পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে গাজায়, এর মধ্যে পাঁচটি প্রস্তাব বাতিলের পর সোমবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে।
বহু প্রতীক্ষিত এই প্রস্তাবে রোজার মাস উপলক্ষে গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। তা যেন দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই যুদ্ধবিরতি হয়, সেই আহ্বানও রয়েছে।
হামাসের হাতে বন্দি ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির আহ্বানও জানিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদ। পাশাপাশি গাজায় আরও বেশি মানবিক সহায়তা প্রবেশ এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার প্রয়োজনীয়তার উপরও জোর দেওয়া হয়েছে।
আগের আচরণের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে এবার প্রস্তাবটি পাস করার সুযোগ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তারা প্রস্তাবের পক্ষেও ভোট দেয়নি, বিপক্ষেও দেয়নি। ভোটদানে বিরত ছিল ভেটো ক্ষমতাধর দেশটি।
অন্যদিকে নিরাপত্তা পরিষদের বাকি চার সদস্যসহ অন্য ১০টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলে এটি পাস হয়ে যায়।
কিন্তু বিশ্লেষক বলছেন, প্রস্তাবটিতে যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এটি একটি প্রতীকী প্রস্তাব। যুদ্ধ বন্ধে এর বাস্তব সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির প্রেসিডেন্ট ন্যান্সি ওকাইল আল জাজিরাকে বলেছেন, প্রস্তাবটি তাৎপর্যপূর্ণ হলেও এটি অনেক দেরিতে এসেছে এবং যথেষ্টও নয়।
প্রস্তাবটি কি বাধ্যতামূলক
জাতিসংঘ সনদের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদের (ইউএনএসসির) সব প্রস্তাবই বাধ্যতামূলক বলে বিবেচিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রও ধারাটির অনুমোদন দেয়।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সোমবার পাস হওয়া প্রস্তাবটি বাধ্যতামূলক নয় বলে দাবি করেছে। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড বলেছেন, ওয়াশিংটন ‘এই অ-বাধ্যতামূলক প্রস্তাবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য’ সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করে।
একই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারও সাংবাদিকদের বলেছেন, “এটি একটি অ-বাধ্যতামূলক প্রস্তাব।”
তবে জাতিসংঘের অন্যান্য কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা পরিষদের অন্য সদস্যরা প্রস্তাবটিকে বাধ্যতামূলক বলছেন।
জাতিসংঘে চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুন বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের সব প্রস্তাবই বাধ্যতামূলক।
জাতিসংঘের উপ মুখপাত্র ফারহান হক বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলো আন্তর্জাতিক আইন, সে হিসেবে সেগুলো আন্তর্জাতিক আইনের মতোই বাধ্যতামূলক।
তুরস্কের আনাদোলু এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রস্তাবটি উত্থাপনকারী মোজাম্বিকের জাতিসংঘ রাষ্ট্রদূত পেদ্রো কমিসারিও বলেছেন, “জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সমস্ত প্রস্তাব বাধ্যতামূলক এবং আদেশমূলক।”
প্রস্তাব না মানলে কী হয়
যদি কোনও দেশ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব না মানে, তাহলে পরিষদ আরেকটি প্রস্তাব এনে সেই দেশটির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। এমনকি আন্তর্জাতিক শান্তি বাহিনী মোতায়েনের অনুমোদনও দিতে পারে।
তবে আল জাজিরার কূটনৈতিক সম্পাদক জেমস বেস বলেছেন, “কোনও পরিস্থিতিতেই জো বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া কোনও প্রস্তাবকে সমর্থন করবে না।”
ইসরায়েল অতীতেও বারবার জাতিসংঘের প্রস্তাব লঙ্ঘন করে পার পেয়ে গেছে।
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মেয়াদের শেষদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বসতি স্থাপনকে বেআইনি এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে একটি প্রস্তাব পাস করেছিল।
প্রস্তাবটি ১৪ ভোটে পাস হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকে। কিন্তু ইসরায়েল সেই প্রস্তাব উপেক্ষা করে।
অতি সম্প্রতি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেও মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। জাতিসংঘের বেশিরভাগ সদস্যের ভোটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রস্তাবটি পাস হয়। সেটি একটি অ-বাধ্যতামূলক প্রস্তাব ছিল। কিন্তু ইসরায়েল তাতে গা লাগায়নি।
সোমবারের প্রস্তাব পাসের পর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক এক্স পোস্টে বলেছেন, “গাজা অনাহারের দ্বারপ্রান্তে, অন্তত ৩২,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এই প্রস্তাব অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। ব্যর্থতা হবে ক্ষমার অযোগ্য।”
যুদ্ধ কি বন্ধ হবে
সোমবারের প্রস্তাবে রমজান মাসের জন্য অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়েছে। যাইহোক, যেহেতু রমজান মাস ৯ এপ্রিল শেষ হবে, সেহেতু যুদ্ধবিরতি যদি এখন বাস্তবায়িত হয়ও তা মাত্র দুই সপ্তাহ স্থায়ী হবে।
তবে মাঠের চিত্র ভিন্ন বার্তাই দিচ্ছে। বিবিসি জানিয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাসের পরও গাজায় বোমা ও বন্দুকের শব্দ পাওয়া গেছে। যার মানে যুদ্ধ চলছে।
পাস হওয়া প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, রমজানে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির পর সেটিকে একটি দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই যুদ্ধবিরতির দিকে নিয়ে যাওয়া উচিৎ।
সোমবার প্রস্তাবটির ওপর ভোটাভুটির কিছুক্ষণ আগে, এর কথা নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাবটি থেকে ‘স্থায়ী যুদ্ধবিরতি’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। রাশিয়া ‘স্থায়ী’ শব্দটি রাখার জন্য চাপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। রাশিয়া বলেছিল, স্থায়ী শব্দটি না রাখলে রমজানের পরে ইসরায়েল ফের গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রও ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করেনি এবং জোর দিয়ে বলেছে, ইসরায়েলের নিরাপত্তার ব্যাপারে তার প্রতিশ্রুতি অটুট রয়েছে।
এমনকি হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা মুখপাত্র জন কারবি সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, “এবারের প্রস্তাবে আমাদের ভেটো না দেওয়ার মানে এই নয় যে, আমরা আমাদের নীতিতে পরিবর্তন এনেছি। আমরা সবসময়ই জিম্মি মুক্তি চুক্তির অংশ হিসেবে যুদ্ধবিরতির কথা বলে আসছিলাম।”
গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র নিজেও একটিও প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল। কিন্তু রাশিয়া ও চীনের ভেটোর কারণে সেই প্রস্তাবটি পাস হয়নি। ১১টি দেশ প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আলজেরিয়া প্রস্তাবটির বিপক্ষে ভোট দেয় আর গায়েনা ভোটদানে বিরত থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের আনা প্রস্তাবটিতে যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়নি বরং জিম্মি মুক্তির চুক্তির অংশ হিসেবে অবিলম্বে এবং টেকসই যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন জানানো হয়।
সোমবার এক সংবাদ বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় যুদ্ধবিরতির যে কোনও দাবিতে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির দাবিটিও যুক্ত হোক।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোকে হামাসের অর্থায়ন সীমিত করাসহ সন্ত্রাসবাদের অর্থায়ন বন্ধ করার আহ্বানও জানানো হয়েছে। প্রস্তাবটিতে হামাসের নিন্দাও করা হয়েছে এবং হামাসকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্লিঙ্কেনের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, সোমবার পাস হওয়া প্রস্তাবটি হামাসের নিন্দা করতে ব্যর্থ হয়েছে, অথচ যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে অপরিহার্য বলে মনে করে।
যুদ্ধবিরতির সঙ্গে জিম্মি মুক্তির শর্তটি জুড়ে না দেওয়ায় ইসরায়েলও সোমবারের প্রস্তাবের সমালোচনা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল টানাপড়েন কি বাড়াবে
যুক্তরাষ্ট্র সোমবারের প্রস্তাবে ভেটো না দেওয়ায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একটি ইসরায়েলি প্রতিনিধি দলের পূর্বনির্ধারিত ওয়াশিংটন সফর বাতিল করেন। এতে দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এই ঘটনাকে আশ্চর্যজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক বলে অভিহিত করেছেন।
তবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। তিনি সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং মঙ্গলবার প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিনের সঙ্গেও তার দেখা করার কথা রয়েছে।
ব্লিঙ্কেন দক্ষিণ গাজার রাফা শহরে স্থল হামলা থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন গ্যালান্টকে।
বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলকে গাজার রাফায় পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণ না করার জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছিল। কিন্তু ইসরায়েল তা কানে নিচ্ছিলো না। ধারণা করা হয়, এ কারণেই হয়ত যুক্তরাষ্ট্র এবারের প্রস্তাবে ভেটো দেয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের ব্যাপারে তার নীতি অটুট রাখার কথা পুনর্ব্যক্ত করলেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর অফিসিয়াল এক্স হ্যান্ডেলে সোমবার রাতে পোস্ট করা হয়েছে, “যুক্তরাষ্ট্র আজ জাতিসংঘে তার নীতি পরিত্যাগ করেছে।”
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা