সরবরাহ কমায় জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বেড়েছে যুক্তরাজ্যে। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ায় ব্যয় কমিয়ে দিয়েছেন ব্রিটিশরা। এতে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) টানা ছয় মাস সংকোচন হয়েছে। এর ফলে গত বছরের শেষদিকে অর্থনৈতিক মন্দায় পড়েছে দেশটি।
২০২৩ সালের শেষ ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে) যুক্তরাজ্যের জিডিপি প্রত্যাশিত দশমিক তিন শতাংশের চেয়ে বেশি কমে। তার আগের তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে) কমেছিল দশমিক এক শতাংশ।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর (ওএনএস) বৃহস্পতিবার এই তথ্য প্রকাশ করে।
রয়টার্স বলছে, অক্টোবর-ডিসেম্বরের সংকোচন তাদের একটি জরিপের অনুমানের চেয়ে বেশি ছিল। সেই জরিপে বেশিরভাগ অর্থনীতিবদরা বলেছিলেন, দশমিক এক শতাংশ সংকোচন হতে পারে।
ওএনএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে জিডিপিতে যে হারে পতন হয়েছে তা ২০২১ সালের প্রথম তিন মাসের পর সবচেয়ে বড়।
আর পুরো ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যের জিডিপি বেড়েছে মাত্র দশমিক এক শতাংশ, যা ২০০৯ সালের পর সর্বনিম্ন। সেসময় বিশ্বের সব বড় অর্থনীতির দেশ মন্দায় পড়েছিল। ২০০৮ এর দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক থেকে ২০০৯ এর দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক পর্যন্ত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছিল সেই মন্দা।
তবে কোভিড-১৯ অতিমারীর সময়টা এই হিসাবের মধ্যে ধরা হয়নি। কোভিডের সময় ২০২০ সালের প্রথম দুই ত্রৈমাসিকে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংকোচন হয়েছিল। সে সময় দেশটির জিডিপি ২২ শতাংশ কমে গিয়েছিল।
সাধারণত টানা ছয় মাস (পরপর দুই ত্রৈমাসিকে) কোনও দেশের জিডিপি কমলে দেশটি অর্থনৈতিক মন্দায় পড়েছে বলে ধরা হয়।
আল জাজিরা জানায়, জিডিপির এই তথ্য প্রকাশের পরপরই মার্কিন ডলার ও ইউরোর বিপরীতে ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ড স্টার্লিং কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি প্রায় দুই বছর ধরে স্থবির হয়ে আছে। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বলেছিল, ২০২৪ সালে অর্থনীতির গতি কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু তা হয়নি।
ফলে জাপানের সঙ্গে যুক্তরাজ্যও মন্দায় পড়লো। দুটি দেশই বিশ্বের সাতটি শীর্ষ অর্থনীতির দেশের জোট জি-সেভেনের সদস্য। তবে এই মন্দা স্বল্পস্থায়ী এবং অগভীর হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
দ্য গার্ডিয়ান বলছে, অত্যধিক মূল্যস্ফীতি এবং ঋণের উচ্চ খরচের চাপে যুক্তরাজ্যের পরিবারগুলো গভীর অর্থনৈতিক অস্বস্তিতে পড়েছে।
সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জনসংখ্যার মাথাপিছু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টানা সাত ত্রৈমাসিকে কমেছে, যা ১৯৯৫ সালের পর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি। ১৯৫৫ সাল থেকে বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির রেকর্ড রাখা শুরু হয়।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর (ওএনএস) বলেছে, একাধিক ক্ষেত্রে গত বছরের শেষের দিকে অর্থনীতির অবনতি ঘটেছে। নভেম্বরে ব্ল্যাক ফ্রাইডে বিক্রির সুবিধা নেওয়ার পর ক্রেতারা ডিসেম্বরে কম খরচ করেছেন।
জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্মঘটের কারণে স্বাস্থ্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হারও ১ শতাংশ কমেছে।
মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) হলো একটি দেশের কোম্পানি, সরকার, সরকারি খাত ও নাগরিকদের ব্যক্তিগত সমস্ত অর্থনৈতিক কার্যকলাপের একটি সামষ্টিক পরিমাপ।
কোনও দেশের জিডিপি বাড়তে থাকলে সে দেশের সরকার এই ক্রমবর্ধমান জিডিপিকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে বলতে পারে যে, তারা অর্থনীতি পরিচালনায় ভালো করছে। একইভাবে, যদি জিডিপি কমে যায়, বিরোধী রাজনীতিকরা বলতে পারেন যে, সরকার দেশ খারাপভাবে চালাচ্ছে।
যদি জিডিপি ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকে, তবে নাগরিকরা বেশি করে ট্যাক্স দেয়। কারণ তাদের আয় ভালো হলে তারা ব্যয়ও বেশি করে। এতে রাষ্ট্রের আয় বাড়ায় সরকার স্কুল, পুলিশ ও হাসপাতালের মতো সরকারি পরিষেবায় ব্যয় বাড়িয়ে ভোটারদের মন জয় করতে পারে।
যুক্তরাজ্যের এই মন্দায় দেশটির ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক আগামী নির্বাচনে ভোট হারাতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ তিনি অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ বছরের শেষদিকে যুক্তরাজ্যে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।
ব্রিটিশ চেম্বার অব কমার্সের নীতি ও অন্তর্দৃষ্টি বিষয়ক পরিচালক অ্যালেক্স ভিচ বলেছেন, “ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে বুঝে গেছেন তারা সমস্যায় পড়েছেন। এই খবরটি সরকারের জন্যও বিপদের ঘণ্টা বাজবে।”
ক্যাপিটাল ইকোনমিক্সের যুক্তরাজ্যের উপ প্রধান অর্থনীতিবিদ রুথ গ্রেগরি বলেন, “এই মন্দা তীব্র নয়, মাঝারি মন্দা। তা অর্থনৈতিকভাবে যতটা না তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।“
বিবিসির অর্থনীতি বিষয়ক সম্পাদকের মতে, “অনেক অর্থনীতিবিদ পূর্বাভাস দিচ্ছেন, এই মন্দা বছরজুড়ে স্থায়ী হতে পারে। তবে, আশা করা হচ্ছে, বর্তমান ত্রৈমাসিকে (জানুয়ারি-মার্চ) যুক্তরাজ্যের জিডিপি বাড়বে। যদি বাড়ে তাহলে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্দার ঘোষণা আসার আগেই তা শেষ হয়ে যেতে পারে।
“তবে তাতেও কিছুটা হলেও প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের দুর্নাম হবে। কারণ তিনি অর্থনীতি ভালো করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।”
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুনাক গত বছর ভোটারদের কাছে তার অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি হিসেবে জিডিপি বাড়ানোর কথা বলেছিলেন। তার কনজারভেটিভ পার্টি গত ৭০ বছরের বেশির ভাগ সময় ধরে ব্রিটিশ রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছে।
অর্থনীতি ভালো রাখার সক্ষমতার জন্য তাদের বেশ খ্যাতিও রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক জনমত জরিপগুলোতে দেখা গেছে, অর্থনীতি নিয়ে ব্রিটিশ নাগরিকরা এখন লেবার পার্টি ওপর বেশি আস্থাশীল।