Beta
শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের এক সেতু ধসের প্রভাব বিশ্ববাণিজ্যে

Baltimore-bridge
[publishpress_authors_box]

যুক্তরাষ্ট্রের কয়লা বিশ্বজুড়ে রপ্তানির গুরুত্বপূর্ণ পথ হচ্ছে বাল্টিমোর বন্দর। কিন্তু সেতু ধসে পড়ায় ছয় সপ্তাহ এই বন্দরটি থেকে কয়লা রপ্তানি থাকবে বন্ধ।

আবার এই বন্দর দিয়ে নির্মাণ যন্ত্রপাতি ও কৃষি পণ্য পরিবহন হয়। ক্রুজ টার্মিনাল হিসেবে আয়তনের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বন্দর বাল্টিমোর।

ফলে সব মিলিয়ে পাটাপস্কো নদীর এই সেতু ধসে পড়ার বড় প্রভাবই পড়তে যাচ্ছে বিশ্ববাণিজ্যে, যে খবর আসছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।

মঙ্গলবার একটি জাহাজের ধাক্কায় ভেঙেচুরে নদীতে পড়ে যায় ৪৭ বছর বয়সী ফ্রান্সিস স্কট কি ব্রিজ।

সেতুটি ধ্সের কারণে বাল্টিমোর বন্দর থেকে অন্তত ৬ সপ্তাহ কয়লা রপ্তানি বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে পেনসিলভেনিয়াভিত্তিক কয়লা বাজারজাতকরণ কোম্পানি এক্সকোল এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস এলএলসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আর্নি থ্র্যাশার

এতে প্রায় ২৫ লাখ টন কয়লার পরিবহন আটকে যাবে, যা বিশ্বব্যাপী কয়লা সরবরাহে ঘাটতি তৈরি করতে পারে।

গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭ কোটি ৪০ লাখ টন কয়লা রপ্তানি হয়েছে। বাল্টিমোর বন্দরটি দেশটিতে কয়লা রপ্তানির জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম টার্মিনাল।

থ্র্যাশার বলেন, “বাল্টিমোর থেকে কিছু কয়লা হয়ত অন্যান্য বন্দর দিয়ে রপ্তানি হতে পারে। তবে অন্যান্য বন্দরগুলোও বেশ ব্যস্ত। সেসব বন্দর দিয়ে কয়লা পরিবহনের একটা নির্দিষ্ট সীমাও আছে। ফলে বাল্টিমোর থেকে রপ্তানি হওয়া সব কয়লা অন্যান্য বন্দর দিয়ে পরিবহন করা সম্ভবপর হবে না।”

ভেঙে পড়েছে ফ্রান্সিস স্কট কি ব্রিজ।

সাগর পথে বিশ্বে কয়লা আনা-নেওয়ার ২ শতাংশ পরিবহন হয় বাল্টিমোর বন্দর দিয়ে। ফলে সেতু ধস বিশ্ববাজারে কয়লার দামে বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন না থ্রেশার।

তবে ভারতকে ভুগতে হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, বাল্টিমোর থেকে যে কয়লা পরিবহন হয়, তার মধ্যে প্রচুর ভারতগামী কয়লা রয়েছে, যা দেশটির বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়।

ভারতের বার্ষিক কয়লার চাহিদা ১০০ কোটি টনেরও বেশি। দেশটি গত অর্থবছরে প্রায় ২৩ কোটি ৮০ লাখ টন কয়লা আমদানি করেছে, যার মধ্যে প্রায় ৬ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

তার মধ্যে বাল্টিমোর বন্দর থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টন কয়লা গেছে বলে বাজার বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান এনার্জি অ্যাসপেক্টসের এক গবেষণা থেকে জানা যায়।

এনার্জি অ্যাসপেক্টস আরও ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, বাল্টিমোর থেকে জাহাজ চলাচল সর্বাধিক দুই বা তিন সপ্তাহের জন্য ব্যাহত হবে। কিছু কয়লার চালান সাময়িকভাবে নরফোক, ভার্জিনিয়াসহ অন্যান্য বন্দরে পাঠানো হতে পারে।

কয়লা সরবরাহে এই ঘাটতি ইউরোপীয় বাজারের তুলনায় এশিয়ার বাজারকে বেশি প্রভাবিত করবে। কারণ বাল্টিমোর বন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়া কয়লার বেশিরভাগ এশিয়ায় আসে। এসব কয়লায় সালফারের পরিমাণ বেশি এবং ইউরোপীয় পাওয়ার স্টেশনগুলোর জন্য এই কয়লা উপযুক্ত নয়। কমোডিটি অ্যানালিটিক্স ফার্ম ডিবিএক্স এই তথ্য দিয়েছে।

বাল্টিমোর বন্দর যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ব্যস্ততম এবং দেশটির পূর্ব উপকূলে জাহাজ চলাচলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, বিশেষ করে সড়ক যানবাহন পরিবহনে।

মেরিল্যান্ড সরকারের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, গত বছর ৮০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের ৫২ মিলিয়ন টনের বেশি আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবণ হয়েছে বাল্টিমোর বন্দর দিয়ে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরগুলোর মধ্যে নবম সর্বোচ্চ।

সেতু ধসের পর পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্দরটিতে সব ধরনের পরিবহন চলাচল স্থগিত করা হয়েছে। এতে ওই অঞ্চলের বাণিজ্যের উপর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের সব সেতুর স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন

বাল্টিমোরের সেতুটি ভেঙে পড়ার পর শুধু এই নির্দিষ্ট কাঠামোরই নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের সব সেতুর সামগ্রিক স্বাস্থ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যার মধ্যে অনেকগুলোই খারাপ অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করা হয়।

মঙ্গলবার ভোরে কন্টেইনারবাহী জাহাজের ধাক্কায় ফ্রান্সিস স্কট কি ব্রিজ ভেঙে পড়ে নদীতে পড়ে ৬ নির্মাণ শ্রমিক নিখোঁজ হন। ওই শ্রমিকরা সেতুটিতে গর্ত মেরামতের কাজ করছিলেন।

ধারণা করা হচ্ছে, পাটাপস্কো নদীর হিমশীতল পানিতে ডুবে তারা মারা গেছেন। সেসময় নদীটির পানির তাপমাত্রা ছিল মাত্র ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই ঘটনায় কয়েকটি গাড়ি এবং একটি ট্রাক্টর-ট্রেইলারও নদীতে পড়ে যায়।

জাহাজের ধাক্কায় ধসে পড়ায় সেতুটির কাঠামোতেও কোনও ত্রুটি ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে; যদিও বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড বিষয়টি তদন্ত করার জন্য একটি টিম পাঠিয়েছে।

মেরিল্যান্ডের গভর্নর ওয়েস মুর বলেছেন, সেতুটি সম্পূর্ণভাবে নিয়মকানুন মেনেই বানানো হয়েছিল।

বাল্টিমোর শহরের দক্ষিণপশ্চিমে ২ দশমিক ৬ কিলোমিটারেরও বেশি দৈর্ঘ্যের সেতুটি নির্মাণ শেষে খুলে দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৭ সালে।

বলা হচ্ছে, সে সময়কার নিয়মগুলো বিশাল আকারের জাহাজের বয়সের চেয়ে পুরোনো। তখন পর্যন্ত বিশাল কনটেইনারবাহী জাহাজের যুগ শুরু হয়নি। ফলে সেতুর নির্মাণের নিয়মগুলো বিশাল জাহাজের কথা মাথায় রেখে বানানো হয়নি।

শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিভিল অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু বার বলেছেন, “ভিডিওতে সেতুটির কোনও সুস্পষ্ট কাঠামোগত ঘাটতি দেখা যায় না। তবে এটি এত বড় জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষে টিকে থাকার মতো করে তৈরি করা হয়নি।”

তিনি বলেন, ফ্রান্সিস স্কট কি সেতুতে জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষের চাপ ঠেকানোর জন্য অতিরিক্ত প্রতিরক্ষামূলক অবকাঠামো ছিল বলে মনে হয় না।

গত কয়েক দশকে পণ্যবাহী জাহাজের আকার ও নকশা ব্যাপকভাবে বড় ও পরিবর্তিত হওয়ার কারণে তা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শুধু গত এক দশকে কনটেইনার জাহাজের গড় সক্ষমতা প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে।

তবে আমেরিকান রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টেশন বিল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, বাল্টিমোরের সেতু ধসে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের সেতুগুলোর সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ সামনে চলে এসেছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি সেতুর মেরামতের প্রয়োজন রয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের সেতুগুলোর অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নত হয়েছে, তা ঠিক। তবে ৪৩ হাজারেরও বেশি সেতু এখনও খারাপ অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করা হয়।

সেগুলোকে সম্ভাব্য ধসের ঝুঁকিতে থাকা এবং কাঠামোগতভাবে ঘাটতিপূর্ণ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে।

২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন ১.২ ট্রিলিয়ন ডলারের একটি অবকাঠামো বিল পাস করে পুরোনো সেতু ও রাস্তাগুলো মেরামত করার জন্য। সম্প্রতি উইসকনসিনে একটি ক্ষয়িষ্ণু সেতু পরিদর্শন করার পর বাইডেন সেই বিলে আরও ১১০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ বাড়িয়েছেন।

সংঘর্ষের কারণ সম্পর্কে যা জানা যায়

শিপ-ট্র্যাকিং ডেটা থেকে জানা যায়, যে জাহাজটির ধাক্কায় সেতুটি ধসে পড়েছে, সেই ডালি ২৯০ মিটার (৯৪৮ ফুট) লম্বা একটি কার্গো জাহাজ। এটির ১০ হাজার কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতার। সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী জাহাজটি বাল্টিমোর থেকে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর উদ্দেশে রওনা করেছিল।

মেরিল্যান্ডের গভর্নর ওয়েস মুর বলেন, প্রাথমিক তদন্তে ব্রিজটি ধসে পড়ার কারণ হিসেবে দুর্ঘটনার বিষয়টিই উঠে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর বাল্টিমোর অফিস বলেছে, সেতুটি ধসে পড়ার সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের কোনও যোগ নেই।

মুর বলেন, জাহাজটির নাবিকরা এর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। ব্রিজটির একটি পিলারে ধাক্কা দেওয়ার আগে জাহাজটি থেকে মারাত্মক বিপদ সংকেত জারি করা হয়। এতে ধসে পড়ার আগে কর্তৃপক্ষ সেতুতে যানবাহন চলাচল সীমিত করতে সক্ষম হয়।

তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, এনডিটিভি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত