আন্দোলনে মুখর হয়ে উঠেছেন দেশের টেলিভিশন, ইউটিউব ও ওটিটি প্লাটফর্মের অভিনয়শিল্পীদের একটি অংশ। নিজ পেশার সুরক্ষা ও সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রতি অভিনয়শিল্পী সংঘের নৈতিক অবস্থান সুস্পষ্ট করার দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা।
তাদের দাবি, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সূত্র ধরে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে সংগঠনটির বেশ কয়েকজন সদস্য ও নেতা। যার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হচ্ছে পুরো অভিনয়শিল্পী সমাজকে।
এই প্রেক্ষাপটে শনিবার ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পী সমাজ’-এর ব্যানারে রাজধানীর নিকেতনের গ্রাউন্ড জিরোতে সমবেত হয় ৪৭ জন শিল্পী।
প্রশ্নবিদ্ধ সদস্যদের জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়ে সংগঠনের নেতাদের কাছেও এর জবাব চান। সংগঠন সংস্কার ও পেশার সুরক্ষায় বেশকিছু দাবিও তুলে ধরা হয়। আলোচনায় বসে বিষয়গুলো সুরাহার আহবান জানানো হয়। শুধু তাই নয়, ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে বর্তমান কমিটিকে পদত্যাগের আলটিমেটামও ছুড়ে দেয়া হয়।
তাদের দাবির বিপরীতে আন্দোলনকারীরা ‘সদস্য নয়’ বলে আলোচনায় বসার তেমন কোন আগ্রহ দেখা যায়নি অভিনয় শিল্পী সংঘের নেতাদের মধ্যে। এমনকি আলটিমেটামে বেঁধে দেওয়া দিনটি ফুরিয়ে এলেও আসেনি কোন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য।
মঙ্গলবার সকাল সন্ধ্যাকে সংগঠনের সভাপতি আহসান হাবিব নাসিম জানান, অভিনয় শিল্পীদের দাবির প্রতি ‘শ্রদ্ধা’ জানিয়েই ২৮ সেপ্টেম্বর বিশেষ সাধারণ সভা ডেকেছেন তারা। কিন্তু তাতে বিক্ষুব্ধ শিল্পীদের কোন আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানানো কিংবা তাদের সাথে কোন যোগাযোগ করা হয়নি বলেও জানান তিনি।
এর আগে বিকেল, বিক্ষুব্ধ শিল্পীরা রাজধানীর রবীন্দ্র সরোবরে নিজেদের দাবিদাওয়া পুনরায় তুলে ধরতে ‘কথা বলতে চাই, শুনতে চাই’ স্লোগান নিয়ে সমবেত হন।
এ সময় আন্দোলনকারীদের মধ্যে অন্যতম অভিনেতা খায়রুল বাসারের বক্তব্যে ফুটে ওঠে তাদের ক্ষোভের অন্যতম কারণটি।
তিনি বলেন, “বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলা হয়েছে তা নজিরবিহীন। জুলাই-আগস্ট মাসে ৬ শতাধিক প্রাণ ঝরেছে। এই আন্দোলনে স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষ নিয়ে আমাদের শিল্পীদের সংগঠন অভিনয়শিল্পী সংঘের কিছু নেতা ও সদস্য ‘আলো আসবেই’গ্রুপ খুলেছিলেন। এখন আমরা রাস্তা দিয়ে চলতে গেলে বন্ধুরা ‘আলো আসবেই’ বলে আমাদের অপমান করে।
“সরকার পতনের পর পুরো দেশে যখন সংস্কার চলছে তখন আমরা আমাদের শিল্পীদের সংগঠন অভিনয়শিল্পী সংঘের সংস্কার চেয়েছি। আমরা তাদের সঙ্গে বসতে চেয়েছি। কিন্তু শিল্পী-অশিল্পী দোহাই দিয়ে তারা আমাদের সঙ্গে যে আচরণ করেছেন তা শিল্পীসুলভ বলে আমরা মনে করি না। তাই তাদের সসম্মানে বিদায় নেওয়া উচিত।”
অভিনেত্রী নাজিয়া হক অর্ষা বলেন, “আমাদের সংগঠনের কিছু শিল্পী-নেতাদের কারণে আজ আমরা জনগণের প্রশ্নের মুখে পড়েছি। আপনারা যদি আমাদের সঙ্গে না বসেন, তবে এতোদিন আপনারা যা করেছেন সেগুলোর উত্তর আপনাদের দিতেই হবে।”
অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন তার বক্তব্যে বলেন, “আমরা এই মিডিয়াটাকে যেভাবে দেখতে চাই, সেভাবে দেখাতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। খুবই সম্মানের সঙ্গে বলছি, আপনারা ক্ষমা চান। জায়গাটা (পদ) ছেড়ে দেখেন। আপনারা খুব একটা দুঃখ পাবেন না, মন খারাপ করার মতো কিছু ঘটবে না। বিশ্বাস করেন।”
অর্ধশতাধিক শিল্পীদের উপস্থিতিতে এই আয়োজনে আরও বক্তব্য রাখেন শ্যামল মাওলা, মনোজ প্রামাণিক, সাবেরী আলম, সোহেল মন্ডল, মোস্তাাফিজুর নূর ইমরান, ইমতিয়াজ বর্ষণ, সমাপ্তি মাসুক, এলিনা শাম্মি, নির্মাতা ইমেল হকসহ অনেকেই। বক্তব্যে সংগঠনের কাছে বেশ কিছু দাবিও উপস্থাপন করেন শিল্পীরা।
এ সকল দাবি ও আলটিমেটামামের ব্যাপারে সকাল সন্ধ্যাকে অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি নাসিম জানান, কেবল ২৮ সেপ্টেম্বরের বিশেষ সাধারণ সভাতেই এ সংকটের সুরাহা হতে পারে।
নাসিম বলেন, “বললেই তো সবকিছু হয়ে যায় না। অভিনয়শিল্পীদের আন্দোলনের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। আমাদের পদ ধরে রাখার প্রতি কোন বিশেষ আকর্ষণ নেই। কিন্তু যাই হবে সাংগঠনিক পদ্ধতিতেই হবে। সংগঠনের একটা গঠনতান্ত্রিক পদ্ধতি আছে, সাংগঠনিক নিয়ম আছে।
“আমাদের দেড় হাজার সদস্য আছেন। বিশেষ সাধারণ সভার জন্য অডিটোরিয়াম ভাড়া করতে হবে। আয়োজন আছে। সদস্যরা আসুক,আন্দোলকারী শিল্পীরাও আসুক। তাদের দাবি জানাক। তারপর প্রয়োজন হলে পদ ছেড়ে দিবো।”
পদত্যাগের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করব? তারা বলুক, সেটা তো বলছেন না। নিয়ম মেনেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারা তো অনেকে সদস্যই নন। সদস্য হোক, ফরম পূরণ করুক।”
বিক্ষুব্ধ শিল্পীদের সাথে যোগাযোগ করা বা বিশেষ সাধারণ সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কি না, জানতে চাইলে নাসিম বলেন, “আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যোগাযোগ করা হয়নি। তবে তা করা উচিৎ।”
সংস্কারকামী শিল্পীদের দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম-অভিনয়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে পেশা হিসেবে স্বীকৃত এবং অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যা যা পদক্ষেপ গ্রহণ, কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, নতুন করে রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম চালু, তিন ধরনের কোর্সের ভিত্তিতে ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনয়ের যাত্রা শুরু করা, প্রফেশনাল কার্ডের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা। রিফর্মেশন অ্যাক্ট চালু, অভিনয়শিল্পীদের কাজের সুষ্ঠু, নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও সম্মানজনক পরিবেশ নিশ্চিত করা, শিফট সিস্টেম, ওভারটাইম চার্জ, ডেট ক্যান্সেলশন চার্জ চালু করেত হেব। ন্যূনতম রেম্যুনারেশন নির্ধারণসহ ইত্যাদি।