Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫
Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫

খুন হয়েছিলেন বাবা, ইউসিবিতে চেয়ারম্যান হয়ে ফিরলেন ছেলে

শরীফ জহীর।
শরীফ জহীর।
[publishpress_authors_box]

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আঁচ ভালোভাবেই লেগেছে দেশের ব্যাংক খাতে, একের পর এক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ যাচ্ছে বদলে। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকেও তা ঘটেছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের কর্তৃত্বের অবসানের পর বেসরকারি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হয়েছেন শেয়ারধারী পরিচালক শরীফ জহীর।

এর মধ্যদিয়ে ব্যাংকটির প্রথম চেয়ারম্যানের পরিবারের কাছে আবার পদটি ফিরে গেল। সেই সঙ্গে এই ব্যাংকটি জড়িয়ে দুই পরিবারের দ্বন্দ্বের পুরনো ইতিহাস আবার সামনে এল। সেই দ্বন্দ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সঙ্গে হুমায়ুন জহীরের দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বের জের তাদের উত্তর প্রজন্মও টানছে।

বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন হুমায়ুন জহীর। অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তিনি। বাড়ি তার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের অনন্তপুরে, তাই তার ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর এই নাম।

হুমায়ুন জহির ও তার স্ত্রী।

নোয়াখালীর হুমায়ুন জহীরের সঙ্গে ইউসিবির মালিকানায় ছিলেন চট্টগ্রামের আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। ব্যবসায়ী বাবু ছিলেন চট্টগ্রামের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা। কেন্দ্রীয় নেতা হিসাবেও ছিল তার প্রভাব, পরে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যও হয়েছিলেন তিনি। হুমায়ুন জহীরের পর ইউসিবির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন তিনি।

১৯৯৩ সালে হুমায়ুন জহীরকে ঢাকায় তার বাড়ির সামনে হত্যা করার পর সন্দেহভাজন হিসাবে আসে আখতারুজ্জামান বাবুর নাম। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তখন বাবু গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। কিন্তু জামিনে মুক্তির পর তিনি চলে যান বিদেশে।

হুমায়ুন জহীর যখন মারা যান, তখন তার ছেলে শরীফ ১৬ বছর বয়সী কিশোর। শরীফের আরেক ভাই শিশু। তার বড় দুটি বোন। তাদের বয়সও বিশের আশপাশে। তাদের মা কামরুন নাহার ব্যবসার হাল ধরেন। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের নিজস্ব ভবনে অনন্ত অ্যাপারেলসের ব্যবসাটি রেখে অন্য ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেন। ছেলে-মেয়েদের বড় করতে থাকেন।

হুমায়ুন জহীরকে কেন নিহত হতে হলো- সেই প্রশ্নের জবাবে শরীফ জহীর বিভিন্ন সময়ে বলেছিলেন, চেয়ারম্যান হিসাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছিলেন বাবু। সেই ঋণ ফেরত দিতে চাপ দিয়েছিলেন হুমায়ুন জহীর। সেই কারণে বাবু হত্যা করিয়েছিলেন তার বাবাকে।

এদিকে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর দেশে ফেরেন বাবু। ব্যাংকের কর্তৃত্ব নিতেও তৎপর হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৯৯ সালের ২৬ আগস্ট সশস্ত্র অবস্থায় সদলবলে ইউসিবির কর্তৃত্ব নেন বাবু, তৎকালীন চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ চৌধুরীকে পদত্যাগে বাধ্য করেন।

কোনও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দখল নিতে এমন কাণ্ড বাংলাদেশে আগে দেখা যায়নি বলে তখন বাংলাদেশে এই ঘটনা ছিল ব্যাপক আলোচিত। কিন্তু সরকারের আশীর্বাদ থাকায় তখন বাবুর কিছু হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে জাফর আহমেদ আদালতের রায় নিয়ে পুনরায় পরিচালনা পর্ষদে ফিরে যান।

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর ইউসিবিতে মালিকানা নিয়ে বিরোধিতার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পরের বছরই বাবু আবার ব্যাংকের পরিচালক হন।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু।

এদিকে উত্তরাধিকার সূত্রে শরীফ ইউসিবির বড় অংশের শেয়ারের মালিক ছিলেন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত বেশিরভাগ শেয়ার ধরেও রেখেছিলেন তিনি। ২০১৩ সাল থেকে দুই বছর ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যানও ছিলেন।

এরপর ২০১৫ সালে নোয়াখালীরই আরেক ব্যবসায়ী এবং বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য এম এ হাসেম ইউসিবির চেয়ারম্যান হন।

অন্যদিকে আখতারুজ্জামান বাবু ২০১২ সালে মারা যাওয়ার পর তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণকর্তা হন ছেলে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ।

২০১৮ সালে ব্যাংকটির কর্তৃত্ব নেয় জাবেদের পরিবার, তখন তিনি ভূমিমন্ত্রী। অভিযোগ আছে, বাবার মতোই ব্যাংকটি আবার দখল করেন তিনি। এরপর ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন জাবেদের স্ত্রী রুখমিলা জামান।    

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসন অবসানের পর ইউসিবির চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন রুখমিলা।

গত ১৪ আগস্ট নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে ব্যাংকের ওয়েবসাইটে জাবেদের বোন রোকসানা জামান চৌধুরীর নাম প্রকাশ করা হয়েছিল। তবে কোন প্রক্রিয়ায় তা করা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

তার ১৩ দিনের মাথায় মঙ্গলবার দুপুরে ইউসিবির প্রধান কার্যালয়ে পরিচালনা পর্ষদের সভায় ব্যাংকটির স্বতন্ত্র পরিচালক অপরূপ চৌধুরীকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। এর ৫-৬ ঘণ্টা পর রাতেই সেই পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে নতুন পর্ষদ গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তাতে পর্ষদের চেয়ারম্যান হন শেয়ারধারী পরিচালক শরীফ জহীর। ন্যাশনাল ফাইন্যান্স লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগের শর্তে তাকে এই নিয়োগ দেওয়া হয়।

এদিকে সরকার পতনের পর জাবেদ ও রুখমিলা অপ্রকাশ্য। তারা বিদেশে চলে গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে তাদের অঢেল সম্পদ গড়ার খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। তাদের সব ব্যাংক হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে আর্থিক খাতের গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ। তাদের পাচার করা সম্পদের খোঁজও চলছে।

সাইফুজ্জামান চৌধূরী জাবেদ।

এই পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকার মধ্যে ইউসিবি পড়ে দুর্দশায়। একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছে ব্যাংকটি। ২০২৩ সালে ইউসিবির খেলাপি ঋণের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়া শরীফ জহীর যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রিধারী। বাবার গড়া অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তিনি।

চট্টগ্রাম ইপিজেড ও আদমজী ইপিজেডে তাদের কয়েকটি পোশাক কারখানা রয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল অবধি বিজেএমইএর পরিচালনা পর্ষদেও ছিলেন শরীফ। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ফিন্যান্স লিমিটেডেরও চেয়ারম্যান তিনি।

২০২২ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসা একটি রোলস রয়েস গাড়ি ঢাকা থেকে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জব্দ করার পর এর আমদানিকারক হিসাবে শরীফ জহীরের নাম আলোচনায় এসেছিল।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অভিযোগ ছিল, প্রায় ২৪ কোটি টাকা শুল্কায়ন না করে গাড়িটি খালাস করা হয়। তবে শরীফ জহীর তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, গাড়িটি খালাসে কোনও অনিয়ম হয়নি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত