এক বছরের মধ্যে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধ দখলদারিত্ব শেষ করতে ইসরায়েলকে আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। জাতিসংঘের এই পদক্ষেপকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে অভিহিত করেছে ফিলিস্তিন।
অবাধ্যতামূলক প্রস্তাবটি বুধবার ১২৪ ভোট পেয়ে পাস হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৪টি দেশ প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। আর ভারতসহ ৪৩টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (ইউএনজিএ) দাবি করেছে, “অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলকে তার বেআইনি উপস্থিতি অবিলম্বে শেষ করতে হবে। আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার দিক থেকে এই দখলদারিত্ব একটি অন্যায় কাজ। ইসরায়েলকে ১২ মাসের মধ্যই ফিলিস্তিনের অধিকৃত ভূখণ্ড ছাড়তে হবে।”
দখলদারিত্বের কারণে ফিলিস্তিনিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্যও ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। প্রস্তাবটি আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক না হলেও তেল আবিবের ওপর তা যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করবে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মিশন “মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা” বাড়ানো এবং বিশ্বের সকল স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ এর সদস্য। তাই বুধবারের ভোট ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিরোধিতার গভীরতাকে নির্দেশ করে।
জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) সম্প্রতি যে পরামর্শমূলক মতামত দিয়েছে, এই প্রস্তাবে তাকেই সমর্থন করা হয়েছে। আইসিজে বলেছে, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের উপস্থিতি বেআইনি এবং অবশ্যই এর অবসান হওয়া উচিৎ।
জুলাই মাসে আদালত রায় দেয়, ইসরায়েল একটি দখলকারী শক্তি হিসেবে তার মর্যাদার অপব্যবহার করছে। পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি বসতি অবৈধ বলেও জোর দেয়।
১৯৬৭ সালের তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা উপত্যকা দখল করে নেয় ইসরায়েল। ফিলিস্তিনিরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য এই তিনটি ভূমিই চায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই তিনটি এলাকাকেই দখলকৃত ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
দখল করা স্থানগুলোর মধ্যে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন শুরু করে ইসরায়েল, ক্রমশ তা প্রসারিত হতে থাকে। বর্তমানে পশ্চিম তীরসহ ফিলিস্তিনের অনেক এলাকায় নতুন নতুন বসতি স্থাপন অব্যাহত রেখেছে ইসারয়েল।
গাজায় ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রস্তাবটি পাস হল। ইসরায়েলের হামলায় প্রায় ৪২ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। নিহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
আইসিজে ইসরায়েলকে গাজায় গণহত্যা রোধে পদক্ষেপ নিতে এবং পর্যাপ্ত মানবিক সহায়তা প্রবেশে অনুমতি দেওয়ারও আদেশ জারি করেছিল।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের একটি দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের দাবি করা যুক্তরাষ্ট্র বুধবারের এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়ায়। চেকিয়া, হাঙ্গেরি, আর্জেন্টিনা এবং বেশ কয়েকটি ছোট প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ রাষ্ট্রও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়।
জাতিসংঘের স্থায়ী পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র ফিলিস্তিন প্রস্তাবটি পেশ করে।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং ইসরায়েলকে এটি মেনে চলতে চাপ দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিতে বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
আব্বাস বলেন, “এই প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক ঐকমত্য আমাদের ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার এবং পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আশার পুনর্নবায়ন করেছে। আমরা জেরুজালেমসহ গাজা এবং পশ্চিম তীরে ব্যাপক আগ্রাসন ও গণহত্যার শিকার হচ্ছি।”
প্রস্তাবটি পেশ করার সময় জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসুর বলেন, ফিলিস্তিনিরা অস্তিত্বের হুমকির মুখে রয়েছে এবং ইসরায়েল তাদের শেকলে বদ্ধ করে রেখেছে। ইসরায়েলের দখলদারিত্বের অবসান এবং ফিলিস্তিনিদের মর্যাদা, শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে নিজেদের পূর্বপুরুষের ভূমিতে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, “যারা মনে করে ফিলিস্তিনি জনগণ দাসত্বের জীবন, বর্ণবাদের জীবন মেনে নেবে, তারা বাস্তববাদী নয়। ফিলিস্তিন সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান ছাড়া আমাদের অঞ্চলে শান্তি সম্ভব বলে যারা দাবি করে, তারা বাস্তববাদী নয়।”
প্রস্তাবে ইসরাইলকে তার সেনা প্রত্যাহার, অবিলম্বে নতুন সব বসতি নির্মাণ বন্ধ এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে সব বসতি স্থাপনকারীদের সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাণিজ্য বা বিনিয়োগ বন্ধে পদক্ষেপ নিতে এবং বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা বন্ধ করাসহ অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নেও দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রস্তাবটি প্রসঙ্গে জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস বলেন, “প্রস্তাবে বেশকিছু অসঙ্গতি রয়েছে। এটি আইসিজের নিয়মনীতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি করছে। এছাড়াও গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাস একটি সন্ত্রাসী সংগঠন এবং ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের বিষয়টি এই প্রস্তাবে তুলে ধরা হয়নি।”
তিনি আরও বলেন, “এই প্রস্তাব ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য বাস্তব সুফল বয়ে আনবে না বলে আমরা মনে করছি। এটি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। সংঘাত অবসানে যেসব চেষ্টা চলছে সেগুলো জটিল করে তুলতে পারে।
“দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলোকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে আমি মনে করি।”