ্রেশন নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেন তাহলে সারা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কমবেশি ঝাঁকুনি লাগবে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিজি ও নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন এম হুমায়ুন কবির। কাজ করেছেন জাতিসংঘে। এখন তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনীরুদ্দিন

সকাল সন্ধ্যা: যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বিশাল বিজয় পেয়ে আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও নির্বাচনের সময়ও বলা হচ্ছিল যে এবার ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান শিবিরের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল অভূতপূর্ব জয় পেয়েছেন ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের এই বিশাল বিজয়ের পেছনে কোন কারণগুলো সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে বলে আপনি মনে করেন?

এম হুমায়ুন কবির: আপনি ঠিকই বলেছেন যে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার এক অসাধারণ বিজয় পেয়েছেন। এটা সত্যি যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা পর্বে যেরকম ধারণা পাওয়া গিয়েছিল সে তুলনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক ভালো ফলাফল পেয়েছেন। এখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়-ই বলি কিংবা কমলা হ্যারিসের পরাজয় এর পেছনে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

প্রথমত, কোভিড মহামারীতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু এবং মহামারীকালে সমাজে সর্বব্যাপী যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছিল এর মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশেই মানুষ প্রচলিত শাসনব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। মানুষ মনে করতে শুরু করে যে, এই ব্যবস্থা এই আমাদের চাহিদার বিপরীতে যথেষ্ঠ নয়, এটা বদলাতে হবে। সে কারণে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কোভিড পরবর্তী সময়ে নানা দেশে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে সেখানে ক্ষমতাসীনরা পরাজিত হয়েছে এবং বিরোধী নেতারা জয়ী হয়েছেন। তাই অন্য অনেকের মতো আমারও ধারণা ট্রাম্পের এই বিজয়ও কোভিড-উত্তর সময়ের অনিশ্চয়তারই ধারাবাহিকতা।

কোভিডের সময় থেকেই বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির যে উল্লম্ফন যা কোভিডের সঙ্গে সম্পর্কিত সেটাও বিভিন্ন দেশে মানুষের জীবনযাপনের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছে। ২০২০ সালে জো বাইডেন যখন বিজয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসলেন তখন ধারণা করা হয়েছিল তিনি কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে অন্তত মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে দ্রব্যমূল্য কমাতে পারবেন। কিন্তু অনেক বড় বড় উদ্যোগ নিলেও বাইডেন প্রশাসন মুদ্রাস্ফীতি কমাতে পারেননি। আমার ধারণা এই পরিস্থিতি একটা বৈশ্বিক চেইনের অংশ হওয়ার কারণেই বাইডেন এখানে সফলতা দেখাতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রে যে কথাটা প্রচলিত আছে, যা অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও সত্য যে— ‘‘জনগণ পকেট দেখে ভোট দেয়।”

প্রথম ‘আই’, অর্থাৎ—‘ইনফ্লেশান’ আর দ্বিতীয় ‘আই’ হলো—‘ইমিগ্রেশান’। এই দুই ‘আই’-ই এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।

ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের একটা বড় অংশই ভেবেছে, কোভিডের পর আমরা বাইডেনকে ভোট দিলাম যে তিনি আমাদের অর্থনৈতিক দুর্দশার রাশ টানবেন, কিন্তু তিনি তো সেটা পারলেন না। এর ফলে, ডেমোক্র্যাট দলের প্রথাগত যে ভোট ব্যংকগুলো রয়েছে যেমন শ্রমিক, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং বিভিন্ন অভিবাসীগোষ্ঠীগুলো বিশেষত আফ্রিকান-আমেরিকান বা কালোরা, এদের মধ্যেও বিভক্তি দেখা গেছে এবং অনেকেই ডেমোক্র্যাটদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। যে কারণে ল্যাতিন আমেরিকান বা হিস্পানিক গোষ্ঠী, আফ্রিকান-আমেরিকান এবং শ্রমিকদের মতো ডেমোক্র্যাটদের সমর্থনের ভিত্তি গ্রুপগুলোর মানুষেরাও পার্টির আন্দাজের বাইরে গিয়ে অনেকেই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন।

