Beta
বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫

শোর তুলে ভোটে, এখন আছে চুপসে

ঢাকার মিরপুরে বিএসপির কার্যালয়।
ঢাকার মিরপুরে বিএসপির কার্যালয়।
[publishpress_authors_box]

লম্বা একটি কক্ষে ৮-১০টি চেয়ার অগোছালোভাবে পড়ে আছে। খুলে রাখা তিনটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র টেবিলের ওপরে পড়ে। আরেক পাশে টেবিলের ওপর বড় একটি চেয়ার। কাছেই ঝুলছে একটি লুঙ্গি। এই দৃশ্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএমের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের। দলটি নির্বাচনে কমিশনে নিবন্ধিত।

নিবন্ধিত আরেক দল বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) কেন্দ্রীয় কার্যালয় অবশ্য দুই কক্ষবিশিষ্ট। দলটির চেয়ারম্যানের বাসার ওপরে সেই কার্যালয়। সেখানেও গিয়ে দেখা গেল চার-পাঁচটি টেবিল। তার মধ্যে তিনটিতে কম্পিউটার রয়েছে। অগোছালো কাগজপত্র পড়ে আছে বহু জায়গায়।

আরেকটি দল তৃণমূল বিএনপি। এক ভবনের আইনজীবীদের চেম্বারের সামনে আনুমানিক ১০ ফুট লম্বা ও ৬ ফুট চওড়া অভ্যর্থনা কক্ষেই তাদের কার্যালয়। সেখানে ছোট একটি টেবিল নিয়ে বসে আছেন একজন নিরাপত্তাকর্মী। দুই পাশে রাখা চারটি চেয়ার। তা অতিক্রম করে ঢুকতেই হাতের ডানে চোখে পড়বে একটি একটি পিভিসি ব্যানার। যেখানে লেখা- কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বাংলাদেশ জাতীয় জোট-বিএনএ ও তৃণমূল বিএনপি।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির পরে যে দলের প্রার্থী ছিল সবচেয়ে বেশি, সেই দলটিই তৃণমূল বিএনপি। ১৩৩টি সংসদীয় আসনে প্রার্থী ছিল তাদের, তবে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একসঙ্গে ১০ জন বসার জায়গাও হবে না।

দুদিন আগে এই দলগুলোর কার্যালয়ে গিয়ে এমন দৃশ্যই দেখা গেছে। বিএসপির কার্যালয়ে গুটিকয়েক কর্মীর দেখা মিললেও তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমের কার্যালয় পুরোপুরি ফাঁকা।

গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পাঁচ মাসেরও কম সময় আগে নিবন্ধন পায় বিএনএম ও বিএসপি। তৃণমূল বিএনপি নিবন্ধন পায় বছর খানেক আগে। তিনটি দলের নিবন্ধন পাওয়ার প্রক্রিয়া নিয়েও উঠেছিল প্রশ্ন।

ভোটের আগে নানা আলোচনায় এই দলগুলো উঠে এসেছিল প্রচারের আলোয়। ঘটা করে মনোনয়নপত্র বিক্রি করেছিল, দলগুলোতে ভেড়ার মিছিলও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু ভোটের পর এখন তাদের সবগুলোই গেছে চুপসে। আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না দল তিনটি।

দলগুলোর কোনটি বলছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যে সিদ্ধান্ত নেবে, তারাও সেটা অনুসরণ করবে। কেউ সিদ্ধান্ত নেবে রোজার ঈদের পর।

আগামী ৮ মে শুরু হচ্ছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। নিবন্ধিত দলগুলো নিজেদের প্রতীকে এই নির্বাচনে প্রার্থী দাঁড় করাতে পারবে। সেজন্য দলগুলোর ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির স্বাক্ষরসহ প্রার্থী তালিকা সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তাকে দিতে হবে।

বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের বর্জনের মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী দেওয়ার পাশাপাশি দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ারও সুযোগ করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।

বিএনপি উপজেলা নির্বাচনেও আসছে না দেখে আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে তাদের দলীয় প্রতীকের প্রার্থী না দেওয়ার সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে নিয়েছে।

সংসদ নির্বাচনে শোর তুলে অংশ নিলেও ভোট প্রাপ্তিতে তলানীতে থাকার পর বিএসপি, বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপি সাংগঠনিক তৎপরতাবিহীন হয়ে পড়ে। উপজেলা নির্বাচন নিয়েও তাদের তোড়জোড় চোখে পড়ছে না।

বিএনএমের কার্যালয়ে গিয়ে এমন অগোছাল অবস্থা দেখা গেছে।

১০ মাসে ৩ বার কার্যালয় বদল বিএনএমের

রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পাওয়ার জন্য বিএনএম যে আবেদন করে, সেখানে তারা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা দিয়েছিল- ৫৫/১, পুরানা পল্টন। সেখানে তার কোনও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পরে ইসির নিবন্ধন পাওয়ার সময় মহাখালীর আমতলীতে একটি দুই কক্ষের অফিস ভাড়া নেয় দলটি।

