জুলাই-আগস্টে আন্দোলনে গুলি চালিয়ে কয়েকশ মানুষ হত্যা ও দমন-পীড়ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা পুলিশকে ‘ভিলেন’ হিসেবেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনতার রোষ দেখে পুলিশও।
থানা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ-হত্যার পর পুলিশি সেবাশূন্য হয়ে পড়েছিল দেশ। পরিস্থিতি এমনও হয়েছিল যে ভয়ে কাজে আসতে পারছিলেন না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী এই বাহিনীর সদস্যরা।
যদিও রাষ্ট্রীয় সংস্থা পুলিশের দায়িত্ব নাগরিক ও সম্পদের সুরক্ষা দেওয়া, নাগরিকদের আইন মানার মধ্যে রাখা, অপরাধ চিহ্নিত করে অপরাধীদের ধরা; তবে নাগরিকদের কাছে নিপীড়ক হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আসছে তারা।
গত জুলাইয়ের শুরুতে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন মাসের মধ্যভাগে দমন-পীড়ন-হত্যার ঘটনায় সহিংস হয়ে ওঠে; যা আগস্টের শুরুতে তীব্র আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর আক্রান্ত হয় পুলিশও।
সেদিন শুধু থানাই ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ হয়নি, ভেঙে পড়ে পুলিশের চেইন অব কমান্ডও। ওই দিনের সহিংস পরিস্থিতিতে জীবনরক্ষায় কর্মস্থল ছেড়ে যান অনেক পুলিশ সদস্য। সড়কে যান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব থেকেও সরে যান ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশ সদস্যদের বারবার কাজে ফেরার নির্দেশ দিলেও এখনও কর্মস্থলে ফেরেননি অনেকে।
রাষ্ট্রক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর থেকেই ঊর্ধ্বতনদের আদেশ অমান্য করছেন অধস্তন অনেক পুলিশ সদস্য, এমন অভিযোগ আসছে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে রাজধানীর কাকরাইলে জনসম্মুখেই ঘটে এমন ঘটনা। ওই দিন বাংলাদেশের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) অধীনে থাকা অডিটররা সড়ক অবরোধ করলে কাকরাইলের আশপাশসহ রাজধানীর বড় অংশজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সড়ক থেকে আন্দোলনকারীদের সরাতে ‘অ্যাকশনে’ যাওয়ার নির্দেশ দিলেও অধস্তন কর্মকর্তারা নির্বিকার ছিলেন। এ ঘটনায় দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়া এই ঘটনায় সোশাল মিডিয়ায় চলছে সমালোচনা। মো. মনিরুল ইসলাম নামে একজন ফেইসবুকে লিখেছেন, “সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অধীনস্তদের এমন আচরণ স্বাভাবিক! বড় ধরনের ট্রমার মধ্য দিয়ে দিনগুলো পার করেছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের কাউন্সিলিং করানোর বিকল্প নাই। তাদের মধ্যে এই বোধ তৈরি করতে হবে যে- কোনটা যৌক্তিক, কোনটা অযৌক্তিক। কোনটা জনস্বার্থ আর কোনটা ব্যক্তিস্বার্থ!”
দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে বিভিন্ন অভিযোগে উত্তেজিত জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে; দলবদ্ধ পিটুনির মতো ঘটনাও ঘটছে। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যা করা হয়, যিনি পঙ্গু ছিলেন।
বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, এতদিন পুলিশ নিয়ে নাগরিকদের মনে যে ভীতি বা আতঙ্ক ছিল, সেটা আর নেই। এতে আইন না মানার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
ট্রাফিক পুলিশের নির্দেশ না মেনে তর্কে জড়ানোর ভিডিও ছড়িয়েছে সোশাল মিডিয়ায়।
একটি ভিডিও রেকর্ড ফেইসবুকে ছেড়ে নিয়াজ মোহাম্মদ নামে এক পুলিশ সদস্য লিখেছেন, “হেলমেট নাই, ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই, গাড়ির কাগজ নাই, উল্টা পথে ড্রাইভিং.. তার পরেও কিছু বলা যাবে না। বরং ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট না করলে গাফিলতি। দয়া করে বলবেন কি এই পরিস্থিতিতে কি করা উচিত?”
