Beta
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫

এশিয়ায় চীনকে টেক্কা দিতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ সামরিক মহড়া। ছবি: রয়টার্স।

এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ‍্যৎ কী? বারাক ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ দিকেই যুক্তরাষ্ট্র এমন প্রশ্নের মুখে পড়েছিল- মত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক সাময়িকী ফরেইন অ‍্যাফেয়ার্সের। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (সিএফআর) এই সাময়িকী প্রকাশ করে। অলাভজনক সংস্থা সিএফআর যাত্রা শুরু করেছিল ১৯২১ সালে।

দুই বিকল্প

যুক্তরাষ্ট্রের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল: চীন ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা ও প্রভাব বিস্তারের ফলে সামরিক আধিপত্য বজায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্রকে এশিয়ায় ব্যয় বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে হবে; অথবা, চীনের সামরিক আধিপত্য মেনে নিয়ে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে সীমিত সম্পদ খরচ করতে হবে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের আধিপত্য বিস্তারের চিন্তা বাদ দিয়ে শুধু চীনের প্রভাব ঠেকানোর চেষ্টা করতে হবে।

ওবামার উত্তরসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন উভয়ই প্রথম বিকল্পটি বেছে নেন। তারা এশিয়ায় সামরিক উপস্থিতিতে চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ওপর জোর দেন। তবে বাইডেন তার পূর্বসূরীদের চেয়ে ভিন্ন কৌশল নেন। তিনি দেখলেন, এশিয়ায় সামরিক ব্যয় খুব বেশি বাড়ালে যুক্তরাষ্ট্র বিপদে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণও এতে সমর্থন দেবে না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের খরচের বোঝা কমাতে তিনি ওয়াশিংটনের মিত্র ও অংশীদারদের নিয়ে একটি জোট গড়ার চেষ্টা করেন। গত তিন বছরে বাইডেন প্রশাসন সফলভাবে ফিলিপাইনে আরও কিছু সামরিক ঘাঁটিতে প্রবেশাধিকার অর্জন করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানে নতুন ত্রিপক্ষীয় একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে অকাস চুক্তি করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীকে পারমাণবিক ডুবোজাহাজ দেওয়া হবে।

তবে জোট করার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রয়োজনীয় সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। তার জোট গড়ার গতিও ধীর। যুক্তরাষ্ট্র এখনও এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোতে সামরিক প্রবেশাধিকার পায়নি এবং শক্তিশালী সামরিক উপস্থিতি তৈরি করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও অংশীদাররাও অস্ত্রে-শস্ত্রে যথেষ্ট সুসজ্জিত নয়। আরও বিপদের কথা হলো, এই দুর্বলতাগুলো কাটানোর জন্যও কোনও স্পষ্ট উপায় জানা নেই যুক্তরাষ্ট্রের। এশিয়ার সামুদ্রিক ভূগোল এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য চীনের হুমকিকে খাটো করে দেখায়। আর এ কারণেই বাইডেনের জোট গড়ার প্রক্রিয়া গতি পায়নি।

বাইডেনের সীমিত সাফল্য এই অঞ্চলের বাস্তবতারই প্রতিফলন, ওয়াশিংটনের অনেকেই যে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চান না। বাস্তবতাটি হলো, এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। সুতরাং চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের বরং চীনের সঙ্গে শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার কৌশল নিতে হবে। জাপান ও ভারতের শিল্প কেন্দ্রগুলো এবং গুরুত্বপূর্ণ জলপথের মতো কৌশলগত অবস্থানগুলোতে প্রবেশাধিকার সুরক্ষিত রাখার ওপর বেশি মনোযোগ দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই মিত্র দেশগুলোর আত্মরক্ষার সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করার মাধ্যমে নিজের মাথা থেকে কিছু বোঝা কমানোর চেষ্টাও করতে হবে। এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু নিজের নেতৃত্বাধীন জোট ও সংস্থাগুলোতে সীমাবদ্ধ না থেকে এই অঞ্চলের বহুপাক্ষিক বিভিন্ন জোট ও সংস্থাগুলোর সঙ্গেও সম্পৃক্ততা ও সহযোগিতা বাড়াতে হবে।

ভারসাম্যমূলক কৌশলের বিরোধীরা হয়তো যুক্তি দিতে পারেন যে, এতে চীন আরও আশকারা পাবে এবং ওয়াশিংটনের মিত্রদের মধ্যেও পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কা জাগবে। কিন্তু তারা ভুল। ভারসাম্যমূলক কৌশল না নিলে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে নিজের অবস্থান হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে এবং চীনকেও ঠেকাতে পারবে না। অঞ্চলটি দুটি মহাসাগরের বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত হওয়ায় সামরিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। এই অঞ্চলের ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্যের জন্য অনুকুল নয়। এখানে বরং ভারসাম্যমূলক পদ্ধতি আরও টেকসই এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ হবে।

ক্ষমতার লড়াই

জোট গড়ার মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনে বাইডেন প্রশাসন এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক জোরদারে প্রচুর বিনিয়োগও করেছে। যেমন, ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্বে’ উন্নীত করেছে। ভারতের সঙ্গে নতুন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং সহ-উৎপাদন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বাইডেনের জোট গড়ার এই প্রচেষ্টাগুলোই যথেষ্ট নয়।

যুক্তরাষ্ট্রকে পুরো অঞ্চলজুড়ে সামরিক ঘাঁটি, বিমানঘাঁটি ও বন্দরগুলোতে প্রবেশাধিকার অর্জন করতে হবে। যাতে সংকটের সময় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও মূল্যবোধকে শক্তিশালি করার জন্য জোট ও অংশীদারত্বের নেটওয়ার্কও তৈরি করতে হবে। পাশপাশি মিত্র ও অংশীদার দেশগুলোর নিজস্ব সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করতে হবে। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ চীনের ক্ষেপণাস্ত্রের বিশাল অস্ত্রাগার। এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের বেশিরভাগ বর্তমানে গুয়াম,জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বড় ঘাঁটিগুলোতে অবস্থান করছে। কিন্তু এই ঘাঁটিগুলো চীনের হামলার শিকার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। চীন সহজেই এসব ঘাঁটিতে হামলা চালাতে পারবে। সেই হামলা থেকে বাঁচার সম্ভাবনা বাড়াতে অসংখ‍্য ছোট ছোট ঘাঁটিতে সেনা রাখবে ভাবছে পেন্টাগন। অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন ও পাপুয়া নিউগিনিতে সেনা রাখার অনুমতিও পেয়েছে বাইডেন প্রশাসন। তবে পাপুয়া নিউগিনির ক্ষেত্রে দেশটির সংসদেরও অনুমতি পেতে হবে যা এখনো বাকি।

পাপুয়া নিউগিনি ও ফিলিপাইন ইঙ্গিত দিয়েছে, চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং অস্ত্র মজুদের জন্য তাদের ঘাঁটিগুলো ব্যবহারের অনুমতি তারা দেবে না। বিশেষ করে তাইওয়ান নিয়ে কোনও যুদ্ধ বাধলে তাদের ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করা যাবে না। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা দেশগুলোর ঘাঁটিগুলোতেও প্রবেশাধিকার নেই যুক্তরাষ্ট্রের। এমনকি দক্ষিণ কোরিয়াও যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার সীমিত করতে পারে। ফলে, আকস্মিকভাবে কিছু ঘটলে যুক্তরাষ্ট্রকে জাপান ও গুয়ামের ঝুঁকিপূর্ণ রানওয়ের ওপর নির্ভর করতে হবে। অথবা অস্ট্রেলিয়া থেকে দূরপাল্লার বোমারু বিমান ওড়াতে হবে।

এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বাড়াতে বাইডেন প্রশাসন সামরিক কৌশলেও পরিবর্তন এনেছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্রে রেখে সামরিক অভিযান চালানোর পুরোনো কৌশলের বদলে মিত্র দেশগুলোকেও গুরুত্ব দেওয়ার কৌশল নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। পেন্টাগন অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সঙ্গে যৌথ বিমান ও নৌ মহড়া এবং জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে উপকূলরক্ষা প্রশিক্ষণসহ ত্রিপক্ষীয় সামরিক মহড়ার ওপর বাড়তি জোর দিচ্ছে। তবে এখানেও বাইডেন প্রশাসন হতাশার মুখোমুখি হয়েছে। এই অঞ্চলের খুব কম দেশই পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যোগ দিতে ইচ্ছুক। কারণ এর জন্য তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে কোনও একটিকে বেছে নিতে হবে। তারা এভাবে একচেটিয়াভাবে কারও পক্ষ নিতে চায় না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র বলছে, কোনও আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোট তৈরি করার উদ্দেশ্য নেই তাদের। তা সত্ত্বেও মিত্র ওয়াশিংটনের দেশগুলোসহ এই অঞ্চলের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রকে সন্দেহের চোখে দেখছে।

বন্ধু বটে, তবে কোনো সুবিধা নেই

আকস্মিক পরিস্থিতিতে মিত্র ও অংশীদারদের মধ্যে কার্যকরভাবে সমন্বয় করার জন্য কোনও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াও নেই বাইডেনের জোট গড়ার প্রকল্পে। অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে নিরাপত্তা ফোরাম গঠন করেছে তার একটি লক্ষ্য সামুদ্রিক সহযোগিতা আরও বাড়ানো। কিন্তু সঙ্কটের সময়ে সমন্বিতভাবে কাজ করার জন্য চারটি দেশের মধ্যে যে গোয়েন্দা সহায়তা প্রয়োজন হবে তা এতে নেই। গোয়েন্দা সহযোগিতা এখনো দ্বিপাক্ষিক রয়ে গেছে। একইভাবে, আঞ্চলিক যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি সামরিক সহায়তার জন্য জাপানের ওপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু দুই দেশের যৌথ অপারেশনে কার্যকরভাবে সমন্বয় করার জন্য কোনও যুক্তরাষ্ট্র-জাপান যৌথ কমান্ড নেই।

মিত্রদের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় ঘাটতি আছে। গত কয়েক বছরে এশিয়ার কিছু দেশ প্রতিরক্ষা খাতে বেশি খরচ করতে শুরু করেছে। কিন্তু তারা এখনও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই অঞ্চলের বর্তমান প্রতিরক্ষার ভার বহনে অংশ নেওয়ার সক্ষমতাও অর্জন করতে পারেনি, যা সংঘাতের সময়ের চেয়ে অনেক কম। ফলে যুদ্ধের সময়ে তাদের পক্ষে সেই বোঝা বহন করা আরও কঠিন হবে। যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোকে বর্তমানের চেয়ে বহুগুণ বেশি ব্যয় করতে হবে। কিন্তু সহসাই তারা সেই সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে না।

উদারহণস্বরুপ, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার কথা বলা যায়। দুটি দেশই প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছে। চীনের হুমকি মোকাবেলায় জাপান আগামী পাঁচ বছরে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর কথা বলেছে। এই প্রকল্পে জাপান যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৪০০ টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র কিনবে। অস্ট্রেলিয়াও আগামী দশ বছরের মধ্যে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ২ শতাংশ থেকে ২.৩ শতাংশে উন্নীত করবে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূর-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ কিনছে।

কিন্তু এসব কাজে লাগানোর মতো সক্ষমতা নেই দেশ দুটির। টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা ও লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণের সক্ষমতাও নেই জাপানের। নিজেদের প্রতিরক্ষা বা যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানে অবদান রাখা কোনোটার জন্যই না। আর জাপান যে স্বল্প সংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র কিনছে তাও যথেষ্ট নয়। এ ছাড়া জন্মহার কমে যাওয়ায় জাপানের তরুণ জনসংখ্যাও কমে গেছে। এতে জাহাজ ও বিমান চালানোর জন্য প্রশিক্ষিত কর্মীরও ঘাটতি রয়েছে দেশটির। অস্ট্রেলিয়ার সামরিক বাহিনীও প্রশিক্ষিত সামরিক কর্মীর অভাবে ভুগছে। পারমাণবিক ডুবোজাহাজ চালানো ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বেসামরিক বিশেষজ্ঞেরও অভাব রয়েছে দেশটির।

দক্ষিণ কোরিয়াও শক্ত অবকাঠামো, বিমান প্রতিরক্ষা ও পরিবহনে খুব বেশি বিনিয়োগ করেনি। একইভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বেও তাইওয়ান চীনের আক্রমণ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় স্থায়ী প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ায়নি। দেশটি শুধুমাত্র স্থানান্তরযোগ্য বিমান প্রতিরক্ষা, সামুদ্রিক মাইন ও সস্তা ড্রোনের মতো কিছু অস্থায়ী ব্যবস্থা নিয়েছে। ফলত শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে একাই ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিরক্ষা বোঝার সিংহভাগ বহন করতে হচ্ছে।

হারাতে না পারলে ভারসাম্য বেছে নাও

বাইডেন প্রশাসনের সীমিত সাফল্য দেখে প্রশ্ন উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্র আদৌ এশিয়ায় সামরিক আধিপত্য বজায় রাখতে পারবে কি না বা সেই চেষ্টাও করা উচিত হবে কি না। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নেতার প্রত্যাশা, চীনের সামরিক হুমকি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীনবিরোধী নিরাপত্তা জোট গড়ে উঠবে। এর মধ্য দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যও বজায় থাকবে। কিন্তু এই আশাবাদ অযৌক্তিক। কারণ এই অঞ্চলের সামুদ্রিক ভূগোল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নিরাপত্তা জোট গড়ে ওঠার অনুকুল নয়।

এই অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে রয়েছে বিশাল সমুদ্র— প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর। এই বিশাল সমুদ্র দেশগুলোর জন্য শক্তিশালী প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা দেয়াল হিসেবে কাজ করে। জোট গড়ার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় বাধা। ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের মানসিক বিচ্ছিন্নতাবোধ ও একা থাকার প্রবণতা এবং আত্মতুষ্টিও কাজ করে। তবে এমন নয় যে, চীনের আঞ্চলিক প্রতিবেশীরা কেউই বেইজিংয়ের হুমকি নিয়ে চিন্তিত নয়। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো বেইজিংকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে না। ভারত-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের সামুদ্রিক প্রকৃতি সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ীভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ইচ্ছার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। কারণ এই অঞ্চলে বিমান ও নৌ বাহিনী মোতায়েন করা যেমন সহজ,সরিয়ে নেওয়াও তেমনই সহজ।

এই সহজগম্যতার কারণে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আশঙ্কা কাজ করে যে, যুক্তরাষ্ট্র যে কোনও সময় তাদের ছেড়ে চলে যেতে পারে। আর তাছাড়া সাগরপথের এই সুবিধা থাকায় যুক্তরাষ্ট্র দেশগুলোর স্থলঘাঁটিগুলোতেও কোনোও বিনিয়োগ করবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রতার বিনিময়ে দেশগুলোর মধ্যে বিনিয়োগ সুবিধা লাভের একটি প্রত্যাশাও থাকে। এশিয়ার অনেক দেশ ইতিমধ্যেই এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা গ্যারান্টির স্থায়িত্ব নিয়ে যৌক্তিকভাবেই সন্দেহ প্রকাশ করেছে। কারণ, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে যেমন ব্যপকভাবে ও আন্তরিকতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক প্রতিশ্রুতি দেয় ও বাস্তবায়ন করে এশিয়ার ক্ষেত্রে এখনও তেমনটা দেখা যায়নি।

তবে যুক্তরাষ্ট্র একটি ভিন্ন পথও বেছে নিতে পারে— নেওয়া উচিতও। সেটি হলো, চীনের সঙ্গে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একটি চৌকস এবং আরও টেকসই কৌশল গ্রহণ করা। এমনিতেও এশিয়ায় বন্ধুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা জোট গড়ে তুলতেও যুক্তরাষ্ট্রের একটি ভারসাম্যমূলক কৌশল প্রয়োজন হবে, তবে তা একটু ভিন্ন ধরনের জোট হবে। ভারসাম্যমূলক কৌশলে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মিত্র ও অংশীদারদের সংখ্যা বাড়ানো এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও ঘাঁটিগুলোতে প্রবেশাধিকার পাওয়া কম গুরুত্বপূর্ণ হবে। তার চেয়ে বরং বেশি গুরুত্ব দিতে হবে জোট সদস্যদের মান ও কৌশলগত মূল্যকে এবং এই অঞ্চলে প্রবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোকে।

যুক্তরাষ্ট্রকে এই অঞ্চলের শিল্প শক্তির প্রধান কেন্দ্রগুলোকে— বিশেষ করে ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে বেইজিংয়ের কবল থেকে মুক্ত রাখায় বেশি মনোযোগী হতে হবে। এর জন্য তাদের আত্মরক্ষার সক্ষমতা বাড়ানো এবং তাদের অর্থনৈতিক উন্নতিতে সহায়তা বাড়াতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। ওয়াশিংটনকে এই অঞ্চলের মূল জলপথ, বিশেষ করে মালাক্কা প্রণালী ও পূর্ব চীন এবং দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্য দিয়ে যাওয়া জলপথের নিরাপত্তায় আরও মনোযোগী হতে হবে। এজন্য ভারত, জাপান, ফিলিপাইন ও সিঙ্গাপুরের প্রতি সহায়তা বাড়াতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে তার আঞ্চলিক মিত্রদের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তিতে করা প্রতিশ্রুতিগুলোও পালন করতে হবে। পাশপাশি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের জন্য বিনিয়োগ সহায়তাও অব্যাহত রাখতে হবে। তবে চীনের সঙ্গে শক্তির ভারসাম্য রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বড় কোনও ভুমিকা রাখতে পারবে না, এমন দেশগুলোর প্রতি মনোযোগ কমাতে হবে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রতিটি পদক্ষেপের বিরুদ্ধেই পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই যুক্তরাষ্ট্রের।

মানসিকতায় ভারসাম্য

ভারসাম্যমূলক কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বোঝা মিত্র দেশগুলোর ওপরও স্থানান্তরিত করার বিষয়ে জোর দেওয়া হবে। যাতে তারা নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ওয়াশিংটনের উচিৎ এই অঞ্চলে তার সব মিত্রকেই নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে উৎসাহিত করা। তবে বিশেষ করে, জাপান ও ফিলিপাইনকে প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহিত করতে হবে। তাইওয়ানকেও জরুরি ভিত্তিতে নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে চাপ দিতে হবে।

এশিয়ার অনেকে দেশের পক্ষেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দ্রুত আধুনিকীকরণ সম্ভব হবে না। কারণ গত কয়েক দশক ধরে তারা প্রতিরক্ষা খাতে খুব কম বিনিয়োগ করেছে, এছাড়া তাদের জনবল সংকটও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও কৌশলী হতে হবে। দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যেসব সামরিক সহায়তা ও অস্ত্র চুক্তি করবে তাতে এমন কিছু শর্তজুড়ে দিতে হবে যাতে তারা যুদ্ধবিমানের মতো দামি সরঞ্জাম কিনে অর্থের অপচয় না করতে পারে। তাদেরকে বরং তুলনামূলকভাবে সস্তা ও সহজে পরিবহনযোগ্য সামরিক সম্পদ, যেমন, চালকহীন জাহাজ, ড্রোন, সামুদ্রিক মাইন জাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার দিকে আগ্রহী করতে হবে। মিত্র দেশগুলোকে নিজেদের প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে যৌথ-উৎপাদন ব্যবস্থা ও প্রযুক্তি ভাগাভাগির মতো প্রণোদনাও ব্যবহার করতে হবে ওয়াশিংটনকে। সর্বোপরি,ওয়াশিংটনকে তার মিত্র ও অংশীদারদের বোঝাতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তারও একটা সীমা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একার পক্ষে তাদের জন্য সবকিছু করে দেওয়া সম্ভব না।

প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ একটি দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি এর সুরক্ষার জন্যও যে সুবিধা দেয় তার ওপর জোর দিতে হবে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিও এড়াতে পারবে। এ ছাড়া এশিয়ান মঞ্চে দীর্ঘস্থায়ীভাবে সেনা মোতায়েন কমিয়ে ওয়াশিংটন আরও সচেতনভাবে এই অঞ্চলের সমুদ্রকে ব্যবহার করতে পারে। দীর্ঘস্থায়ীভাবে সেনা মোতায়েনের পরিবর্তের যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ প্রয়োজনের সময় দ্রুত শক্তিবৃদ্ধির সক্ষমতা বাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া। যেমন, সমুদ্রে ভাসমান ঘাঁটি স্থাপন করে যুদ্ধ সরঞ্জাম ও গোলাবারুদের মজুদ বাড়ানো, বিদ্যমান ঘাঁটিগুলোতে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা উন্নত করা, দ্রুত সেনা সরবরাহে সমন্বয়ের জন্য রসদ কাঠামোর আধুনিকীকরণ করা। এই অঞ্চলের ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যকে অঞ্চলটির দেশগুলোর জন্য প্রতিরক্ষার প্রথম লাইন হিসেবে ধরে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র মিত্র দেশগুলোর আত্মরক্ষার সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক সক্ষমতার অপচয় এড়াতে পারবে এবং অন্যান্য আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় শক্তি নিয়োগ করতে পারবে।

ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ওয়াশিংটনকে নিজের ওপরও চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু অকাসের মতো নিজের নেতৃত্বাধীন জোটের ওপর নির্ভরতা কমানো শিখতে হবে। ভারত মহাসাগরীয় অন্যান্য আঞ্চলিক জোটগুলোর সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক বাড়ানো যায় তার পথ বের করতে হবে। এই অঞ্চলের বিদ্যমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা নেটওয়ার্কে নিজেকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে। যেমন, আসিয়ান ও এর উপজোটগুলোর সঙ্গে আরও সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে। অন্যান্য আঞ্চলিক ছোট সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানোর জন্যও নতুন সুযোগের সন্ধান করা উচিৎ। কারণ, নানা সীমাবদ্ধতা সত্বেও এই গ্রুপগুলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে এই অঞ্চলে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য এই গ্রুপগুলোর সঙ্গে মিলে ও তাদের পাশাপাশি কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

তবে ভারসাম্যমূলক কৌশল গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হল ওয়াশিংটনের মনোভাব। এশিয়ায় সামরিক আধিপত্য বজায় রাখতে হবে, এমন ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিতে গভীরভাবে শেকড় গেড়ে বসে আছে। বেইজিং থেকে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের দুটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেরই এই ধারণাকে আরও বেশি আঁকড়ে ধরার ঝুঁকি রয়েছে। ভারসাম্যমূলক কৌশলে তুষ্টি যেমন আসে না তেমনি হেরে যাওয়ার মনোভাবও তৈরি হয় না। ফলে আগামী কয়েক দশক ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার জন্য সম্ভবত এটিই একমাত্র আর্থিকভাবে টেকসই উপায়।

লেখক: কেলি এ. গ্রিকো, জেনিফার কাভানা

অনুবাদ: মাহবুবুল আলম তারেক

আরও পড়ুন