তবে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই নতুন কার্যালয় নেয় দলটি; গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বরের কাছে প্রায় আড়াই হাজার বর্গফুটের কার্যালয়। মাসিক ভাড়া ২ লাখ টাকার মতো।

তবে সেখানেও নেই দলটি। এখন গুলশান ২ নম্বরের ১১৩ নম্বর সড়কের একটি আবাসিক ভবনে নতুন কার্যালয় তাদের।

গত সোমবার বিকালে বিএনএমের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গেলে ফটকে থাকা নিরাপত্তারক্ষী আব্দুল করিম বলেন, “নতুন অফিস তো। এখনও কাজ স্টার্ট করে নাই।”

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ভেতরে যেতে চাইলে তিনি বলেন “দাঁড়ান, আমি পারমিশন নিয়ে আসি।”

কিছুক্ষণ পর অন্য একজন এসে প্রধান ফটক খুলে দিয়ে বলেন, “চেয়ারম্যান স্যার ওপরে আছেন।”

কার্যালয়ে গিয়ে কোনও নেতা-কর্মীর দেখা না মিললেও পাওয়া যায় দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরকে।

আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বিএনপি হয়ে এখন বিএনএমে রয়েছেন শাহ আবু জাফর। ওই তিনটি দল থেকেই এমপি নির্বাচিত হওয়া প্রবীণ রাজনীতিক গত সংসদ নির্বাচনে বিএনএমের হয়ে ফরিদপুর-১ আসনে প্রার্থী হয়ে জামানত হারান তিনি।

দলীয় প্রতীক নোঙরে ৫৪টি আসনে প্রার্থী ছিল বিএনএমের। একজন বাদে সব প্রার্থীরই জামানত খোয়া গেছে।

উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী থাকবে কি না- প্রশ্নে শাহ আবু জাফর বলেন, “আমরা এখনও বসি নাই। বসব। তবে আওয়ামী লীগ যদি দলীয় প্রতীকে না দেয়, তাহলে আমাদের না দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”

সাংগঠনিক কোনও তৎপরতা দেখা না গেলেও তিনি দাবি করেন, তাদের কাজে কোনও ভাটা পড়েনি।

ভোটের পর নিষ্ক্রিয় থাকার বিষয়টি স্বীকার করলেও সেজন্য বারবার দলীয় কার্যালয় পরিবর্তনকে কারণ দেখান তিনি।

“তফসিলের পর আমরা অফিস শিফট করলাম। তারাও (ভবন মালিক) বললে, ভোটের পর আবার চলে যেতে হবে। ছেড়ে দিয়ে এটা নিলাম। এভাবে আমাদের কর্মকাণ্ড আগাচ্ছে। রোজার পরে নিশ্চয়ই আমাদের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে।”

বার বার কার্যালয় বদলের কারণ জানতে চাইলে শাহ আবু জাফর বলেন, “যার বাসা, তারা তো পলিটিক্যাল পার্টিকে অফিস ভাড়া দিতে চায় না। অনেক সময় ব্যক্তিগতভাবে নিই। পলিটিক্যাল কার্যক্রম শুরু করলে মালিক না করে দেয়। এই হলো সমস্যা।”

বিএসপির কার্যালয়ের ভেতরে গুটিকয়েক কর্মীর দেখা পাওয়া গেছে।

বিএসপির সিদ্ধান্ত ‘ঈদের পরে’

ইসিতে দেওয়া ঠিকানা ধরে এক দুপুরে মিরপুরের শাহ আলীবাগে গিয়ে পাওয়া যায় বিএসপির কার্যালয়। গাঢ় ধূসর রঙের ভবনে ঝুলছে সাইনবোর্ড। তাতে লেখা- কেন্দ্রীয় কার্যালয় সুপ্রিম পার্টি।

ভবনের ফটকের সামনে দাঁড়াতেই বেরিয়ে এলেন নিরাপত্তাকর্মী মো. মন্টু হাওলাদার। সুপ্রিম পার্টির কথা জানতে চাইলেই তিনি বলেন, “এহন তো বন্ধ সব। পীর সাহেব তো চিটাগাং গেছে দুইদিন আগে। এহন তো তেমন লোকজন আহে না।”

মন্টুর অনুমতি নিয়ে ভবনে ঢুকে চতুর্থ তলায় সুপ্রিম পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল দরজা খোলা। তিন-চারটি টেবিল। তিনটি কম্পিউটার। দুজন কম্পিউটারের সামনে বসে আছেন। একজন লোক তাদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। কথা বলে জানা যায়, তিনি দলের দপ্তর সম্পাদক ইব্রাহিম মিয়া।

সুপ্রিম পার্টি উপজেলা ভোটে দলীয় প্রতীকে প্রার্থী দেবে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এনিয়ে আমাদের একটা মিটিং হওয়ার কথা ছিল। সেটা ক্যান্সেল হয়েছে। পরে বসে সিদ্ধান্ত নেব।”

সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভাণ্ডারী এই দলটির চেয়ারম্যান। দলটির প্রতীক একতারা। সংসদ নির্বাচনে ৭৯ আসনে তাদের প্রার্থী ছিল। প্রায় সবাই জামানত হারিয়েছেন।

তবে দপ্তর সম্পাদক ইব্রাহিম মিয়ার দাবি, তারা আশানুরূপ সাফল্য পেয়েছেন।

“ভোট কি হইছে, না হইছে, সেইদিকে আমরা বলতে চাই না। তারপরও নিবন্ধন পাওয়ার পর আমাদের তেমন প্রস্তুতি ছিল না। যতটুকু সাফল্য আসা দরকার ছিল, আসছে।”

ভোটের পর দলীয় কার্যক্রমে কোনও ভাটা পড়েনি বলে দাবি করেন তিনি; বরং বলেন, “আমাদের কার্যক্রম বিদ্যুৎ গতিতে চলছে।”

কী কার্যক্রম চলছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মাইজভাণ্ডার শরীফের প্রোগাম হইছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি পার্টির চেয়ারম্যানের জন্মদিন ছিল।”

ঢাকায় কোনও অনুষ্ঠান হয়েছে কি না- প্রশ্নে ইব্রাহিম বলেন, “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ‍দিবসের অনুষ্ঠান হয়েছে। তবে আমরা আসলে গুছাইয়া উঠতে পারি নাই।”

উপজেলায় দলীয় প্রতীকে প্রার্থী দেওয়া, না দেওয়ার বিষয়ে ঈদের পর সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন বিএসপি চেয়ারম্যান সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভাণ্ডারী।

টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “উপজেলা ভোট নিয়ে এখনও দলীয় সিদ্ধান্ত হয়নি। ঈদের পরে সিদ্ধান্ত নেব।”

ঈদের দুদিন পর ১৪ এপ্রিলই প্রথম ধাপে ১৫২ উপজেলায় মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন, বিষয়টি তুলে ধরলে তিনি বলেন, “যারা প্রার্থী হতে চায়, তারা হবে। সমস্যা নাই।”

আইনজীবীদের চেম্বারের সামনে অভ্যর্থনা কক্ষেই তৃণমূল বিএনপির কার্যালয়।

তৃণমূল বিএনপিও সিদ্ধান্তহীন

২০১৫ সালে তৃণমূল বিএনপি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন বিএনপির এক সময়ের নেতা নাজমুল হুদা। তবে দলটি নিবন্ধন পায় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বিএনপি থেকে দুই নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকারকে নিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বর দলটির প্রথম কাউন্সিল হয়।

নিজেদের সোনালী আঁশ প্রতীকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১৩৩টি আসনে প্রার্থী দিলেও কোনওটিতে জয় পায়নি তৃণমূল।

ঢাকার পল্টনের মেহেরবা প্লাজায় দলের প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল হুদার আইনজীবী হিসেবে ব্যক্তিগত চেম্বারেই তৃণমূল বিএনপির কার্যালয়। সেখানে গেলে প্রথমেই ১০ ফুট দীর্ঘ এবং ৬ ফুট প্রস্থের কক্ষটিকে অভ্যর্থনা কক্ষ মনে হবে। আসলে এটিই দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়।

সেখানে থাকা নিরাপত্তাকর্মী বিপুল ভূইয়ার কাছে এই কার্যালয়ে শেষ কবে সভা হয়েছে জানতে চাইলে উত্তর আসে, “ঠিক জানি না।” ভোটের পরে হয়েছে কি না, প্রশ্নেও আসে একই উত্তর। শমসের মবিন চৌধুরী আসেন কি না- জানতে চাইলেও তিনি বলেন, “ঠিক জানি না।”

পরে ফোনে যোগাযোগ করা হয় শমসের মবিনের সঙ্গে। উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে তৃণমূল বিএনপি অংশ নেবে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। দলের মহাসচিব দেশের বাইরে আছে। তিনি ফিরলে সিদ্ধান্ত নেব।”

নাজমুল হুদার মৃত্যুর পর মেয়ে অন্তরা সেলিমা হুদা দলের দায়িত্ব নিলেও ভোটের আগে দলটিতে যোগ দিয়ে কাউন্সিলে শমসের মবিন হন চেয়ারম্যান, তৈমূর আলম হন মহাসচিব।

ভোটের পর দলটির অনেক প্রার্থী কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছিলেন।

সে বিষয়ে জানতে চাইলে শমসের মবিন বলেন, “এগুলো তো অনেক পুরাতন আলাপ। আপনি এগুলো কেন তুলছেন? সেসব জিনিস নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।”

অভ্যর্থনা কক্ষের মতো একটি স্থানে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখানে অফিস তো আগে থেকেই। নতুন দল সময় লাগবে আরও। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত