অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।
শুক্রবার ঢাকার তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে সংস্কার কর্মসূচির প্রতি জাতিসংঘের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
এসময় বাংলাদেশে বসবাসরত দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য মানবিক সহায়তা কমে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। চার দিনের সফরে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে আসেন গুতেরেস।
বাসস জানিয়েছে, ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব অধ্যাপক ইউনূসকে বলেন, “আপনাদের সংস্কার প্রচেষ্টাকে সমর্থন দিতে আমি এখানে এসেছি। আপনাদের সর্বোত্তম সফলতা কামনা করি। যেকোনও সহযোগিতা দরকার পড়লে আমাদের জানান।”
গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তারপর থেকেই বিএনপিসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছিল, সংস্কার করে তারপর নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হবে। তাতে সময় লেগে যেতে পারে ডিসেম্বর পর্যন্ত।
জাতিসংঘ মহাসচিব আশা প্রকাশ করেন, এই সংস্কার প্রক্রিয়া একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দেশের একটি ‘বাস্তব রূপান্তর’ নিশ্চিত করবে। তিনি বলেন, “আমি জানি সংস্কার প্রক্রিয়া জটিলও হতে পারে।”
সেখানেই জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের প্রতি সংহতি করেন তিনি।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর নিপীড়নের মুখে ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশ সীমান্তে নামে রোহিঙ্গা ঢল। তাতে কয়েক মাসেই ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে।
এর আগে থেকেই বাংলাদেশে ছিল ৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা। শরণার্থী জীবন কাটানো রোহিঙ্গাদের ঘরে নতুন সন্তান আসায় সংখ্যাটি এখন ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়।
এসব রোহিঙ্গার জন্য মানবিক সহায়তার পরিমাণ কমে আসায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, “পৃথিবীতে অন্য কোনও জনগোষ্ঠীকে এতটা বৈষম্যের শিকার হতে আমি দেখিনি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ভুলতে বসেছে।”
পশ্চিমা দেশগুলো প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় দ্বিগুণ করছে, কিন্তু বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তা সংকুচিত হচ্ছে জানিয়ে গুতেরেস মন্তব্য করেন, “মানবিক সহায়তা হ্রাস করা একটি অপরাধ।”
তবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি জাতিসংঘের ‘অপরিসীম কৃতজ্ঞতা’ প্রকাশ করে গুতেরেস বলেন, “বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রতি অত্যন্ত উদারতা দেখিয়েছে।”
বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিবকে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানান প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের বিষয়ে এরই মধ্যে প্রায় ১০টি রাজনৈতিক দল তাদের মতামত জমা দিয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “দলগুলো ছয়টি কমিশনের সুপারিশগুলোর সঙ্গে একবার একমত হলে, তারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে, যা দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পাশাপাশি রাজনৈতিক, বিচারিক, নির্বাচন সংক্রান্ত, প্রশাসনিক, দুর্নীতি দমন এবং পুলিশ সংস্কারের একটি রূপরেখা হবে।”
নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজ’ নিয়ে একমত হয়, তবে ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে পারে। তবে, তারা যদি ‘বৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ’ গ্রহণ করে, তাহলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে অনুষ্ঠিত হবে।
বৈঠকে ‘সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধান উপদেষ্টা।
রোহিঙ্গারা যেন সম্মানের সঙ্গে তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারে সেজন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের সহযোগিতা চেয়ে যতদিন তারা বাংলাদেশে অবস্থান করছে ততদিন তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, “তারা কতটা কষ্ট পাচ্ছে তা বিশ্বকে জানতে হবে।”
লাখ লাখ রোহিঙ্গা কারণে ২০১৭ সাল থেকেই ভুগছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা সফল হয়নি। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি হয়, তারপরও কোনও শরণার্থীকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো যায়নি।
এর মধ্যে ২০০২ সালে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নেয় সামরিক বাহিনী। এরপর আবার বিদ্রোহী দলগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়।
জাতিসংঘ মহাসচিব আশ্বাস দেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন এবং তাদের জন্য সহায়তা সংগ্রহকে অগ্রাধিকার দেবেন।
বৈঠকে বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করেন গুতেরেস। অধ্যাপক ইউনূসও বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের প্রশংসা করে বলেন, এই মিশনে কাজ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এক অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
বৈঠকে ভূ-রাজনীতি, সার্কের বর্তমান অবস্থা এবং বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক নিয়েও আলোচনায় হয়। অধ্যাপক ইউনূস দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক ফোরামকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তার প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ আসিয়ানের সদস্য হতে চায় বলেও জানান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে একাধিক বন্দর নির্মাণ প্রকল্প সম্পর্কেও কথা বলেন, যা নেপাল ও ভুটানসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দেশকে ‘একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র’ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
অর্থনীতি প্রসঙ্গেও কথা হয় বৈঠকে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাত, সংকুচিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙ্গে পড়া অবস্থায় পেয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, “অর্থনীতি এখন সুসংহত হয়েছে। কয়েক মাস ধরে রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ভালো অবস্থানে রয়েছে।
“অর্থনীতি এমনভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী বছর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ। আমরা এলডিসি উত্তরণের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
তার এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে পর্তুগালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গুতেরেস বলেন, আগের সরকারের রেখে যাওয়া অর্থনীতির ভঙ্গুর পরিস্থিতি তাকে ১৯৭৪ সালের পর্তুগালের বিপ্লবী দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়।