শুধু ট্রাফিক আইনই ভঙ্গ নয়, ৫ আগস্টের পর থানার ওসিকে ফোনে মাদক কারবারির হুমকি দেওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমেও এসেছে। তাতে বলা হয়েছে, একজন মাদক কারবারি রাজধানীর একটি থানার ওসিকে ভিডিও কলে মাদক দেখিয়ে হুমকি দিয়ে বলেন, “আগে বহুবার গ্রেপ্তার করেছেন, সাহস থাকলে এবার আসেন, গ্রেপ্তার করেন।”
পুলিশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সাব্বির আহমেদ নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী বলেন, “কিছুদিন আগে নিরাপরাধ মানুষও পুলিশি হেনস্তার ভয়ে থাকতো। আর এখন অপরাধীরাও পুলিশকে পাত্তা দিচ্ছেন না। দুটি পরিস্থিতিই পুলিশের জন্য বিব্রতকর।
“পুলিশকে নিজের কাজের মাধ্যমেই এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমরা এমন পুলিশ চাই, যেখানে নিরাপরাধ মানুষ তাদের দেখলে ভরসা পাবে, আর অপরাধীরা পাবে ভয়।”
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
রাষ্ট্রক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর পুলিশের চেইন অব কমান্ডের নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্সের বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “গত ৫ আগস্টের পর থেকে এই সমস্যাটা তৈরি হয়েছে। এসব ঘটনার ক্ষেত্রে হয়তো ঊর্ধ্বতন পুলিশের কমান্ডগুলো আইনানুগ ছিল না। যে কমান্ডগুলো তারা করছিল, সেগুলো পুলিশ প্রবিধান বা পিআরবি যেটা আছে, সেটার অনুযায়ী হয়নি।
“পুলিশ সদস্য সবাই বিপথগামী না। বিবেকবান অনেক ভালো পুলিশ অফিসার আছেন, যারা দেশ এবং রাষ্ট্রের জন্য ভালো কিছু করতে চান। তারা ওই প্রবিধানগুলির আলোকেই কাজ করতে চাচ্ছিল। পুলিশ বাহিনী পরিচালিত হয় চেইন অব কমান্ড মেইনটেইন করে। কিন্তু এরপরও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যখন কোনও কমান্ড করেন, তখন অনেক ক্ষেত্রে জুনিয়র কর্মকর্তা সেটা পালন করতে পারেন না।”
তিনি বলেন, “কাকরাইলের ওই ঘটনায় জুনিয়র সদস্যরা যখন দেখলেন ঊর্ধ্বতনের কমান্ড মানলে একটা অন্যায় কাজ হচ্ছে, একটা জনবিরুদ্ধ কাজ হচ্ছে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হচ্ছে। কিংবা যে আন্দোলন হচ্ছে, সেটার প্রতি জনসমর্থন আছে; তখনই কিন্তু তারা সেটা মানা থেকে বিরত থেকেছেন। তবে এর আগে অতীতে কিন্তু কখনোই এই ঘটনা ঘটেনি।
“গত ১৫ বছরে পুলিশ কিন্তু এমনভাবে চেইন অব কমান্ড কখনও ভাঙেনি। ঊর্ধ্বতনরা যা বলেছে, তাই হয়েছে। যখন উপর থেকে কোনও হুকুম এসেছে, তখন জুনিয়ররা ‘ইয়েস’ ছাড়া কেউ ‘নো’ বলতে পারেননি; সেটা ল ফুল হোক কিংবা আন ল ফুল হোক। এই জাগাটা অতীতে হয়তো বুঝতে পারেনি। কিন্তু লাস্ট মুহূর্তে তারা যখন বুঝতে পেরেছে, তখন হয়তো চেনই অব কমান্ডটা তারা ভেঙেছে। তারা ভেবেছে সবখানেই একটা পরিবর্তন হতে যাচ্ছে, এই মুহূর্তে আর অন্যায় কমান্ড মানা সম্ভব না।”
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, “বিভিন্ন কারণে পুলিশ বাহিনীটা এখন রাষ্ট্রের বিশ্বস্ততার জায়গায় বা জনগণের বিশ্বস্ততায় শূণ্যের কোটায় চলে গেছে। অবশ্যই এই অবস্থার উত্তরণ করতে হবে আমাদের। এটা জাতীয় দায়িত্ব।
“এ থেকে উত্তরণের জন্য আমরাও কাজ করছি, আপনারাও (সাংবাদিক) কাজ করেন। আমরা সবাই মিলে যদি কাজ করি তাহলে তারা (পুলিশ) একটা কনফিডেন্স পাবে। এখান থেকে আমরা একটু বেটার পুলিশিং বের করতে পারি কিনা সেজন্যই আমরা কাজ করছি।”
সাধারণ মানুষ পুলিশকে পাত্তা না দেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “এমন অবস্থার সৃষ্টি কিন্তু একদিনেই হয়নি। বাহিনী সৃষ্টির সময় থেকেই কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনার পরও পুলিশের যে কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা ছিল, সেটার কারণে নিরাপরাধ মানুষও পুলিশেকে ভয় পেত। কিন্তু ৫ আগস্টের পর আগের সেই আত্মবিশ্বাসের জায়গা কিংবা কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছে। যার ফলে জনগণ পুলিশকে আর কিছু মনে করছে না।
“বর্তমানে দেখবেন পুলিশ খুব নম্র হয়েছে। জনগণের সঙ্গে তাদের যে ভদ্রচিত ব্যবহার করা উচিত, সেটা তারা করতে শুরু করেছে। কারণ, পুলিশ বুঝতে পেরেছে- এটা না করলে জনগণের সঙ্গে তাদের আস্থায় যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে, সেই সঙ্কট থেকে উত্তোরণের কোনও উপায় নেই। এ কারণে হাইকমান্ড থেকেই পুলিশকে এভাবে গাইড করা হচ্ছে। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করার জন্য তারা কিছুটা মোটিভেটেড হয়েছে। এজন্য এই মুহূর্তে পুলিশের কিছু ট্রেনিং দরকার।”
অপরাধ বিজ্ঞানের এই শিক্ষক বলেন, “বর্তমানে পুলিশের সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে জনগণ যদি তাদের কথা না শুনে তাহলে একটা বড় ভুল করবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু এটা সঠিকভাবে করার জন্য জনগণেরও সচেতনতা খুবই প্রয়োজন। আর সবচেয়ে সমস্যা- মানুষ পুলিশের কাছ থেকে কী কী সেবা, কতটুকু সেবা পেতে পারে—সে বিষয়ে কেউ সচেতন না। এজন্য ক্যাম্পেইং দরকার, বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সংলাপ দরকার।
“পুলিশের সঙ্গে জনগণের যে আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে, সেক্ষেত্রে সমস্যাগুলি কী কী- তা আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। এসব বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছি। কিছু সচেতনতামূলক লিফলেট তৈরি করেছি। খুব শিগগিরই সেগুলো মানুষের মাঝে বিতরণ করা হবে।”
পুলিশ কী বলছে
ঊর্ধ্বতনের আদেশ না মানার বিষয়ে পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়। নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “গত ৫ আগস্ট থেকেই বেশিরভাগ পুলিশ সদস্য একটা ট্রমার মধ্যে আছেন। ঊর্ধ্বতনের আদেশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক সাধারণ পুলিশ সদস্যরাও জনগণের শত্রু হয়ে গিয়েছিলেন। তাই আন্দোলনের সময় জনগণের রোষের শিকার হয়েছেন নিচু পদমর্যাদার সদস্যরাই। তাই ঊর্ধ্বতনরা আদেশ দিলেই বিনাবাক্যে মেনে নেওয়ার বিষয়ে এখন দ্বিধা তৈরি হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে এই সমস্যা কমছে।”
সাধারণ মানুষের আইন না মানার বিষয়ে তিনি বলেন, “পুলিশ এখনও পুরোপুরি কাজ শুরু করতে পারেনি। অস্ত্র যানবাহন বিভিন্ন বিষয়ে সঙ্কট আছে। এটার সুযোগ নিচ্ছে দুষ্কৃতকারীরা।”
তবে পুলিশের চেইন অব কমান্ডে কোনও সমস্যা নেই বলে দাবি করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান। তার দাবি, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সৃষ্ট ট্রমার কারণে এমন ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। পুলিশ সম্পূর্ণ পেশাদার একটি বাহিনী। তারা দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে।
সাধারণ মানুষের আইন না মানার প্রবণতার বিষয়ে তিনি বলেন, “ঢাকার যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ৪ হাজার ট্রাফিক সদস্য দিনরাত পরিশ্রম করছেন। কোথাও কোনও আইন ভাঙা হলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আর দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় জনগণকেও সচেতন হতে হবে।”
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক সাগর বলেন, “পুলিশের বিভিন্ন রেঞ্জ, ইউনিটের নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। পুলিশের সঙ্গে জনগণের আস্থার সম্পর্ক তৈরিতে কাজ করা হচ্ছে। পুলিশি সেবার মানোন্নয়নে কার কী দায়িত্ব- সে বিষয়ে অধস্তনদের ব্রিফ করা হচ্ছে।”