আওয়ামী লীগ সরকার আমলে শুরু হওয়া পায়রা সমুদ্র বন্দরকে নদীর ঘাটের সঙ্গে তুলনা করলেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
তারা মনে করছেন, এই বন্দর সচল রাখতে বছরে ড্রেজিংয়ে যে অর্থ ব্যয় হবে তার চেয়ে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য উড়োজাহাজে করে কয়লা আনলে ব্যয় কম হবে।
রবিবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘পায়রা সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ (২য় সংশোধন)’ প্রকল্প নিয়ে আলোচনার সময় তারা এসব অভিমত ব্যক্ত করেন বলে সাংবাদিকদের জানান পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
বৈঠকে প্রকল্পটির ব্যয় ৯১১ কোটি টাকা বাড়িয়ে মোট ব্যয় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় চার হাজার কোটি টাকার বেশি বাড়ানো হয়। ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সংশোধনীতে সেই ব্যয় আরও বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।
বৈঠক শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানান, সম্প্রতি এই দুই উপদেষ্টা পায়রা বন্দর পরিদর্শন করেন। রবিবার একনেক বৈঠকে তারা পায়রা সমুদ্র বন্দরকে নদীর ঘাটের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তিনি জানান, কয়লা চালিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে এখনই ১৭০ মেগাওয়াট উৎপাদিত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এই কেন্দ্র থেকে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের।
অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনার সময় আমি বলেছিলাম- পানির গভীরতা না থাকায় এখানে জাহাজ আসতে পারে না। তাহলে হয়তো এটা নদী বন্দর হতে পারে। কিন্তু ফাওজুল কবির সাহেব এবং আমাদের বাণিজ্য উপদেষ্টা, যারা দেখে এসেছেন উনারা বললেন, এটা নদী বন্দরও না। এটা একটা ঘাট বলা যেতে পারে। ওইটার পানির ডেপথ (গভীরতা) ওই রকমই।”
এসময় পরিকল্পনা উপদেষ্টা পায়রা সমুদ্র বন্দর প্রকল্পকে দেশের অর্থনীতির জন্য বিষফোড়া হিসেবে অভিহিত করেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে একনেক সভায় পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের সংশোধনীসহ মোট ১৫টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়।
সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ের সময় পরিকল্পনা উপদেষ্টা আরও বলেন, “পায়রা বন্দরের অনেক বড় চ্যানেল। এই চ্যানেলে প্রতি বছর যদি ড্রেজিং করা না হয়, তাহলে সমুদ্র বন্দর দূরের কথা নৌযানে করে কয়লা আনতে হবে।”
“তখন আমাদের বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, তার থেকে আমরা বরং প্লেনে করে কয়লা আনি। এই ড্রেজারের যা খরচ প্রত্যেক বছর।”
তিনি বলেন, মাঝামাঝি সময়ে এসে এই প্রকল্প অর্থনীতির জন্য একটা বিষফোঁড়ার মতো প্রকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একনেক বৈঠকে পরিকল্পনা উপদেষ্টাকে প্রকল্পটি পরিদর্শনে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “প্রকল্পটির জন্য এখন কয়লা আনার জন্য যে জেটি সেগুলো সচল রাখা, রাস্তা করা এবং ড্রেজিং করার জন্যই সংশোধনী অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এগুলোর জন্য যদি অর্থ বরাদ্দ না দেয় তাহলে তো এই নদী বন্দরও চলবে না।”
তিনি জানান, প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়ার আগেই চিন্তা করা দরকার ছিল ওখানে আসলেও সমুদ্র বন্দর হয় কি না। প্রতি বছরে জ্রেডিং করে আমদানি করা কয়লা পরিবহন করলে তা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কতটা সুফল বয়ে আনবে- তা খতিয়ে দেখতে হবে। ক্ষতির পরিমাণ যদি বেশি হলে এই প্রকল্প রেখে লাভ হবে না।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা জানান, একনেক সভায় নতুন ও সংশোধনীসহ মোট ১৫টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে; ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ১৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা, প্রকল্প সহায়তা হিসেবে পাওয়া যাবে ৬ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা এবং বাকি ৪০৬ কোটি টাকার যোগান দেওয়া হবে সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে।
অনুমোদন পাওয়া অন্য প্রকল্পগুলো হচ্ছে-
>> চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদ্যমান রানওয়ে ও টেক্সিওয়ের শক্তি বৃদ্ধিকরণ (১ম সংশোধিত) প্রকল্প। ব্যয় বাড়ছে প্রায় ৮২ কোটি টাকা।
>> চট্টগ্রাম মহানগরীর কালুরঘাট এলাকায় পয়ঃশোধনাগার নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্প। ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা।
>> স্ট্রেংদেনিং ইনস্টিটিউশনস ফর ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ্যাডপটেড ওয়াটার রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ইন ঢাকা প্রকল্প। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
>> সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প ফেজ-৩ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প। এতে ব্যয় বাড়ছে প্রায় ৮ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা।
>> বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার নির্মাণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প। এতে ব্যয় বাড়ছে ৩৯৭ কোটি টাকা।
>> ‘ডিজিটাল কানেকটিভিটি শক্তিশালীকরণে সুইচিং ও ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন (৩য় সংশোধিত) প্রকল্প। এই প্রকল্পের ব্যয় বাড়েনি, মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত।
>> পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প (১ম সংশোধন) প্রকল্প। এতে ব্যয় বাড়ছে ১ হাজার ৭৬ কোটি টাকা।
>> রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ স্থাপন প্রকল্প। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ২৯৩ কোটি টাকা।
>> ঢাকা শহর সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প (২য় সংশোধিত) প্রকল্প। এ প্রকল্পে ব্যয় বাড়ছে ৫৩ কোটি টাকা।
>> সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিডিং কর্মসূচি প্রকল্প। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৪৫২ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
>> সারাদেশে অবস্থিত ক্ষতিগ্রস্ত খাদ্য গুদাম এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক অবকাঠামোর মেরামত ও সংস্কার প্রকল্প। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫৫ কোটি টাকা।
>> জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্থাপিত রেকর্ড রুমসমূহ সংস্কার ও মেরামত প্রকল্প। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৬৯ কোটি টাকা।
>> দুধ ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রুভেন বুল তৈরি প্রকল্প। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
>> রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভৌত সুরক্ষা ব্যবস্থা নির্মাণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প। এতে ব্যয় বাড়ছে ৭৭৫ কোটি টাকা।



