বাড্ডা আলাতুন্নেছা স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র হাসিবুর রহমান সিয়াম। দুপুরের খাবার খেয়ে মাকে বলে সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের কাজে বের হয়েছে। বাড্ডা গুলশানের লিংক রোডের মাথায় দায়িত্ব পালন করছে সিয়াম। প্রতিটি গাড়িকে যততত্র না দাড়াঁতে ইশারা দিচ্ছে। চালকও এই ছোট ছেলেটির ইশারায় সায় দিয়ে নির্ধারিত স্থানে পার্কিং করছেন।
শুধু সিয়ামই নয়, তার থেকে ছোট ও বড় অনেক শিক্ষার্থীকে সড়কে দাড়িঁয়ে এমন দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
স্বেচ্ছাসেবী এসব শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব পালন এবং যানজট মুক্ত সড়ক দেখে খুশি গাড়ি চালকসহ সড়কে চলাচলকারী বিভিন্ন স্তরের মানুষ।
বৃহস্পতিবার রাত পোনে নয়টাতেও সিয়াম তার দায়িত্ব পালন করেছে। এ সময় তার কাছে জানতে চাইলে সে বলে, “বহুদিন পর স্কুল খুলেছে, ক্লাস তেমন হয়নি। তারপরও সব ক্লাস শেষ করে বাসায় এসে দুপুরের খাবার খেয়ে আম্মুকে বলে বের হয়েছি।”
সড়কে যানজট নিয়ন্ত্রণের এ কাজ করতে কে বলেছেন, বা এই কাজ করার বিষয়টি কীভাবে জানা গেল।
এমন প্রশ্নের জবাবে সিয়াম বলে, “আমাকে কেউ বলেনি। গতকাল টিভিতে দেখেছি বড় ভাইয়েরা কাজ করছেন। এইজন্য আজকে আমি নিজে থেকেই বের হয়েছি। এখানে দেখলাম অনেকেই কাজ করছেন, এইজন্য আমিও করছি। ভালো লাগছে। অনেকেই আদর করছেন। কেউ কেউ পানি, খাবার দিয়েছেন।”
পাশেই থাকা আরেক স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থী সোনিয়া আক্তার। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স করছেন।
তিনি বলেন, “এটা আমাদের দেশ, আমরাই দেশকে সাজাবো। সবাই যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে কিছুটা হলেও কাজ করে, তাহলেই আমাদের দেশ অনেক সুন্দর হবে।”
আপনি কখন এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি বিকাল তিনটার দিকে এসেছি। এখন পর্যন্ত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। এখানে সবাই নিজ থেকেই এ কাজ করছেন। কারও কোনো চাহিদা নাই।”
চালকেরা আপনাদের কথা মানছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মানছে মানে, সাথে সাথে মানছে। ইশারা দিলেই থেমে যাচ্ছেন। তবে অনেকে হেলমেট ছাড়া বাইক নিয়ে বের হয়েছেন। এটা প্রথম দিন বেশি থাকলেও এখন তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। দু একজন আসলেও আমরা তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করছি।”
উত্তর বাড্ডা ইউটার্ন মোড়ে দায়িত্ব পালন করছেন ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শিক্ষার্থী মিজু আহমেদ।
তিনি বলেন, “এই সড়ক নিয়ন্ত্রণের কাজ আমরা ২০১৮ সালেই দেখিয়ে দিয়েছি। সে সময় আমাদের এক ছাত্র ভাই নিহত হওয়ার ঘটনায় আমরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করেছিলাম। তখন কিন্তু পুরো সড়ক নিয়ন্ত্রণ করে দেখিয়ে দিয়েছি।
“অনেক রক্ত আর প্রাণের বিনিময়ে আমরা দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এখন দেশটা আমাদের, দায়িত্বও আমাদের। ট্রাফিক পুলিশ না আসা পর্যন্ত আমরা যার যার জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করছি।”
এ দায়িত্বের কোনো সিডিউল আছে কিনা বা কোনও সমন্বয় আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ রকম কোনও সিডিউল বা নির্দেশনা নেই। আমরা যে যখন পারছি সড়কে এসে কাজ করছি। দেশ থেকে যেমন স্বৈরাচার হটাতে পেরেছি, আশা করি যানজটও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো।”
এই কাজে চালকসহ আশে পাশে অনেকেই সহযোগীতা করছেন জানিয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, “অনেকেই এসে খাবার, পানি, ছাতা দিয়ে যাচ্ছেন। সবাই এখন স্বাধীনভাবে কথা বলছেন। এটাই আমাদের প্রাপ্তি।”
সড়কে কথা হয় সিএনজি চালক মামুনের সঙ্গে। তিনি সড়কের এই নিয়ন্ত্রণ দেখে বেজায় খুশি।
তার ভাষায়, “এখন ঘুষ নাই, পুলিশের ভয় নাই। কোনো চাঁদা নাই। খুবই ভালো লাগছে। নির্ভয়ে গাড়ি চালাইতাছি।”
আসমানী বাসের চালক সাইফুল মুখে গালভরা হাসি নিয়ে বলছেন, “অনেক ভালো লাগছে। আমরা এখন স্বাধীন। মামা পুলিশের ভয় নিয়ে গাড়ি চালাতে হতো। চাঁদার ভয় থাকতো। যানজটতো থাকতোই। এখন নিয়ম মেনে গাড়ি চালাই। এমন থাকলে আমাদের জন্যই ভালো।”
বৃহস্পতিবার ঢাকা শহরের কাকরাইল, মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টন, মৎস্য ভবন, মগবাজার, কারওয়ানবাজারসহ দেশের প্রধান প্রধান সড়কে দায়িত্ব পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। অনেক সড়কে অ্যাম্বুলেন্স এবং সরকারি জরুরি গাড়ি চলাচলের জন্য পৃথক লেন তৈরি করে রেখেছেন তারা।
তাদের এই দৃশ্য দেখে সন্তোষ প্রকাশ করছেন সাধারণ যাত্রীরা। সবার মুখেই ছিল সন্তুষ্টির হাসি। নির্ধারিত স্থানে থামছে বাস, লাইন মেনে চলছে বাইক, রিকসা। কোথাও নেই গাড়ির দীর্ঘ লাইন।
বাস যাত্রী তৌফিক বলেন, “আমরা এমন ঢাকাই চাই। ঘুষখোর পুলিশ চাই না। ছাত্রদের কারণে এখন গাড়ি চালকেরাও সাবধান। সড়কে এমন শৃংখলা ট্রাফিক পুলিশও দেখাতে পারেনি।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। এ অবস্থায় ভেঙ্গে পড়ে ট্রাফিক ব্যবস্থা। দেশের কোথাও নেই কোনও পুলিশ।
এ অবস্থায় ৬ আগস্ট থেকে সড়কে শৃংখলা ফেরাতে নামে শিক্ষার্থীরা। মাত্র ৩ দিনে তারা নগরের প্রতিটি সড়কে যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে তা আগে দেখা যায়নি কখনও। সম্মিলিত চেষ্টা ও দেশের প্রতি ভালবাসা থাকলে যে আসলেই চিত্র পাল্টে দেয়া সম্ভব তা শিক্ষার্থীরাই প্রমাণ করেছে।
কোন ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়া এত ভালো তদারকিতে অবাক নগরবাসী। তাই এসব শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত সাফল্য কামনা করেছেন তারা। তাদের ভাষায়, আমরাই পাল্টে নিব আমাদের দেশটাকে। সাজাবো নতুন করে।