এতক্ষণ যে কথা বললাম সেটা হলো প্রথম ‘আই’, অর্থাৎ—‘ইনফ্লেশান’ আর দ্বিতীয় ‘আই’ হলো—‘ইমিগ্রেশান’। এই দুই ‘আই’-ই এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সারা পৃথিবী থেকেই বিপুল সংখ্যক মানুষ অভিবাসী হয়, হচ্ছে, এটা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। গত চার-পাঁচ বছরেও আমরা টেলিভিশনে দেখেছি, প্রচুর পরিমাণে ল্যাতিন আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকছে এবং বাইডেন প্রশাসন তাদেরকে নানাভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছে। নতুন যারা অভিবাসী তারা বিভিন্ন শহরে গিয়ে প্রাথমিকভাবে আশ্রয় নেয়, যে শহরগুলো ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতৃত্বে আছে, যেমন নিউ ইয়র্ক বা এমন আরও অনেক শহর। কিন্তু এর একটা প্রতিক্রিয়া আছে। সেটা হলো নেটিভ সিটিজেনরা এই অভিবাসীদের চাপে অনিরাপদ বোধ করে। আর এই সুযোগে অভিবাসনবিরোধী ট্রাম্প প্রচারণা চালালেন যে, তোমাদের এই অনিরাপত্তার প্রধান কারণ হলো অভিবাসীরা, তারা খুন-খারাবি করছে, আর তাদের কারণেই তোমাদের কাজ কমছে, তাদের কারণেই তোমাদের অর্থনৈতিক দুর্দশা তৈরি হচ্ছে। কাজেই তোমরা আমাকে ভোট দাও— আমি অভিবাসন বন্ধ করে দেব, অবৈধ অভিবাসীদের বের করে দেব, তখন তোমরা কাজ পাবে আর তোমরা নিরাপদ থাকবে। ট্রাম্প এখানে যে কাজটা করলেন সেটা হলো, তিনি অভিবাসনের সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টাও যুক্ত করে দিলেন। ট্রাম্পের এই কৌশলেই কিন্তু কাজ হলো। এই কার্ড খেলেই তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডেমোক্র্যাটদের সমর্থনের ভিত্তি গ্রুপগুলোর মানুষদের বিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারলেন, তাদের ভোট টানতে পারলেন।

ট্রাম্প খুব সিম্প্লিস্টিক্যালি বলেছেন,‘‘আই উইল সল্ভ এভরি প্রবলেম।’’ যদিও তিনি সেটা পারবেন কিনা সেটা অন্য বিষয়। তবে, তিনি মার্কিনিদের মধ্যে এই ধারণা সঞ্চার করতে পেরেছেন যে ট্রাম্প আমাদের সব সমস্যার সমাধান করতে পারবেন!

সকাল সন্ধ্যা: আপনিও বললেন যে ডোনাল্ড ট্রাম্প অসাধারণ বিজয় পেয়েছেন। বিজয়টা আসলে কী রকম? নির্বাচনী ফলের বিশ্লেষণে আমরা আসলে কী দেখতে পাচ্ছি? ট্রাম্প আসলে কতটা শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসছেন হোয়াইট হাউসে? 

এম হুমায়ুন কবির: দেখা যাচ্ছে ট্রাম্প যে কেবল পপুলার ভোটই বেশি পেয়েছেন তা নয়, ট্রাম্প ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটও বেশি পেয়েছেন। ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটে তিনি অসাধারণ ফল পেয়েছেন। যেখানে ২৭০টি ভোট প্রয়োজন সেখানে তিনি পেয়েছেন ৩১২টা ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট। ট্রাম্পের হাত ধরে এবার সিনেট রিপাবলিকান পার্টির কাছে চলে গেছে। শুধু সিনেটেই নয়, হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদও রিপাবলিকান পার্টির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা বা কংগ্রেস এবং প্রেসিডেন্সি দুটোই খুব কম সময়ই একই দলের নিয়ন্ত্রণে আসে। এর অর্থ হলো, ট্রাম্প যা করতে চাইবেন তাতেই তিনি কংগ্রেসের সমর্থন পাবেন, এক্ষেত্রে প্র্যাকটিক্যালি আর কোনও বাধা থাকল না। এরপর গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা সেটা হলো বিচার বিভাগ। সুপ্রিম কোর্টেও এখন ট্রাম্প মনোনীত তিনজনসহ বলতে গেলে পুরো কোর্টটাই এখন রিপাবলিকান কোর্ট হয়ে গেছে।

ইনফ্লেশান মোকাবেলায় ট্রাম্পের ইকোনমিক প্ল্যান এবং ইমিগ্রেশন নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা যদি তিনি বাস্তবায়ন শুরু করেন তাহলে সারা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কমবেশি ঝাঁকুনি লাগবে।

একদিকে কংগ্রেসের সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ বা দুই কক্ষেই একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ, বিচার বিভাগে সমর্থন এসব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানগত বিবেচনায় যেমন ট্রাম্প অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন তার পাশাপাশি আমাদেরকে আসলে ব্যক্তি হিসেবেও ট্রাম্পের শক্তিমত্তার কথাও বিবেচনা করা দরকার। কারণ তিনি যে ধরনের লোক, তার যে চিন্তা-ভাবনা সেগুলোকে এখন তিনি কীভাবে কতটা কাজে লাগাবেন কী করবেন সেটা আসলেই দেখার বিষয়। ইতিমধ্যেই যারা মার্কিনিদের বন্ধুদেশ, দীর্ঘদিনের মিত্র তারা যেমন চিন্তিত তেমনি যারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ তারাও চিন্তিত। যারা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ তারাও চিন্তিত। কারণ একটাই, ট্রাম্পর আসলে কী করবেন!

ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ‘টু আই’ এজেন্ডা নিয়ে বিজয়ী হয়ে এসেছেন, অর্থাৎ ইনফ্লেশান মোকাবেলায় ট্রাম্পের ইকোনমিক প্ল্যান এবং ইমিগ্রেশন নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা যদি তিনি বাস্তবায়ন শুরু করেন তাহলে সারা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কমবেশি ঝাঁকুনি লাগবে।

সকাল সন্ধ্যা: আগের চেয়েশক্তিশালী এইডোনান্ডট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিতে তাঁর বিদেশ নীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করেন? বিশেষত ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা কেমন হতে পারে?  

এম হুমায়ুন কবির: বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্য দুটো যুদ্ধই তিনি থামানোর চেষ্টা করবেন। ইউক্রেন যুদ্ধ হয়ত তিনি থামাতে পারবেন বলে আশা করা যায়। প্রশ্ন হলো যে কী শর্তে সেটা হবে? সেটা কি এখন যে পর্যন্ত দখল করা হয়েছে সেই স্ট্যাটাস-কো বজায় রেখে? নাকি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে ইউক্রেন-রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা টেকসই সমাধানের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ অবস্থায় হবে? আর মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরেকটু জটিল। কারণ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর এখন যে পরিকল্পনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের হবু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরিকল্পনার মধ্যে চমৎকার সাজুয্য আছে। তাঁরা দুজনেই মনে করেন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল প্রধান শক্তি হিসেবে থাকুক এবং তাঁরা দুজনেই ইরানকে তাঁদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেন। সেখানে এখন যা দেখা যাচ্ছে যে, হামাসকে দুর্বল করা হয়েছে এবং হিজবুল্লাহকেও অনেকটা দুর্বল করা হয়েছে তাই নেতানিয়াহু এখন ইরানকে টার্গেট করতে পারবে। নেতানিয়াহু অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছেন ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পগুলোকে ধ্বংস করার জন্য। সেটা তিনি একা করতে পারবেন না সেজন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন চেয়ে আসছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এতদিন পর্যন্ত সে সমর্থন দেয়নি এবং জো বাইডেন ইসরায়েলকে বলেছেনও যে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে তোমরা হামলা করবে না। এখন ট্রাম্প যদি ইসরায়েলের ওই পরিকল্পনায় সায় দিয়ে দেন তাহলে ইরানের জন্য তো বটেই পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই একটা বেকায়দা অবস্থা তৈরি হতে পারে। কারণ ইরান দুর্বল হয়ে গেলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই ইসরায়েলের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

সকাল সন্ধ্যা: ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে নির্বাচনের আগে। তাঁর অন্যতম নির্বাচনী এজেন্ডা ছিল অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করা এবং অবৈধ অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়া। এখন তিনি যদি সত্যিই সে পথে এগুতে চান সেটার প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে। এ বিষয়টা কি একটু ব্যাখ্য করবেন?

এম হুমায়ুন কবির: ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির প্রভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যেমন পড়বে তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অন্য দেশগুলোতেও এর প্রভাব পড়বে। তিনি বলেছেন বেআইনি অভিবাসীদের বের করে দেওয়া হবে। খেয়াল করা দরকার যুক্তরাষ্ট্রে বেআইনি অভিবাসীর সংখ্যা ১৩ থেকে ২০ মিলিয়ন, অর্থাৎ সোয়া কোটি থেকে দুই কোটির মতো বলে মনে করা হয়। প্রশ্ন হলো এই অভিবাসীরা তো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। শারীরিক পরিশ্রমের যেসব কাজ সেসব কাজ কিন্তু এই অভিবাসী শ্রমিকরাই করে। কাজেই প্রথম কথা হলো, এই অভিবাসীদের সত্যিই বের করে দিলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে এর প্রভাব কতটা মারাত্মক হবে সেটা আমরা এখনও জানিনা। আবার যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে কেননা এই অভিবাসীরা পৃথিবীর প্রায় ১৭০টা দেশ থেকে এসেছেন। যেখানে আমাদের বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষেরা যেমন আছেন তেমনি দুনিয়ার নানা প্রান্তের অন্যান্য দেশের মানুষেরাও আছেন। এটা স্পষ্ট যে এমন হলে বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

তিনি ‘চেইন মাইগ্রেশন’ বন্ধ করে দেবেন। বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসীদের মধ্যে এটা খুবই চালু আছে। অর্থাৎ একজন যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাসের অনুমতি পাওয়ার পর পর্যায়ক্রমে তারা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান। এটা বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর অভিবাসীরা খুবই বিপদে পড়বেন।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি সেটা হলো, ট্রাম্প ইমিগ্রেশনের পদ্ধতিগত সংস্কার করতে চাইছেন। আমরা জানি এখন কোনও শিশু যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করলেই জন্মসূত্রে শিশুটি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে যায়। কিন্তু ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন তিনি এই নিয়ম বাতিল করে দেবেন, যে শিশুদের বাবা-মা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক কেবল তারাই এভাবে নাগরিক হতে পারবে। শুধু এই এক নিয়ম বদলালেই যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ পরিবার বেকায়দায় পড়ে যাবে। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রে সন্তান জন্ম দিয়ে ওই শিশুর অভিভাবক হিসেবে ১৮ বছর পর্যন্ত তার দেখভালের জন্য শিশুর মা-বাবা যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাসের অনুমতি পায়।

তৃতীয় বিষয়টি হলো— তিনি ‘চেইন মাইগ্রেশন’ বন্ধ করে দেবেন। বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসীদের মধ্যে এটা খুবই চালু আছে। অর্থাৎ একজন যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাসের অনুমতি পাওয়ার পর পর্যায়ক্রমে তারা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান। এটা বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর অভিবাসীরা খুবই বিপদে পড়বেন।

অভিবাসনের ক্ষেত্রে চতুর্থ এবং খুবই জটিল একটি বিষয় হলো ‘মিক্সড ফ্যামিলি’ ইস্যু। বিষয়টা এরকম যে ধরুন স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে একজন বৈধ অভিবাসী আরেকজন এখনও বৈধতা পাননি, আবার শিশুটি বৈধভাবে কিন্তু বাবা-মা অবৈধভাব আছেন। এরকম পরিবারগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন এক্সপার্টরা মিক্সড ফ্যামিলি বলে অভিহিত করেছেন। এই মিক্সড ফ্যামিলির মাইগ্রেশন স্ট্যাটাস নিরসন করা খুবই জটিল। ফলে এই ধরনের অভিবাসন জটিলতা রাতারাতি পাল্টানো যাবে না, এটা সমাধান করতে অনেক বছর লেগে যেতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন যুক্তরাষ্ট্রে এমন প্রায় চার থেকে ছয় বিলিয়ন মানুষ আছে যারা এমন মিক্সড ফ্যামিলির। ট্রাম্প ভাবছেন তারা প্রতিবছর প্রায় ১ মিলিয়ন লোককে দেশ থেকে বের করে দেবেন। এবং এই কাজটা করতে ১০০ বিলিয়ন ডলার খরচের ব্যাপার আছে। যদিও ট্রাম্প বলছেন যে টাকা-পয়সা কোনও ব্যাপার না। যেহেতু কংগ্রেস তাঁর হাতে আছে তাই সেটা সমস্যা নাও হতে পারে। কিন্তু ট্রাম্প এমন অভিবাসন নীতি বাস্তবায়ন শুরু করলে বিশ্বের বহু দেশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সারা বিশ্বেই এর একটা ক্যাওটিক প্রভাব পড়তে পারে।

সকাল সন্ধ্যা: এবার বাংলাদেশ আর দক্ষিণ এশিয়া প্রসঙ্গে আসি। আপনি নির্বাচনের প্রাক্কালে সকাল সন্ধ্যাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস জয়ী হলে বাংলাদেশে ড. ইউনূসের সরকার কমলা প্রশাসনের কাছ থেকে ইতিবাচক সুবিধা আদায় করতে পারবেন। কিন্তু জয়ী হলেন ট্রাম্প। অন্যদিকে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের লোকজনদের একটা প্রচার দেখা গেছে যে ট্রাম্প বিজয়ী হলে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পাল্টে যাবে। এছাড়া নির্বাচনের ঠিক আগে আগে ট্রাম্প এক বক্তব্যে বাংলাদেশ ও ভারত বিষয়ে সরাসরি কথাও বলেছেন। এসব বিষয়ে এখন আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।

