২০২২ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকার আদালত চত্বর থেকে গ্রেপ্তার দুই সঙ্গীকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় জঙ্গিরা। তারপর গড়িয়েছে দেড় বছর, সেই জঙ্গিদের গ্রেপ্তার তো করা যায়ইনি, মেলেনি কোনও সন্ধানও।
পলাতক জঙ্গিরা ছিলেন- জাগৃতী প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যামামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মঈনুল হাসান শামীম ও আবু সাদিক সোহেল। নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামে যুক্ত ছিলেন তারা।
জঙ্গি ছিনতাইয়ের সেই ঘটনায় কারও গাফিলতি ছিল কি না, তা বের করতে তদন্ত কমিটি করেছিল পুলিশ সদর দপ্তর। সেই কমিটি কিছু সুপারিশও দিয়েছিল। কিন্তু সেই সব সুপারিশ কাগজে-কলমেই থেকে গেছে, নেওয়া হয়নি বাস্তবায়নের কোনও উদ্যোগ।
জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে সেটাই প্রথম নয়। তার আগে ২০১৪ সালের দিকে ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশ ভ্যানে হামলা চালিয়ে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল।
শুধু জঙ্গি নয়, পুলিশ হেফাজত থেকে হ্যান্ডকাফসহ আসামিদের পালিয়ে যাওয়ার খবরও পাওয়া যায় প্রায়ই।
আসামি ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর দায় এড়াতে পারে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
যেভাবে ছিনতাই
দুই জঙ্গিকে ছিনতাইয়ের ঘটনাটি যখন ঘটেছিল, তখন তারা ছিলেন ঢাকার আদালতে কোর্ট পুলিশের হেফাজতে। কারাগার থেকে তাদের অন্য মামলায় আদালতে হাজির করা হয়েছিল। সেদিন এক জঙ্গির এক হাতে ছিল হ্যান্ডকাফ। তাদের সঙ্গে ছিল একজন কনস্টেবল।
আদালত প্রাঙ্গণে প্রকাশ্যে পুলিশের চোখে পেপার স্প্রে করে সঙ্গীদের মুক্ত করে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায় জঙ্গিরা।
মোটরসাইকেলে জঙ্গিদের পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আশপাশের সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল। কিন্তু তাদের আর সন্ধান মেলেনি।
একাধিক অভিযান, তবুও ব্যর্থ
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে একাধিক অভিযান পরিচালনার কথা জানালেও সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য দিতে পারেননি।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখন পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকাতে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হলেও দ্রুত গ্রেপ্তার করতে পারব বলে আশাবাদী।”
পলাতক জঙ্গিদের গ্রেপ্তার অভিযানে নেমে এখন পর্যন্ত ওই মামলায় ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানা গেছে পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করেছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
‘মাস্টারমাইন্ড’ ফারুক?
জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্তে পুলিশ সদর দপ্তরে গঠিত কমিটি প্রয়াত মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাবেক এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারকে এই কাজের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ফারুকের শ্যালক হলেন ছিনিয়ে নেওয়া জঙ্গি আবু সাদিক সোহেল।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, “তদন্তে তারা দুবাইয়ের একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর পেয়েছেন। ওই নম্বর ব্যবহার করেই কারাগারে সোহেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন ফারুক। সেই নম্বরে ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন তারা।”
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের দিন পুরান ঢাকার আদালত চত্বর রেকি করেছিলেন ফারুক। ঘটনার দিন শ্যালক সোহেলকে ছিনিয়ে নিতে আদালত চত্বরেও উপস্থিত ছিলেন।
ছিনতাই মিশন শেষে জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্যপ্রযুক্তিগত আলামত ফারুক তার ফোন থেকে মুছে ফেলেন বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা।
ঘটনার এক মাস পর ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর ওমর ফারুক তালুকদার ও তার স্ত্রী তানজিলাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারাসহ গ্রেপ্তার ১৫ জনের সবাই কারাগারে।
জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ২০ জনকে আসামি করে মামলা করেন আদালত পুলিশের পরিদর্শক জুলহাস উদ্দিন আকন্দ। সেই মামলাটি তদন্ত করছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
গাফিলতি, না কি অন্য কিছু
জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনাটিকে চরম গাফিলতিই শুধু নয়, পরিকল্পিত বলেই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের যে ঘটনা ঘটেছে। দেখতে হবে সেটি পরিকল্পিত কি না? তা না হলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এত ঢিলেঢালা কেন হবে?”
এক প্রশ্নের জবাবে তৌহিদুল হক বলেন, “এখানে অবহেলা বিষয়টি যোগ করা বেমানান। কারণ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ, ভয়ঙ্কর বা হুমকি স্বরূপ যেসব আসামি তাদের আদালতে নেওয়ার আগেই নিরাপত্তার কৌশল অবলম্বন করতে হয়।
“এটাকে গাফিলতি বা অবহেলা বলার সুযোগ নেই। কারণ তারা তো জেনেশুনেই আসামি বের করেছেন। কেন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ছাড়া কারাগার থেকে এমন গুরুত্বপূর্ণ্ আসামি বের করা হল? ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে কিছু আছে কি না, সেটি বের করতে হবে আগে।”
সুপারিশ সুপারিশেই
জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি ছিল কি না কিংবা নিরাপত্তা ত্রুটি খতিয়ে দেখতে পুলিশ সদর দপ্তর একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছিল। তদন্ত শেষে ১৪টি সুপারিশ দিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেছিল সেই কমিটি।
সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন্স) নাসিয়ান ওয়াজেদ চিঠিও দিয়েছিেলন পুলিেশর বিভিন্ন শাখা ও ইউনিটকে।
সেই সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের পুলিশ সুপার (এআইজি) ইনামুল হক সাগর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই বিষয়ে আমি অবগত নেই। বিস্তারিত জেনে জানাতে পারব।”
কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছিল- এটিইউ, সিটিটিসি, এসবি, সিআইডি, যেসব পুলিশ ইউনিট কাউন্টার টেররিজম নিয়ে কাজ করে, সেসব ইউনিটের এ সংক্রান্ত গোয়েন্দা কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি সেল গঠন করা যেতে পারে। এই সেল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন সংক্রান্তে পুলিশি কার্যক্রম; যেমন- গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, অপারেশন, গ্রেপ্তার, তদন্তে সহায়তা, প্রসিকিউশন বিভাগকে সহায়তা ও আসামি পরিবহনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সমন্বয় করবে।
এছাড়া বলা হয়েছিল, কারাবিধি ও আদালতের নির্দেশ প্রতিপালন সাপেক্ষে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ আসামিদের কাশিমপুর কারাগারের পরিবর্তে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ) রাখা যেতে পারে।