হুমকি যে কেবল ডোনাল্ড ট্রাম্প দিতে পারেন না, তা দেখিয়ে দিতে চাইছে কানাডা। পাল্টা ঘোষণায় অটোয়াও জানিয়ে দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক তারাও আরোপ করতে পারেন।
ট্রাম্প যদি কানাডার পণ্যের ওপর ঘোষিত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেই ফেলেন, তবেই এমন পদক্ষেপ নেবে কানাডা সরকার।
বাজার বিশ্লেষকরা ট্রাম্পের প্রথম আমলের পরিপ্রেক্ষিতে শঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, শুল্ক আরোপ নিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যকার উত্তেজনা বাণিজ্য যুদ্ধে গড়াতে পারে। আর এমনটা হলে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়বে।
কানাডার কর্মকর্তারা এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের একটি তালিকা তৈরি করছেন। যুক্তরাষ্ট্রকে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই পণ্যগুলো নির্বাচন করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে।
তালিকায় থাকা পণ্যগুলোর মধ্যে আছে, সিরামিক, ইস্পাত, বারবন ও জ্যাক ড্যানিয়েলস হুইস্কি, কমলা রস এবং পশুখাদ্যসহ অন্যান্য পণ্য।
তালিকা প্রণয়ন ও শুল্ক আরোপ পরিকল্পনা সংশ্লিষ্টরা সিএনএনকে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানিও এই তালিকায় রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানির উপর শুল্ক আরোপের বিষয়টি হবে কানাডার জন্য শেষ বিকল্প ব্যবস্থা।
যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের বিষয়ে চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি বলেই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তালিকায় পরিবর্তন আসতে পারে এবং এসবের ওপর ধাপে ধাপে শুল্ক আরোপ করা হতে পারে।
শুক্রবার অটোয়ায় এক সংবাদ সম্মেলনে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি বলেন, “আমি মনে করি, আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।”
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ সংক্রান্ত বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের তালিকা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদে বৈঠকের ঠিক আগেই তিনি একথা বলেন।
মেলানি বলেন, “আমি মনে করি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন কথা বলেন, তখন আমরা শুনি। আমাদের তাকে খুব গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও তার পরামর্শকরা জানুক, তিনি কানাডীয় পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করলে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে। কানাডারও শক্ত অবস্থান রয়েছে।”
কানাডা বিজনেস কাউন্সিলের সিইও গোল্ডি হাইডারের মতে, শুল্কারোপ কানাডীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। সেজন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
হাইডার সিএনএনকে জানান, সরকার সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে আলোচনা করেছে। একই সঙ্গে প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাল্টা শুল্কের বিষয়ে তাদের মতামত দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
হাইডার বলেন, “আমাদের সতর্কভাবে এটি ব্যাখ্যা করতে হবে যে, আমরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাব। অনেকে বলছেন, আমাদের শুধু তাদের শুল্কের মতো শুল্ক আরোপ করা উচিৎ। অন্যরা বলেছেন, প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা সংযমী হতে হবে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। আর কেউ শক্তিশালী প্রতিক্রিয়ার জানানোর পক্ষে মত দিয়েছেন।“
কানাডীয় ব্যবসায়ী নেতারা প্রায় এক বছর ধরে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর প্রতিটি কৌশলের পরিণতি এখনও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
বাণিজ্য যুদ্ধ
যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের উপর প্রয়োজনে শুল্ক আরোপের ঘোষণাটি এমনভাবে দেওয়া হয়েছে, যাতে বোঝা যায় যে অটোয়া পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্য যুদ্ধে যেতে ভীত নয়।
আর এই যুদ্ধে ট্রাম্পের মিত্ররা, প্রতিষ্ঠান ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মীদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে, এমনটাও বোঝাতে চায় অটোয়া।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো একাধিক সঙ্কটের মুখে গত সপ্তাহের শুরুতে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এসব সঙ্কটের মধ্যে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের হুমকিও একটি।
কানাডার এমন রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ট্রাম্প আরও চাপ সৃষ্টি করছেন। অথচ কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত মিত্র।
নির্বাচনে জয়ের পরদিনই ট্রাম্প বলেন, অটোয়া তাদের সীমান্ত দিয়ে মাদকের প্রবাহ বন্ধ না করলে কানাডার পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।
এছাড়া ট্রাম্প যুক্তি দিয়েছেন যে, কানাডার জন্য শুল্কের ক্ষতি এড়ানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম প্রদেশ হিসেবে যোগ দেওয়া।
নিজের সোশাল মিডিয়া ট্রুথ সোশালে গত সোমবার ট্রাম্প লেখেন, “কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হলে কোনো শুল্ক থাকবে না, কর কমে যাবে। তারা রাশিয়া ও চীনের জাহাজের হুমকি থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে, যেগুলো তাদের চারপাশে সবসময় ঘোরে।”
কানাডা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র কানাডা থেকে ৪১৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে কাঠ, সিমেন্ট, গাড়ি ও খনিজ পদার্থ। কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি তেলের সবচেয়ে বড় উৎসও।
ট্রাম্প কানাডার সঙ্গে একীভূত হতে ‘আর্থিক শক্তি‘ ব্যবহারের কথা খারিজ করেননি।
উল্টো তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের কানাডায় তৈরি কোনো জিনিসের প্রয়োজন নেই। তাদের সামরিক বাহিনী খুব ছোট। তারা আমাদের সামরিক বাহিনীর উপর নির্ভর করে। এজন্য তাদের খরচ দিতে হবে।“
দায়িত্বগ্রহণের প্রথম দিনেই মেক্সিকো ও কানাডা থেকে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ এবং চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প।
২০২২ সালে মেক্সিকো, কানাডা ও চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৩০ বিলিয়ন ডলার। ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনা কার্যকর হলে উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (ইউএসএমসিএ) ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।