এম হুমায়ুন কবির: প্রথম কথা হলো, আমি মনে করি না যে ট্রাম্পের বিজয়ের কারণেই বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি রাতারাতি পাল্টে যাবে। এক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আসতেই পারে। কিন্তু সেটা তাদের বিদেশনীতির মৌলিক কোনও পরিবর্তন না।

আর ট্রাম্পের বিজয়ের ফলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াসহ অনেকগুলো দেশই দুই তিনটা বিষয়ে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। এক নম্বর, তিনি বলছেন যুক্তরাষ্ট্র সারা পৃথিবী থেকে যেসব পণ্য আমদানি করে সেই সব ক্ষেত্রে তিনি ১০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসাবেন। যেটাকে ট্রাম্প ট্যারিফ বলা হচ্ছে। যদি তা-ই হয় তাহলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ভারত ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এমনকি চীনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ট্রাম্প বলছেন চীনের ক্ষেত্রে তিনি ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ ট্যারিফ বসাবেন। চীন আমেরিকায় প্রায় পৌনে সাতশ ডলার বিলিয়ন রপ্তানি করে। ফলে ট্রাম্প ট্যারিফ আরোপ করা হলে প্রায় সব দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদির সঙ্গে বন্ধুত্বের টুইট দিয়ে কিন্তু এসব বিষয় সামাল দেওয়া যাবে না। ভারতীয়রা ইতিমধ্যেই ট্রাম্পের অভিবাসন ও ট্যারিফ নীতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। দুই নম্বর বিষয় হলো, এইচ-ওয়ান-বি ভিসা। বিশেষ করে ভারতের বিপুল সংখ্যক অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রের এইচ-ওয়ান-বি ভিসায় সেখানে কাজ করছেন, যারা দক্ষ জনশক্তি হিসেবে সেদেশে যাচ্ছেন। উচ্চশিক্ষিত ভারতীয়রা বেশি আয়ের চাকরিতে এই ভিসায় কাজ করেন। এখন এই ভিসা বন্ধ হয়ে গেলে কী হবে তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সকাল সন্ধ্যা: ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিবাচনী প্রচারের অন্যতম স্লোগান ছিল— ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’। বলা হচ্ছে, ট্রাম্প সারা পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তারের বদলে নিজের দেশের দিকে মুখ ফেরাতে চান। এদিকে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে অন্যান্য পরাশক্তি দেশগুলো নানাভাবে জোটবদ্ধ হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, ট্রাম্পের এই ‘গ্রেট আমেরিকা’ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কতটা বাস্তবসম্মত? ট্রাম্প এই কাজে কতটা সফল হবেন বা তাঁর এই প্রচেষ্টার প্রভাব কেমন হতে পারে?   

এম হুমায়ুন কবির: ট্রাম্প নিজেই বারবার বলছেন, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’। তিনি নিজেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই অন্তর্মুখী নীতি গ্রহণ করতে চাচ্ছেন। যদি তা-ই হয়, তাহলে যে বিশ্বে আমরা এখন ক্ষমতার ভারসাম্যে রদবদল দেখছি, যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়ার বিপরীতে অন্যান্য পরাশক্তিগুলোর মধ্যে ক্ষমতা যাচ্ছে, সেরকম একটা বিশ্বে আমেরিকা যদি নিজেই নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বাকি শক্তিগুলোর আরও উত্থান ঘটবে। কারণ প্রকৃতিতে কোনও কিছুই ফাঁকা থাকে না। একজনের প্রভাব হ্রাস পেলে অন্যদের প্রভাব বাড়বে। রাশিয়া, চীন বা ভারতের মতো দেশগুলো তখন নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ আছে তার বিপরীতে ‘অল্টারনেটিভ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’-এর বিকাশের গতি হয়ত দ্রুততর হবে। যদি এমনটা ঘটতে থাকে তাহলে ট্রাম্পের আমেরিকা হয়ত আরও শক্তিশালী হওয়ার পরিবর্তে আরও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এই আশঙ্কা কিন্তু অনেকেই করছেন।

সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
এম হুমায়ুন কবির: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত