Beta
শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আরব আমিরাত থেকে রেমিটেন্স বাড়ছে কেন

SS-remittances-from-UAE--130324
Picture of আবদুর রহিম হারমাছি

আবদুর রহিম হারমাছি

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। সংযুক্ত আরব আমিরাতে সৌদির চার ভাগের এক ভাগ প্রবাসীও অবস্থান করেন না। তবু কয়েক মাস ধরে সৌদির চেয়ে আমিরাত থেকে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স বেশি আসছে।  

ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৮ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে আমিরাত থেকে। সৌদি আরব থেকে এসেছে প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ, ১৮ কোটি ৩৯ লাখ ডলার।

শুধু ফেব্রুয়ারি নয়, গত কয়েক মাস ধরেই সৌদি আরবের চেয়ে আমিরাত থেকে বেশি রেমিটেন্স দেশে আসছে। অথচ বরাবরই সৌদি আরবে অবস্থানকারী প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়ে আসছিলেন।

সেইসঙ্গে যুক্তরাজ্য থেকেও রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে। কিন্তু কমছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে ৩৭৬ কোটি ৫৩ লাখ (৩.৭৬ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল। আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২৪ দশমিক ১০ শতাংশ কম, ৩০৩ কোটি ৩৮ লাখ (৩.০৩ বিলিয়ন)।

তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) সৌদি থেকে ৪৫৪ কোটি ১৯ লাখ (৪.৫৪ বিলিয়ন) ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল। আমিরাত থেকে এসেছিল অর্ধেকেরও কম, ২০৭ কোটি ১৮ লাখ (২.০৭ বিলিয়ন) ডলার।

ওই দুই অর্থবছরে তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়ের উৎস ছিল আরব আমিরাত। দ্বিতীয় ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র।

কিন্তু চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই দুই দেশকে পেছনে ফেলে শীর্ষে চলে এসেছে আমিরাত। এই অর্থবছরে প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) আমিরাত থেকে ২৯০ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার (২.৯০ বিলিয়ন) ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। তা এই আট মাসে দেশে আসা মোট রেমিটেন্সের ১৯ দশমিক ২৭ শতাংশ।

জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে বিভিন্ন দেশে থেকে মোট ১৫ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছে।

এই আট মাসে সৌদি আরব থেকে রেমিটেন্স এসেছে ১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ১ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার।

হিসাব বলছে, জুলাই-জানুয়ারি সময়ে সৌদি আরবের চেয়ে ৬২ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স এসেছে আরব আমিরাত থেকে; যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি এসেছে ৭৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ৫৪ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি এসেছে যুক্তরাজ্যের চেয়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার দেশভিত্তিক রেমিটেন্সের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে আরব আমিরাত থেকে। দ্বিতীয় স্থানে আছে যুক্তরাজ্য। শীর্ষ থেকে তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে সৌদি আরব।

গত দুই অর্থবছরে দ্বিতীয় স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র নেমে এসেছে চতুর্থ স্থানে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, একক মাসের হিসাবে আমিরাত থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছিল জানুয়ারি মাসে, ৪৪ কোটি ৮১ লাখ ৩০ হাজার ডলার। ফেব্রুয়ারিতে সেই রেকর্ড ৪৮ কোটি ডলারে উঠেছে।

যে কারণে আমিরাত থেকে রেমিটেন্স বাড়ছে

আরব আমিরাত থেকে রেমিটেন্স বাড়ছে কেন—এ প্রশ্নের উত্তরে অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিষয়টা আসলেই অবাক করার মতো। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার হচ্ছে সৌদি আরব। আমিরাতে সৌদির চার ভাগের এক ভাগ প্রবাসীও অবস্থান করেন না। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে- সৌদির চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি রেমিটেন্স আসছে আরব আমিরাত থেকে।

“এর কারণ হচ্ছে আরব আমিরাত থেকে রেমিটেন্স পাঠালে প্রবাসীরা প্রতি ডলারে ৩৪ টাকা বেশি পাচ্ছেন। সে কারণে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলো থেকে রেমিটেন্সের একটি বড় অংশ এখন দুবাই হয়ে তারপর দেশে আসছে। সে কারণে কাগজে-কলমে আমিরাত থেকে রেমিটেন্স বেশি আসছে।”

বিষয়টি আরও পরিস্কার করেন দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।

তিনি বলেন, “সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবি হলেও দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় দুবাইকে ঘিরে। দুবাই একটি বৈশ্বিক শহর এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র। মধ্যপ্রাচ্যে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নসহ বিশ্বের বড় বড় মানি ট্রান্সফার কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালিত হয় দুবাই কেন্দ্রিক।

“দেশে ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এখন রেমিটেন্স সংগ্রহে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে ৬৭ টাকা বেশি দামেও রেমিটেন্স আনছে ব্যাংকগুলো। রেমিটেন্স বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বেশি দরে রেমিটেন্স আনলেও ব্যাংকগুলোকে কিছু বলছে না। দুবাই হয়ে রেমিটেন্স আসলে ডলারের বিপরীতে বেশি টাকা পাওয়া যায়; সে কারণেই এখন সৌদি আরবসহ মধ্যপাচ্যের অন্য দেশগুলোতে অবস্থানকারী প্রবাসীরা দুবাই হয়ে দেশে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন।”

“দুবাই কেন্দ্রিক একটি গ্রুপ এক্ষেত্রে কাজ করছে। তারা আরব আমিরাতসহ মধ্যপাচ্যের অন্য দেশগুলো থেকে রেমিটেন্স সংগ্রহ করে দুবাইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। এতে প্রতি ডলারে ২৩ টাকা বেশি দিচ্ছে তারা,” যোগ করেন আহসান মনসুর।

একই কথা বলেছেন জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রবাসীরা যেখানে টাকা বেশি পাবেন, সেখান থেকেই পাঠাবে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে—গত দুই বছরে আরব আমিরাতে আমাদের অনেক লোক গেছেন কাজের জন্য। তারা কাজ করছেন; রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন।”

আরব আমিরাত থেকে রেমিটেন্স বাড়ার আভাস গত অর্থবছরেই পাওয়া গিয়েছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশটি থেকে ৩০৩ কোটি ৩৮ লাখ ৫০ হাজার (৩.০৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। তা ছিল ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ৪৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি।

প্রথমবারের মতো আমিরাত থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে আসে ২০২২-২৩ অর্থবছরে। গত অর্থবছরে তিনটি দেশ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছিল। বাকি দুটি দেশ ছিল—সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র।

গত অর্থবছরের কয়েক মাসেও শীর্ষে ছিল আমিরাত

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে কয়েক মাসেও সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি প্রবাসী আয় এসেছিল আরব আমিরাত থেকে।

২০২২ সালের মার্চ মাসে আরব আমিরাত থেকে ৩০ কোটি ৭৬ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ওই মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল ৩০ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। আর সৌদি আরব থেকে এসেছিল ২৮ কোটি ৩ লাখ ডলার।

২০২৩ সালের জানুয়ারি ও ২০২২ সালের মে মাসেও সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছিল আরব আমিরাত থেকে।

স্বাধীনতার পর থেকে শীর্ষে ছিল সৌদি আরব

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে বরাবরই সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসীরা মোট ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। তার মধ্যে সৌদি আরব থেকে এসেছিল ৫৭২ কোটি ১৪ লাখ (৫.৭২ বিলিয়ন) ডলার।

দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, এসেছিল ৩ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। আর সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছিল ২ দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলার।

কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিটেন্স প্রবাহ ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কমে যায়; আসে ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার; সব দেশ থেকেই কম আসে অর্থনীতির এই সূচক।

ওই অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে ৪ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার আসে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে ৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে আসে ২ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য যত শ্রমিক বিদেশে গেছেন, তার প্রায় ২০ শতাংশ গেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বর্তমানে দেশটিতে ১০ লাখের মতো প্রবাসী কাজ করছেন।

বিএমইটির হিসাবে, বাংলাদেশের শীর্ষ শ্রমবাজার সৌদি আরব। ১৯৭৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া শ্রমশক্তির ৩৬ শতাংশই গেছে দেশটিতে। সংখ্যার দিক থেকে যা ৫৫ লাখের বেশি।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তাদের বড় অংশই রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে, কাজ করছেন বিভিন্ন শ্রমঘন পেশায়।

মধ্য প্রাচ্যের প্রধান ব্যবসার কেন্দ্র দুবাই

আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত সাতটি স্বাধীন রাজ্যের ফেডারেশন- সংযুক্ত আরব আমিরাত। সাতটি রাজ্যের নাম হলো আবুধাবি, আজমান, দুবাই, ফুজাইরা, রাস আল খাইমা, আশ শারজাহ ও উম্ম আল কোয়াইন।

দুবাই এই ফেডারেশনের বৃহত্তম ও জনবহুল শহর এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র।

ফেডারেশনের অর্থনীতি প্রধানত আবুধাবির উৎপাদিত তেলের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে দুবাইয়ের অর্থনীতি ব্যবসা ও পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। সম্প্রতি আরব আমিরাত তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে।

এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেশটি পর্যটনশিল্প ও পণ্য উৎপাদনের ওপর জোর দিচ্ছে।

আরব আমিরাতে আছে অনেক দৃষ্টিনন্দন ও গগনচুম্বী ভবন। বর্তমান বিশ্বের সর্বোচ্চ অট্টালিকা ‘বুর্জ খলিফা’ দুবাই শহরেই। প্রশস্ত রাস্তা ও সুপার হাইওয়ের জন্য বিশ্বজুড়ে খ্যাতি আছে আমিরাতের। পারস্য উপসাগরের কূলে ৫ দশমিক ৭২ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ।

পামগাছের মতো দেখতে এই দ্বীপপুঞ্জের নাম ‘পাম জুমেইরা’। এটা পৃথিবীর বৃহত্তম কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ। দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যাত্রীর সংখ্যা বিবেচনায় পৃথিবীর চতুর্থ ব্যস্ততম বিমানবন্দর।

এসব কারণে চাঙা থাকা অর্থনীতির এই দেশটি থেকে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ার আরেকটি কারণ বলে মনে করেন আহসান মনসুর।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত